পশ্চিম তীর দখলের চেষ্টা হবে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ‘লাল রেখা’ অতিক্রম : ফ্রান্স

ইসরায়েল পশ্চিম তীরের কোনো অংশ দখল করার চেষ্টা করলে তা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য হবে একেবারে ‘লাল রেখা’ অতিক্রম এবং এতে আরব-ইসরায়েল কূটনৈতিক স্বাভাবিকীকরণের সমাপ্তি ঘটবে বলে বুধবার জানিয়েছেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ। তিনি দাবি করেন, এ বিষয়ে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছ থেকে আশ্বাস পেয়েছেন।

ম্যাক্রোঁ জানান, তিনি ট্রাম্পের হাতে ফিলিস্তিনের ভবিষ্যৎ নিয়ে তিন পাতার একটি পরিকল্পনা তুলে ধরেছেন। নিউইয়র্ক ঘোষণার ভিত্তিতে তৈরি ওই পরিকল্পনায় গাজা ও পশ্চিম তীরে ভবিষ্যতে হামাসকে শাসন থেকে বাদ দেওয়ার প্রস্তাব রাখা হয়েছে। এ ঘোষণাকে ১৪৩টিরও বেশি রাষ্ট্র সমর্থন করেছে।

ফ্রান্স ২৪-এ দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ম্যাক্রোঁ বলেন, মঙ্গলবার ট্রাম্পের সঙ্গে তাঁর বৈঠকের মূল লক্ষ্য ছিল যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও আরব দেশগুলোকে একই অবস্থানে আনা।

পশ্চিম তীরে নতুন বসতি স্থাপন, বিশেষত ই-১ করিডর প্রকল্প, যেখানে ৩ হাজার ৪০০টি নতুন বাড়ি নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। এ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে ম্যাক্রোঁ বলেন, “এ বিষয়ে খুব স্পষ্টভাবে বলতে গেলে ইউরোপীয়রা ও আমেরিকানরা একই অবস্থানে আছে।”

ব্রিটিশ কর্মকর্তারা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্সসহ কয়েকটি দেশ ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রতিশোধ হিসেবে ট্রাম্প পশ্চিম তীরে অবৈধ ইসরায়েলি বসতিকে সার্বভৌমত্ব স্বীকৃতি দিতে পারেন। এমন হলে দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান কার্যত ভেঙে পড়বে।

কিন্তু ম্যাক্রোঁ বলেন, পশ্চিম তীর দখলের যে কোনো প্রচেষ্টা “আব্রাহাম চুক্তির সমাপ্তি ঘটাবে, যা ট্রাম্পের প্রথম প্রশাসনের একটি বড় সফলতা ছিল। সংযুক্ত আরব আমিরাত এ বিষয়ে খুবই স্পষ্ট।” তিনি আরও বলেন, “আমার বিশ্বাস, এটি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি লাল রেখা।”

ম্যাক্রোঁর বক্তব্যে গাজা যুদ্ধ-পরবর্তী কূটনৈতিক প্রস্তুতির অন্তরালের এক বিরল ঝলক উঠে এসেছে।

২০২০ সালের আব্রাহাম চুক্তি, যা ইসরায়েল ও সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ কয়েকটি আরব রাষ্ট্রের সম্পর্ক স্বাভাবিক করেছিল, ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদের অন্যতম বড় কূটনৈতিক অর্জন হিসেবে বিবেচিত হয়।

যদি ট্রাম্প সত্যিই দখলবিরোধী অবস্থান নেন, তবে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু গুরুতর রাজনৈতিক চাপে পড়বেন, কারণ তাঁর কট্টর-ডানপন্থী জোটের অংশ পশ্চিম তীর আংশিক বা পুরোপুরি দখলের দাবি করছে। অন্যদিকে, যদি নেতানিয়াহু দখল চালিয়ে যান এবং যুক্তরাষ্ট্র এতে সম্মতি দেয় বা নীরব থাকে, তবে দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের পথ প্রায় বন্ধ হয়ে যাবে। আগামী সোমবার নেতানিয়াহু ট্রাম্পের সঙ্গে হোয়াইট হাউসে বৈঠক করবেন এবং শুক্রবার জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে বক্তব্য দেবেন।

