একসময় গ্রেপ্তার করা জেনারেলের সঙ্গে বৈঠকে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট

সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল-শারআ নিউইয়র্কে জাতিসংঘ অধিবেশনে যোগ দিতে এসে একসময় তাকে বন্দি করা যুক্তরাষ্ট্রের অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল ডেভিড পেট্রেয়াসের সঙ্গে মুখোমুখি আলোচনায় বসেছেন।

বিদ্রোহী নেতা থেকে রাষ্ট্রপ্রধান হয়ে ওঠা আল-শারআর এ আবির্ভাবকে “মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাসে সবচেয়ে নাটকীয় রূপান্তর” হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন পেট্রেয়াস। মঙ্গলবার (২৩ সেপ্টেম্বর) রাতে এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা।

সংবাদমাধ্যমটি বলছে, নিউইয়র্কে এক রাজনৈতিক ফোরামে সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে এক বিরল দৃশ্যের জন্ম হলো। আর তা হচ্ছে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল-শারআ বসেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের অবসরপ্রাপ্ত ফোর-স্টার জেনারেল ডেভিড পেট্রেয়াসের পাশে, যিনি একসময় তাকেই গ্রেপ্তার করেছিলেন।

গত বছর সামরিক অভিযানে সাবেক প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদকে ক্ষমতাচ্যুত করে তার পরিবারের অর্ধশত বছরের শাসনের অবসান ঘটান আল-শারআ। এ বছরের জানুয়ারি থেকে তিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

পেট্রেয়াস ছিলেন ইরাক আক্রমণের সময় মার্কিন বাহিনীর প্রধান, আর এই বাহিনী ২০০৬ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত আল-শারআকে বন্দি করে রেখেছিল। পরে তিনি মার্কিন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা (সিআইএ)-এর পরিচালক হন।

মুক্তির পর ২০১২ সালে আসাদবিরোধী লড়াইয়ে আল-শারআ সিরিয়ায় আল-নুসরা ফ্রন্ট গঠন করেন। চার বছর পর দলটি আল-কায়েদার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে এবং এক বছর পর অন্যান্য গোষ্ঠী নিয়ে হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস) গঠন করে, যার নেতৃত্ব নেন আল-শারআ।

মার্কিন সরকার ২০১৮ সালে আল-কায়েদার অতীত সম্পর্কের কারণে এইচটিএস-কে ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ ঘোষণা করেছিল। তবে এ বছর জুলাইয়ে আসাদ-পরবর্তী সিরিয়ায় নরম অবস্থান নেওয়ায় সেই তকমা প্রত্যাহার করা হয়। আল-শারআর মাথার জন্য যুক্তরাষ্ট্র যে ১ কোটি ডলারের পুরস্কার ঘোষণা করেছিল, সেটিও গত ডিসেম্বরে তুলে নেওয়া হয়।

এমন অবস্থায় গত রোববার জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে আল-শারআ নিউইয়র্কে পৌঁছান। প্রায় ছয় দশক পর প্রথমবারের মতো কোনো সিরীয় প্রেসিডেন্ট জাতিসংঘের এ আসরে অংশ নিলেন।

তিনি বৃহৎ প্রতিনিধিদল নিয়ে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিওসহ বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন এবং সোমবার সাধারণ পরিষদের বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতায় বক্তব্য রাখেন। এর পর কনকর্ডিয়া বার্ষিক সম্মেলনে যোগ দেন এবং সেখানেই পেট্রেয়াস তার সঙ্গে আলোচনায় অংশ নেন। এ সম্মেলন বিশ্বনেতা, ব্যবসায়ী ও এনজিও প্রতিনিধিদের নিয়ে বৈশ্বিক সংলাপ ও সহযোগিতা গড়ে তোলায় কাজ করে।

পেট্রেয়াস স্বীকার করেন, তাদের একসঙ্গে বসা অস্বাভাবিক মনে হলেও তিনি আল-শারআর নাটকীয় রাজনৈতিক রূপান্তরকে প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, “একজন বিদ্রোহী নেতা থেকে রাষ্ট্রপ্রধান হয়ে ওঠা মধ্যপ্রাচ্যের সাম্প্রতিক ইতিহাসে সবচেয়ে নাটকীয় পরিবর্তন।”

পরে তিনি আল-শারআর ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যের খোঁজ নেন এবং বলেন, “অনেকের মতো আমিও তার ভক্ত।”

আল-শারআ হাসিমুখে বলেন, “একসময় আমরা যুদ্ধে ছিলাম, এখন সংলাপে। যুদ্ধের অভিজ্ঞতা থাকা মানুষই সবচেয়ে ভালো জানে শান্তির মূল্য”। তিনি বলেন, “অতীতকে আজকের নিয়মে বিচার করা যায় না, আর আজকেও অতীতের নিয়মে বিচার করা যায় না।”

