জাতিসংঘে ভাষণে ড. ইউনূস

সংস্কার বাস্তবায়নে আর কোনো অনিশ্চয়তা নেই

প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, আগামী নির্বাচনে যে দলই জনগণের সমর্থন পাক না কেন, সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়নে আর কোনো অনিশ্চয়তার অবকাশ থাকবে না।

গতকাল শুক্রবার রাতে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৮০তম অধিবেশনে দেওয়া ভাষণে বাংলাদেশে ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় জাতীয় নির্বাচন ও সংস্কার কার্যক্রম প্রসঙ্গে ড. ইউনূস এ কথা বলেন। নিউইয়র্কের স্থানীয় সময় সকাল ৯টায় (বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যা ৭টা) অধিবেশন শুরু হয়। পরে প্রধান উপদেষ্টা ভাষণ দেন।

বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি), বিটিভি নিউজ ও বাংলাদেশ বেতার এই ভাষণ সরাসরি সম্প্রচার করে।

ভাষণে ড. ইউনূস আগামী ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতির বিষয়ে জাতিসংঘকে জানান। একই সঙ্গে তিনি স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় তাঁর সরকারের চলমান সংস্কার কার্যক্রমের কথা অবহিত করেন।

প্রধান উপদেষ্টা নারীর ক্ষমতায়নে অগ্রাধিকার, যৌন হয়রানি প্রতিরোধ ও সুরক্ষাসংক্রান্ত আইন প্রণয়নের কথা বলেন।

তিনি স্বল্প সময়ের মধ্যে অর্থনৈতিকভাবে ঘুরে দাঁড়াতে প্রবাসীদের গুরুত্বপূর্ণ অবদানের সংস্কার বাস্তবায়নে অনিশ্চয়তা নেই বিষয়টি উল্লেখ করেন। নাজুক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি মজবুত করতে প্রয়োজনীয় সংস্কারমূলক পদক্ষেপ, রাজস্ব আহরণ ব্যবস্থাপনার সংস্কার, সামাজিক ব্যবসার ধারণার প্রস্তাব, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবেলায় পদক্ষেপ জোরদার, রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান ও প্রতিকার, তরুণ সম্প্রদায়ের উন্নয়ন—এসব বিষয়ে বলেন। তিনি উন্নয়নশীল দেশ থেকে সম্পদ পাচার রোধে কঠোর আন্তর্জাতিক বিধি-বিধান প্রণয়ন এবং এর প্রয়োগ নিশ্চিতের প্রস্তাব করে বলেন, পাচার হওয়া সম্পদ পুনরুদ্ধার তাঁর সরকারের অন্যতম শীর্ষ অগ্রাধিকার। তিনি পূর্ব জেরুজালেমকে রাজধানী করে একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবি জানান।

ড. ইউনূস বলেন, গত আট দশক ধরে জাতিসংঘ ধারাবাহিকভাবে তার কর্মপরিধি সম্প্রসারিত করেছে এবং নানা ক্ষেত্রে আরো গভীরভাবে সম্পৃক্ত হয়েছে। বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তা, মানবাধিকার, বিশ্বব্যাপী মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন, ন্যায়বিচার, ন্যায্যতা ও সমতা প্রসারে জাতিসংঘ অনস্বীকার্য ভূমিকা রেখেছে। জাতিসংঘের কারণেই আজ বিশ্বের ১২০টি দেশের প্রায় ১৩ কোটি বিপদাপন্ন মানুষকে জরুরি খাদ্য ও মৌলিক মানবিক সহায়তা এবং ৪৫ শতাংশ শিশুকে টিকা প্রদান করা সম্ভব হচ্ছে।

তিনি বলেন, ‘গত বছর এই মহান সভায় আমি দাঁড়িয়েছিলাম সদ্য গণ-অভ্যুত্থান সংঘটিত একটি দেশের রূপান্তরের আকাঙ্ক্ষা আপনাদের শোনানোর জন্য। আজ এই রূপান্তরের অগ্রযাত্রায় আমরা কতটুকু অগ্রসর হতে পেরেছি, তা বলব।