ম্যাক্রোঁ বলেন, তাঁর নতুন বহুস্তরীয় পরিকল্পনার প্রথম লক্ষ্য হলো যুদ্ধবিরতি নিশ্চিত করা এবং সব বন্দি মুক্ত করা।

তিনি সরাসরি ট্রাম্পকে উদ্দেশ করে বলেন, “আপনার বড় ভূমিকা রাখার সুযোগ আছে এবং আপনি বিশ্বে শান্তি দেখতে চান।”

তিনি আরও বলেন, “আমেরিকানদেরকে ইসরায়েলের ওপর চাপ দিতে রাজি করাতে হবে, কারণ যুক্তরাষ্ট্রই হলো আসল প্রভাব বিস্তারের দেশ।”

ট্রাম্পের বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফও জানান, মঙ্গলবার আঞ্চলিক আরব ও মুসলিম নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্র প্রেসিডেন্ট মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির জন্য ২১ দফা পরিকল্পনা উপস্থাপন করেছেন। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ফাঁকে এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, “আমরা আশাবাদী, এমনকি আত্মবিশ্বাসীও যে, আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই আমরা বড় কোনো সাফল্যের ঘোষণা দিতে পারব।”

ম্যাক্রোঁ বলেন, ফ্রান্স ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিয়েছিল শান্তি প্রক্রিয়া শুরু করার জন্য, যা হামাসকে আলাদা করার সেরা পথ। তাঁর লক্ষ্য ছিল হামাসকে নিরস্ত্র ও ভেঙে দেওয়া।

তবে তিনি ইঙ্গিত দেন, ইসরায়েলি মন্ত্রিসভার কিছু ডানপন্থী সদস্য আসলে রাজনৈতিক সমঝোতা ভাঙতেই বেশি আগ্রহী। তিনি বলেন, “কারও কারও লক্ষ্য হামাসের বিরুদ্ধে লড়াই নয়, বরং শান্তির পথে বাধা তৈরি করা।” তিনি আরও যোগ করেন, “পশ্চিম তীরে হামাস নেই।”

নেতানিয়াহুর সর্বাত্মক যুদ্ধনীতি সম্পর্কে ম্যাক্রোঁ বলেন, এটি ব্যর্থ হয়েছে। কারণ এতে বন্দিদের জীবন ঝুঁকিতে পড়ছে এবং হামাসের সামরিক সক্ষমতা কমেনি। “হামাস যোদ্ধার সংখ্যা আগের মতোই আছে। বাস্তব দৃষ্টিকোণ থেকে সর্বাত্মক যুদ্ধ কাজ করছে না। এই যুদ্ধ ব্যর্থ।”

তিনি বলেন, বন্দিদের ভাগ্য এবং গাজার সাধারণ জনগণকে “তাদের হাতে ছেড়ে দেওয়া যায় না, যাদের অগ্রাধিকার বন্দি মুক্তি নয়।” তিনি অভিযোগ করেন, “নেতানিয়াহুর প্রথম অগ্রাধিকার বন্দি মুক্তি নয়, তা হলে তিনি গাজার সর্বশেষ হামলা চালাতেন না, কিংবা কাতারের মধ্যস্থতাকারীদের টার্গেট করতেন না।”

ম্যাক্রোঁ জোর দিয়ে বলেন, ভবিষ্যতে গাজা ও পশ্চিম তীরের শাসন কাঠামোতে হামাস থাকবে না। সেখানে একটি সংস্কারপ্রতিশ্রুত নতুন ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ দায়িত্ব নেবে। তবে তিনি কোনো সময়সীমা দেননি।

তিনি সতর্ক করেন, কয়েক দিনের মধ্যে যুদ্ধ বন্ধ না হলে ইউরোপকে বিকল্প পদক্ষেপ বিবেচনা করতে হবে। এ পদক্ষেপে নিষেধাজ্ঞাও থাকতে পারে কি না, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, “অবশ্যই।”

