ব্রাজিলের বেলেমে নভেম্বরে আয়োজিত হচ্ছে ৩০তম বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন

পরিবেশ ও জলবায়ুবিষয়ক গবেষণা সংস্থাগুলো আভাস আভাস অনুযায়ী, এ বছরই প্রথমবারের মতো বিশ্বের তাপমাত্রা প্রাক-শিল্পযুগের চেয়ে ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়তি থাকবে। এমন ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকলে এ শতাব্দী শেষে বিশ্বের গড় তাপমাত্রা দাঁড়াবে সেই প্রাক-শিল্পযুগের চেয়ে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশিতে, যা জলবায়ু বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়াবে বলে আশঙ্কা পরিবেশ বিজ্ঞানীদের।

এমন আশঙ্কার মুখে ব্রাজিলের বেলেমে এ বছরের নভেম্বরে শুরু হতে যাচ্ছে জাতিসংঘ জলবায়ু সংস্থা (ইউএনএফসিসিসি) আয়োজিত ৩০তম বার্ষিক সম্মেলন বা কনফারেন্স অফ দ্য পার্টিস তথা কপ-৩০। যেখানে জড়ো হবেন বিশ্বনেতারা। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় করণীয় নিয়ে আলোচনা হবে এই সম্মেলনে।

এই সম্মেলনটি জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার অগ্রগতি পর্যালোচনা করার জন্য এবং বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমাবদ্ধ রাখার লক্ষ্য পূরণে নতুন জাতীয় পরিকল্পনা উপস্থাপন ও আর্থিক প্রতিশ্রুতির অগ্রগতির উপর আলোকপাত করার জন্য পরিচিত। এবারের সম্মেলনে ২০১৫ সালে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে অনুষ্ঠিত কপ-২১ সাক্ষরিত বিশ্ব জলবায়ু সনদ বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার সিদ্ধান্ত হবে। সে অনুযায়ী বৈশ্বিক তাপমাত্রা দেড় ডিগ্রির মধ্যে রাখার কৌশল নির্ধারণ হবে। সে অনুযায়ী অংশগ্রহণকারী দেশগুলো তাদের জলবায়ু কর্মপরিকল্পনা উপস্থাপণ করবে। অন্যদিকে জলবায়ু পরিকল্পনা বাস্তবায়নে উন্নত ও ধনী দেশগুলো তাদের আর্থিক প্রতিশ্রতির বাস্তবায়ন ও অগ্রগতির পর‌্যালোচনা তুলে ধরবে।

জলবায়ু বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তাই এই সম্মেলন বিশ্ব রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত। জলবায়ুকর্মী এবং তরুণরা এই সম্মেলনকে ঘিরে তাদের দাবি-দাওয়া তুলে ধরে। বৈশ্বিক জলবায়ু অগ্রগতির নতুন যুগের সূচনা: ব্রাজিলের সভাপতি আশা প্রকাশ করেছেন যে, কপ ৩০ সম্মেলন বৈশ্বিক জলবায়ু অগ্রগতির একটি নতুন যুগের সূচনা করবে।

বিশ্ব আজ এমন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত কেবল পরিবেশগত নয়, বরং অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করছে। বৈশ্বিক উষ্ণতা, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, চরম আবহাওয়া এবং জীববৈচিত্র্যের দ্রুত ক্ষয়-এসব কোনো দূর ভবিষ্যতের ভয় নয়, বরং আজকের বাস্তবতা। এই সংকটে যখন বিশ্ব নীতিনির্ধারকরা বারবার প্রতিশ্রুতি দিয়েও কার্যকর পদক্ষেপে পিছিয়ে পড়ছেন, তখন কনফারেন্স অব পার্টিজ (COP-৩০) হয়ে উঠছে এক নতুন আশার বাতিঘর।

সাম্প্রতিক দশকে বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা ১.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে, যা ১৮৫০-১৯০০ সালের তুলনায় অনেক বেশি। যদি এই প্রবণতা অব্যাহত থাকে, তাহলে শতকের শেষে এই উষ্ণতা ৩ ডিগ্রির বেশি বেড়ে যাবে, যা পৃথিবীকে এক ভয়াবহ বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দেবে। জলবায়ু পরিবর্তনের এই অভিঘাত সবচেয়ে বেশি অনুভূত হচ্ছে উন্নয়নশীল ও জলবায়ু-সংবেদনশীল দেশগুলোতে-যেমন বাংলাদেশ, মালদ্বীপ, নেপাল বা সাব-সাহারান আফ্রিকার অনেক দেশ।

বাংলাদেশের জন্য এই সংকট আরও তীব্র। উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততা বাড়ছে, কৃষিজ উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে, নদীভাঙনে বাসস্থান হারাচ্ছে হাজারো পরিবার। বিশ্বে জলবায়ু উদ্বাস্তুদের অন্যতম বৃহৎ অংশ এই বাংলাদেশ থেকেই উঠে আসছে।

