ক্ষুদিরাম: হাসিমুখে ফাঁসির কাষ্ঠে

ক্ষুদিরাম বসু, ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের এক অন্যতম বিপ্লবী সৈনিক। ব্রিটিশ বিরোধী সশস্ত্র কর্মকাণ্ডের অভিযোগে তার ফাঁসি হয়েছিল। তখন তার বয়স ছিল মাত্র ১৮ বছর ৮ মাস ৮ দিন।

তাকে ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের সর্বকনিষ্ঠ বিপ্লবী বলা হয়।

ক্ষুদিরাম বসু ১৮৮৯ সালের ৩ ডিসেম্বর পশ্চিম বঙ্গের মেদিনীপুর জেলার কেশপুর থানার অন্তর্গত মোহবনী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা নাড়াজোল প্রদেশের একজন তসিলদার ছিলেন।

বাবা ত্রৈলক্যনাথ এবং মা লক্ষী দেবীর ঘরে তিন মেয়ে সন্তানের পর একমাত্র ছেলে সন্তান ক্ষুদিরাম। তার আরও দুজন ভাই জন্মের পর মারা গিয়েছিল। তাই ক্ষুদিরামকে নিয়েও বাবা-মায়ের দুঃশ্চিন্তা বেড়ে যায়। ফলে মাত্র তিন মুঠি খুদের (শস্যের খুদ) বিনিময়ে তাকে তার বড় বোনের কাছে বিক্রি (প্রতীকি বিক্রি) করে দেন তার বাবা-মা। সেই থেকে তার নাম হয়ে যায় ক্ষুদিরাম।

মাত্র ছয় বছর বয়সেই ক্ষুদিরাম তার মাকে হারান। এর এক বছর পরই মারা যান তার বাবা। অসহায় ক্ষুদিরামকে তখন নিজ বাড়িতে নিয়ে আসেন বড় বোন অপরূপা। সেই থেকে তিনি বোনের কাছে বড় হন।

১৯০৪ সালে বোনের স্বামী অমৃত লালা রায় তাকে মেদেনীপুরে তামলুক হ্যামিল্টন হাই স্কুলে ভর্তি করে দেন।

কিশোর বয়সে ক্ষুদিরাম কিছুটা ডানপিটে স্বভাবের ছিলেন। তিনি তার শিক্ষক সত্যেন্দ্রনাথ বোসের নিকট হতে এবং শ্রীমদ্ভগবদগীতা পড়ে ব্রিটিশ উপনিবেশের বিরুদ্ধে বিপ্লব করতে অনুপ্রাণিত হন।

১৯০২-১৯০৩ সালে বিপ্লবী নেতা শ্রী অরবিন্দ ও সিস্টার-নিবেদিতা মেদিনীপুর ভ্রমণ করেন এবং জনসম্মুখে বৃটিশবিরোধী বক্তব্য রাখেন। সেখানকার স্বাধীনতাকামী বিদ্রোহী দলগুলোর সাথে বেশ কিছু গোপন বৈঠক করেন তারা।

তাদের উৎসাহে ক্ষুদিরাম বিপ্লবে যোগ দিতে অনুপ্রাণিত হন এবং কিশোর বয়সেই বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন।

অচিরেই তিনি অনুশীলন সমিতিতে যোগ দেন এবং কলকাতার বিপ্লবী নেতা বারীন্দ্র ঘোষের সংস্পর্শে আসেন।

পরে আরেক বিপ্লবী দল “যুগান্তর”এ স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ শুরু করেন ক্ষুদিরাম। এ সময় “সোনার বাংলা” শীর্ষক বিপ্লবাত্মক ইশতেহার বিলি করতে গিয়ে মাত্র ১৫ বছর বয়সেই তিনি গ্রেপ্তার হন।

ভারতের স্বাধীনতার দাবিতে কিশোর বয়সেই হাতে নিয়েছেন অস্ত্র। মাত্র ১৬ বছর বয়সে তিনি ব্রিটিশ কর্মকর্তাদের লক্ষ্য করে বিভিন্ন জায়গায় বোমা পুতে রাখতে অংশ নেন।

১৯০৭ সালে আরেক বিপ্লবী হেমচন্দ্র দাস কানুনগো প্যারিসে নির্বাসিত রাশিয়ান বিপ্লবী নিকোলাস সাফারস্কি এর কাছ থেকে বোমা বানানো শিখে আসেন।

এ সময় আলিপুরের প্রেসিডেন্সি কোর্টের চিফ ম্যাজিস্ট্রেট কিংস ফোর্ড এর আদালতে অনুশীলন সমিতির বেশ কয়েকজন বিপ্লবীর বিচার চলছিল। তাই বিপ্লবী হেমচন্দ্র দাস ও বারীন্দ্র ঘোষ কিংসফোর্ডকে হত্যার পরিকল্পনা করেন।

১৯০৮ সালের মার্চ মাসে কিংসফোর্ডকে হত্যার প্রথম প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। পরে তিনি আলীপুর থেকে মোজাফফরপুরে স্থানান্তর হন।

সেখানে ১৯০৮ সালের ৩ এপ্রিল তাকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। তরুণ বিপ্লবী ক্ষুদিরাম ও প্রফুল্ল চাকি পরিকল্পনা বাস্তবায়নের দায়িত্ব নেন।