ইউরোপীয় ইউনিয়নে নিষেধাজ্ঞার পক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠতা গড়ে উঠবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, তিনি সেই প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। প্রতিটি দেশের নিজস্ব ইতিহাস ও সংবেদনশীলতা আছে যেমন জার্মানি ও ইতালি নিষেধাজ্ঞার বিরোধিতা করছে।

ফিলিস্তিনিদের ভবিষ্যতের জন্য রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি দিতে হবে উল্লেখ করে ম্যাক্রোঁ বলেন, “যদি আপনি কোনো জনগোষ্ঠীকে তাদের বৈধ অস্তিত্বের রাজনৈতিক সমাধান না দেন, অথচ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ৭৮ বছর আগে সেটি স্বীকৃতি দিয়েছে, তাহলে আপনি তাদের সম্পূর্ণভাবে আশাহীন করে ফেলবেন, অথবা আরও ভয়াবহ সহিংসতার দিকে ঠেলে দেবেন।”

সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান

Share this news on:

সর্বশেষ

img
পেরুতে ভয়াবহ বাস দুর্ঘটনা, খাদে পড়ে প্রাণ গেল অন্তত ৩৭ জনের Nov 13, 2025
img
সিলেটে বিটিসিএল অফিসে আগুন Nov 13, 2025
img
নোয়াখালীতে আওয়ামী লীগের নাশকতার প্রতিবাদে বিক্ষোভ শিবিরের Nov 13, 2025
img
আ. লীগের কর্মসূচি ঘিরে জাহাঙ্গীরনগরে জাকসু প্রতিনিধিদের অবস্থান Nov 13, 2025
img
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় রেললাইনে আগুন Nov 13, 2025
img
গভীর রাতে ডিএমপির বিবৃতি, হুঁশিয়ারি ভুয়া ভিডিও নিয়ে Nov 13, 2025
img
বরিশালে মধ্যরাতে বিএনপির কার্যালয়ে আগুন Nov 13, 2025
img
আ. লীগের নাশকতা প্রতিরোধে ঢাকায় মধ্যরাতে ইসলামী আন্দোলনের মহড়া Nov 13, 2025
img
ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে চলন্ত বাসে আগুন Nov 13, 2025
img
চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগ নেতা কাশেম চেয়ারম্যান গ্রেপ্তার Nov 13, 2025
img
নাশকতা এড়াতে নারায়ণগঞ্জে র‌্যাবের চেকপোস্ট Nov 13, 2025
img
সরকার আওয়ামী লীগের লকডাউন কর্মসূচি সফল করে দিচ্ছে : গোলাম মাওলা রনি Nov 13, 2025
img
বরগুনায় পৌর আ. লীগ নেতা হাদিছুর রহমান গ্রেপ্তার Nov 13, 2025
img
তুরস্কে ইউক্রেনের সঙ্গে আবারও শান্তি সংলাপ শুরু করতে চায় রাশিয়া Nov 13, 2025
img
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরে নিয়োগে ঘুষ বাণিজ্যের অভিযোগে দুদকের অভিযান Nov 13, 2025
img
ঋত্বিক-আবীর আঙ্কেল সিনেমার বাবা, ওদের সঙ্গে শুটিং করি! ওরা তো সত্যিকারের বাবা নয়: অনুমেঘা Nov 13, 2025
img
চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগ বিরোধী যুবদলের মিছিলে ছাত্রলীগ ও যুবলীগ নেতা! Nov 13, 2025
img
রায়েরবাজার বুদ্ধিজীবী কবরস্থান থেকে ১০ ককটেল-পেট্রোল বোমা জব্দ Nov 13, 2025
img
ঢাবিতে ককটেল বিস্ফোরণ, আহত মাদ্রাসা অধিদপ্তরের কর্মকর্তা Nov 13, 2025
img
‘দুই মাস ফোন ব্যবহার করিনি, মানুষের মন্তব্য পড়ি না’ Nov 13, 2025