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘পৃথিবীর প্রতি ১০০ জনের মধ্যে তিনজনের মতো বাংলাদেশে বাস করে। কিন্তু সে কারণে অথবা ভূ-রাজনৈতিকভাবে বিশ্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে বাংলাদেশ রয়েছে বলে আমাদের এই ইতিহাস জানার দরকার, তা কিন্তু নয়।’

বরং এ কারণে বাংলাদেশের এই বর্ণনাটি গুরুত্বপূর্ণ যে তা সাধারণ মানুষের অসাধারণ ক্ষমতার ওপর আস্থা তৈরি করবে, এ কারণে বর্ণনাটি গুরুত্বপূর্ণ যে, তা বিশ্বের সব দেশের মধ্যে আশার সঞ্চার করবে, সংকট যত গভীরই হোক না কেন বা তার নিরসন যত অসম্ভবই মনে হোক না কেন, কখনোই তা থেকে উত্তরণের পথ হারিয়ে যায় না।’

ড. ইউনূস বলেন, “এই বছর আমরা ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে’র প্রথম বার্ষিকী পালন করেছি, যে অভ্যুত্থানে আমাদের তরুণসমাজ স্বৈরাচারকে পরাভূত করেছিল, যার ফলে আমরা বৈষম্যমুক্ত ও ন্যায়বিচারভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণের অভিযাত্রা নতুনভাবে শুরু করতে পেরেছি। সেই বৈষম্যমুক্ত ও ন্যায়বিচারভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণের আকাঙ্ক্ষা পূরণের দায়িত্ব দেওয়া হয় আমাকে ও আমার সহকর্মীদের। ভেঙে পড়া রাষ্ট্রকাঠামোকে পুনর্গঠন করে জনগণের আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য প্রয়োজন ছিল ব্যাপক প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের। যে বিপুল জনসমর্থনের মাধ্যমে আমরা দায়িত্ব পেয়েছিলাম, তার প্রেক্ষাপটে আমাদের জন্য সহজ পথ ছিল নির্বাহী আদেশে সংস্কারকাজগুলো করা। কিন্তু আমরা বেছে নিই কঠিন পথ, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই পথ।”

তিনি বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য ছিল ক্ষমতার ভারসাম্যপূর্ণ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামো গড়ে তোলা, যেখানে আর কোনো স্বৈরশাসকের আবির্ভাব হবে না, কোনো নির্বাচিত নেতা রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক স্বরূপকে ক্ষুণ্ন করতে পারবে না কিংবা রাষ্ট্র ও জনগণের রক্ষকরা ভক্ষকে পরিণত হতে পারবে না।’

ড. ইউনূস বলেন, ‘শাসনব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, নির্বাচনব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা, দুর্নীতিবিরোধী কার্যক্রম, নারী অধিকারসহ সব জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সংস্কার করার জন্য আমরা ১১টি স্বাধীন সংস্কার কমিশন প্রতিষ্ঠা করি। কমিশনগুলো জনমত যাচাই ও গভীর পর্যালোচনা করে বিস্তারিত সংস্কার কার্যক্রম সুপারিশ করে।’

তিনি বলেন, “এ সংস্কার সুপারিশগুলো টেকসইভাবে বাস্তবায়নের জন্য আমরা একটি জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করি, যারা ৩০টিরও বেশি রাজনৈতিক দল ও জোটকে নিয়ে আলোচনায় বসে। এ কমিশনের লক্ষ্য ছিল সংস্কার প্রস্তাবগুলোর প্রতি দল-মত-নির্বিশেষে একটি টেকসই সামাজিক অঙ্গীকার তৈরি করা। আমাদের এই অন্তর্ভুক্তিমূলক পদক্ষেপ সফল হয়। আমরা জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের এক বছর পূর্তিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে একই মঞ্চে দাঁড়িয়ে সকলে মিলে ‘জুলাই ঘোষণা’র মাধ্যমে এই সংস্কার কার্যক্রমের প্রতি আমাদের সময়াবদ্ধ অঙ্গীকার ব্যক্ত করি।”

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আপনারা জানেন যে আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে আমরা জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি নিচ্ছি। পাশাপাশি স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও আইনের শাসন নিশ্চিত করার জন্য আমরা নিরবচ্ছিন্নভাবে নাগরিকবান্ধব সংস্কার চালিয়ে যাচ্ছি।’