নিজের আল-কায়েদা সংশ্লিষ্ট সময় নিয়ে আল-শারআ বলেন, হয়তো কিছু ভুল হয়েছিল, কিন্তু এখন মূল লক্ষ্য সিরিয়াকে স্থিতিশীল করা। তিনি বলেন, “আমরা একটি মহৎ উদ্দেশ্যে লড়েছি, আর এখন সেই প্রতিশ্রুতিই আমাদের এখানে এনেছে, মিত্র ও বন্ধুদের মাঝে।”

এ বছর সিরিয়ায় সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় হতাহতের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আসাদ সরকার দেশকে বিশৃঙ্খলার মধ্যে ফেলে গেছে এবং “সব পক্ষই ভুল করেছে, এমনকি সরকারের কিছু অংশও”। তবে তিনি জানান, নতুনভাবে গঠিত একটি কাউন্সিল তদন্ত করছে এবং অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনা হবে।

তিনি দাবি করেন, জনগণ নতুন সরকারের পাশে আছে এবং বর্তমানে অগ্রাধিকার হলো সিরিয়ার ঐক্য ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন। এজন্য তিনি আবারও মার্কিন কংগ্রেসকে ‘সিজার অ্যাক্ট’ প্রত্যাহারের আহ্বান জানান, যার মাধ্যমে সিরিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল।

আল-শারআ সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর সুরক্ষার প্রতিশ্রুতি দেন। তবে তিনি স্পষ্ট করে বলেন, রাষ্ট্রের বাইরে কোনো সশস্ত্র বাহিনী থাকতে পারবে না।

ইসরায়েল প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আসাদ পতনের পর থেকে দেশটিতে এক হাজারের বেশি হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল এবং গোলান মালভূমি দখল করে রেখেছে। তবে সিরিয়ার লক্ষ্য আরেকটি যুদ্ধ নয়; বরং পুনর্গঠন। তিনি জানান, ১৯৭৪ সালের মার্কিন-মধ্যস্থায় স্বাক্ষরিত চুক্তির ভিত্তিতে ইসরায়েলের সঙ্গে নিরাপত্তা আলোচনা চলছে।

পিএ/এসএন

Share this news on:

সর্বশেষ

img
দিনাজপুরে বাস-ট্রাক্টরের সংঘর্ষে নিহত ২ Dec 27, 2025
img
গণমাধ্যমের ওপর হামলা বাংলাদেশের মর্মমূলে আঘাত: কাদের গনি চৌধুরী Dec 27, 2025
img
‘আমি ক্ষমাপ্রার্থী’, দল বদলের বিষয়ে রাশেদ খাঁন Dec 27, 2025
img
স্মার্ট এনআইডি কার্ড বিতরণ শুরু Dec 27, 2025
img
গত ১৫ বছরে দেশে প্রকৃত অর্থে কোনো নির্বাচন হয়নি: পররাষ্ট্র উপদেষ্টা Dec 27, 2025
পরামর্শ বরকতময় করার উপায় | ইসলামিক টিপস Dec 27, 2025
img
আগামীকাল বঙ্গভবনে শপথ নেবেন দেশের ২৬তম প্রধান বিচারপতি Dec 27, 2025
নবীজি অন্যদের সাথে যেমন আচরণ করতেন | ইসলামিক জ্ঞান Dec 27, 2025
হাদির কবর জিয়ারত করতে আসছেন তারেক রহমান Dec 27, 2025
উপদেষ্টারা না আসা পর্যন্ত শাহবাগ ছাড়বে না ইনকিলাব মঞ্চ, অচল শাহবাগ Dec 27, 2025
img
সফলতা আসে সততার পথ ধরে: ইমরান হাশমি Dec 27, 2025
img
নতুন বাংলাদেশ গঠনে তারেক রহমানের নেতৃত্ব অত্যন্ত প্রয়োজন: রাশেদ খান Dec 27, 2025
img
আওয়ামী লীগ নেতা নূর হোসেন গ্রেপ্তার Dec 27, 2025
img
নির্বাচিত সরকারকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেবে অন্তর্বর্তী সরকার: পররাষ্ট্র উপদেষ্টা Dec 27, 2025
img
চিংড়ি রপ্তানিতে আন্তর্জাতিক পদ্ধতি অনুসরণের আহ্বান মৎস্য উপদেষ্টার Dec 27, 2025
img
উইকেটের কারণে দ্রুত এগিয়েছে ম্যাচ: রুট Dec 27, 2025
পরামর্শ বরকতময় করার উপায় Dec 27, 2025
img
মাত্র ১৩২ রানে থেমে গেল রাজশাহী ওয়ারিয়র্স Dec 27, 2025
img
'খুদে মেসি' সেই সোহান চান তারেক রহমানের সাক্ষাৎ Dec 27, 2025
img
ঢাকা-১৭ আসনে ভোটার হচ্ছেন তারেক রহমান: ইসি সচিব Dec 27, 2025