তারা কিংসফোর্ডের গাড়ি লক্ষ্য করে হেমচন্দ্রের বানানো ৬ আউন্স ওজনের বোমা নিক্ষেপ করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সেদিন কিংসফোর্ড গাড়িতে ছিলেন না। ফলে গাড়িতে থাকা অন্য দুজন ব্রিটিশ নারী মারা যান।

এ সময় ব্রিটিশদের কাছে ধরা না দিতে আত্মহত্যা করেন প্রফুল্ল চাকি। তবে ক্ষুদিরাম ধরা পড়ে যান।

বিচারে তার মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। অথচ বয়সে তিনি ছিলেন একজন কিশোর মাত্র।

তাই ব্রিটিশ বিচারক কর্নডফ ক্ষুদিরামকে প্রশ্ন করেন, তাকে যে ফাঁসিতে মরতে হবে সেটা সে বুঝেছে কিনা? উত্তরে ক্ষুদিরাম মুচকি হাসেন। বিচারক পুনরায় একই প্রশ্ন করলে আবার তিনি মুচকি হাসি দিলেন।

১১ আগস্ট ১৯০৮, ভোর ছয়টা। ফাঁসির মঞ্চে উঠছেন নির্ভীক, অকুতোভয় ক্ষুদিরাম। তার মধ্যে নেই কোন মৃত্যু ভয়। অবশেষে হাসিমুখে বরণ করে নিলেন শহীদি মৃত্যু।

তার মৃত্যুতে বিপ্লবী চেতনায় জেগে ওঠে হাজারো তরুণ। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন হয়ে ওঠে আরও বেগবান। তিনি হয়ে গেলেন ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের এক অন্যতম পথিকৃৎ।

তাই বলা যায়, ক্ষুদিরাম মরে যায়নি। ক্ষুদিরামরা মরতে পারে না। যুগ যুগ ধরে মুক্তিকামী জনতার হৃদয়ে অমর হয়ে থাকবে একটি নাম- ক্ষুদিরাম।

 

ইন্টারনেট অবলম্বনে লিখেছেন এনামুল হক।

 

Share this news on:

সর্বশেষ

img
এনবিআরের আরও ৫ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুদকের অনুসন্ধান শুরু Jul 01, 2025
img
নির্বাচনে অর্থ বরাদ্দের ক্ষেত্রে কোনো কার্পণ্য করা হবে না : অর্থ উপদেষ্টা Jul 01, 2025
img
সরাসরি নগর স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম পরিচালনা করবে ডিএনসিসি Jul 01, 2025
img
উপদেষ্টা পরিষদ পুনর্গঠনের দাবি জানালেন নুর Jul 01, 2025
img
সেই একান্ত বৈঠকে কী বলেছিলেন প্রধান উপদেষ্টা, প্রকাশ করলেন সিইসি Jul 01, 2025
img
জুলাই নিয়ে আওয়ামী লীগের লোকজনের জ্বালা শুরু হয়েছে: ইলিয়াস হোসাইন Jul 01, 2025
img
গাজায় যুদ্ধ বন্ধ চান ট্রাম্প: হোয়াইট হাউজ Jul 01, 2025
img
ভারতে রাসায়নিক কারখানায় ভয়াবহ বিস্ফোরণে নিহত ৩৪ Jul 01, 2025
img
"১৬ জুলাই ‘শহীদ আবু সাঈদ দিবস’ ছিল, আমরা এটাই চাই" Jul 01, 2025
img
৫ মামলায় শেখ হাসিনাসহ ২৩ জনের হাজিরায় পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তির নির্দেশ Jul 01, 2025
img
জানি তোমাদের আশ্রয় দরকার নেই, তবুও আমরা আছি : আসিফ আকবর Jul 01, 2025
img
সামান্থার নতুন চমক, ফ্যাশন আইকন থেকে প্রযোজনায় নাম লেখালেন Jul 01, 2025
img
নাসির-তামিমার মামলায় আত্মপক্ষ সমর্থন শুনানি ১৪ জুলাই Jul 01, 2025
img
তিন ভাষায় তিন চরিত্র, বহুরূপী অভিনয়ে আসছে দুলকার সালমান Jul 01, 2025
img
২০৪০ জন শিক্ষার্থীকে দেওয়া হলো জুলাই শহীদ স্মৃতি বৃত্তি Jul 01, 2025
img
পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির নতুন তথ্য দুদকের হাতে Jul 01, 2025
img
সংস্কারবিহীন নির্বাচন জামায়াত গ্রহণ করবে না: মুহাম্মদ তাহের Jul 01, 2025
img
আমি কখনও নিজের তারকাখ্যাতিকে গুরুত্ব দেইনি: আর মাধবন Jul 01, 2025
img
বাণিজ্যিক সম্পর্ক জোরদারে বাংলাদেশ-চীনের মধ্যে কার্গো ফ্লাইট পরিচালনা শুরু Jul 01, 2025
img
টলিপাড়ায় ফের বিচ্ছেদ, ঘর ভাঙছে অভিনেত্রীর Jul 01, 2025