ড. ইউনূস বলেন, ‘বিগত দেড় দশকের অভিজ্ঞতায় আমরা দেখেছি যে জবাবদিহি ছাড়া যেকোনো উন্নয়ন ক্ষণস্থায়ী ও ভঙ্গুর। রাজনৈতিক হীনস্বার্থ ও দুর্নীতির উদ্দেশ্যে গৃহীত অবকাঠামো প্রকল্প শুধু যে অর্থনীতির ওপরই চাপ বাড়ায় তা নয়, তা জনগণের কোনো কল্যাণও করে না। দায়িত্ব গ্রহণের পর আমরা একে একে আবিষ্কার করি দুর্নীতি ও জনগণের সম্পদ চুরি কি ব্যাপক বিস্তৃতি লাভ করেছিল এবং তার ফলে দেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক অবস্থা কি ভয়ানক নাজুক ও ভঙ্গুর হয়ে পড়েছিল। আমরা এর অবসান ঘটাচ্ছি যেন আর কখনোই উন্নয়নকে জনগণের সম্পদ আত্মসাতের অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করা না যায়। দেশের নাজুক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি মজবুত করতে আমরা সংস্কারমূলক কিছু কঠিন কিন্তু প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছি।’

কেএন/টিএ

Share this news on:

সর্বশেষ

img
সাকিবের অলরাউন্ড পারফরম্যান্সে আটলান্টার জয় Sep 27, 2025
img
কেন নেতানিয়াহুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু হতে পারেননি ওবামা? Sep 27, 2025
img
মুসলিম পর্যটকদের সুবিধার জন্য জাপানের শপিংমলে নামাজ কক্ষ Sep 27, 2025
img
দক্ষ মানুষ তৈরির পরিকল্পনা যারা করবে তাদের সন্তানরা দেশে পড়ালেখাই করে না: জামায়াত আমির Sep 27, 2025
img

সৈয়দা আশিফা আশরাফী পাপিয়া

‘কোমলমতি বাচ্চা থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত লেবাস ধরে থাকে জামায়াত-শিবির’ Sep 27, 2025
img
শ্রেয়াস আইয়ার বিষয়ে মুখ খুলল বিসিসিআই Sep 27, 2025
img
বিএনপিকে আদর্শিক দল হিসেবে মানুষ দেখতে চায় : আমীর খসরু Sep 27, 2025
img
কোহলি-রিজওয়ানকে ছাড়িয়ে রেকর্ড গড়লেন অভিষেক শর্মা Sep 27, 2025
img
নুরের অবর্তমানে গণ-অধিকার পরিষদের সভাপতির দায়িত্বে ফারুক Sep 27, 2025
img
প্রধান উপদেষ্টার প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানালেন বিশ্বনেতারা Sep 27, 2025
img
চলচ্চিত্র অঙ্গনে ফিরছেন পপি! Sep 27, 2025
img
বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টার সঙ্গে ইরাকের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাক্ষাৎ Sep 27, 2025
যে কারণে বিমানবন্দরে আটকে দেওয়া হলো সোহেল তাজকে Sep 27, 2025
img
আদালতের নির্দেশে শাহরুখ ও আরিয়ানের বিরুদ্ধে করা মামলা বাতিল Sep 27, 2025
img
পুঁজিবাজারে সাপ্তাহিক গড় লেনদেন কমেছে ১৭ শতাংশ Sep 27, 2025
img
নিষিদ্ধ করা এত সহজ হলে প্রথম দিনই আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হতো : মোস্তফা ফিরোজ Sep 27, 2025
img
জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব সীমিত করতে সুপ্রিম কোর্টে ট্রাম্পের শুনানির আবেদন Sep 27, 2025
img
আইন সবার জন্য সমান কি না - প্রশ্ন মাসুদ কামালের Sep 27, 2025
img
অভিষেককে দ্রুত আউট করার পরামর্শ শোয়েবের, পাল্টা খোঁচা অমিতাভপুত্রের Sep 27, 2025
img
কাউন্সিলরের পর এবার বিসিবির পরিচালক পদেও নির্বাচন করবেন আসিফ Sep 27, 2025