অ্যামাজন অঞ্চলের শহর বেলেমে অনুষ্ঠিতব্য কপ-৩০ জলবায়ু সম্মেলন বিশ্ব রাজনীতিতে এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত হয়ে উঠতে পারে। প্রথমবারের মতো অ্যামাজনের মত একটি প্রাকৃতিক বনাঞ্চলকে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে এই বৈঠক। প্রতীকীভাবে এটি দেখায় যে, প্রকৃতির সুরক্ষা শুধু আলাপের বিষয় নয়-এখন তা হচ্ছে বাস্তব পদক্ষেপ নেওয়ার চূড়ান্ত সময়।

বাংলাদেশ ইতোমধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বেশ কিছু অগ্রণী পদক্ষেপ নিয়েছে-যেমন জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা (NAP), বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ড (BCCTF), এবং কমিউনিটি ভিত্তিক দুর্যোগ প্রস্তুতি। তবে আন্তর্জাতিক সহায়তা ছাড়া এগুলোর ধারাবাহিকতা বজায় রাখা কঠিন। কপ-৩০-তে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে জোরালোভাবে তুলে ধরা উচিত:

* আন্তর্জাতিক জলবায়ু তহবিল থেকে সহজ শর্তে এবং জরুরি ভিত্তিতে অর্থপ্রাপ্তির দাবি।
* জলবায়ু উদ্বাস্তুদের জন্য আলাদা আইনগত স্বীকৃতি।
* উন্নত বিশ্বের প্রযুক্তি হস্তান্তরের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের দাবি।
* সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসনের আন্তর্জাতিক সহায়তা।

জলবায়ু পরিবর্তনের মূল কারণ-বিশ্বব্যাপী কার্বন নির্গমনের বড় অংশ-এসেছে উন্নত দেশগুলো থেকে। অথচ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এমন দেশগুলো যারা এই নির্গমনের জন্য দায়ী নয়। এই বৈষম্য শুধরে নেওয়া এখন নৈতিক দায়িত্ব। কপ-৩০ এ উন্নত দেশগুলোর উচিত:

* ১০০ বিলিয়ন ডলারের বার্ষিক জলবায়ু অর্থায়ন তহবিল বাস্তবায়ন।
* জীবাশ্ম জ্বালানিতে ভর্তুকি বন্ধ করে নবায়নযোগ্য শক্তিতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি।
* কার্বন নির্গমন হ্রাসে বাধ্যতামূলক সময়সীমা নির্ধারণ।

প্রতিটি কপ সম্মেলন আমাদের আশাবাদী করে তোলে। কিন্তু গত কয়েক বছরের অভিজ্ঞতা বলছে-কথার চেয়ে কাজ জরুরি। কপ-৩০ শুধুই আরেকটি আন্তর্জাতিক বৈঠক হয়ে উঠলে চলবে না; এটি হতে হবে একটি পদক্ষেপমুখী, ন্যায়বিচারভিত্তিক বৈশ্বিক ঐক্যের প্ল্যাটফর্ম।বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর প্রতিনিধিত্ব যেন কেবল উপস্থিতিতে সীমাবদ্ধ না থাকে, বরং সিদ্ধান্ত গ্রহণের টেবিলে তাদের কণ্ঠস্বর শোনা যায়-এটা নিশ্চিত করতেই হবে। আমরা আশা করি, কপ-৩০ হবে ভবিষ্যতের জন্য একটি কার্যকর রোডম্যাপ তৈরির স্থান-যেখানে শুধুমাত্র প্রতিশ্রুতি নয়, থাকবে জবাবদিহিতা, বাস্তবায়ন, এবং একটি বাসযোগ্য পৃথিবীর জন্য সম্মিলিত প্রয়াস।

এবি/টিকে

Share this news on:

সর্বশেষ

img
৬৫ টন কাঁচা মরিচ এলো ভারত থেকে ! Oct 05, 2025
img
ছাত্রদলের এক নেতাকে সব পদ থেকে বহিষ্কার Oct 05, 2025
img
চীনে আঘাত হানল টাইফুন মাতমো Oct 05, 2025
img
তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে রাজউকের কঠোর নির্দেশনা Oct 05, 2025
img

মোস্তফা ফিরোজ

শেষ সময়েও হাসিনাকে রক্ষার আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন তোফায়েল আহমেদ Oct 05, 2025
img
কুয়েতে ৯ মাসে বহিষ্কার প্রায় ২৯ হাজার প্রবাসী ! Oct 05, 2025
img
নতুন পে স্কেলে বেতন কত বাড়তে পারে? Oct 05, 2025
img
মুলা, বেগুন মার্কা নির্বাচন কমিশনের রুচিবোধের প্রকাশ: সারজিস Oct 05, 2025
img
বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক আমদানি বৃদ্ধি পেয়েছে Oct 05, 2025
img

জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নে

নির্বাচনের দিন গণভোট চায় বিএনপি ও এনসিপি, আগে চায় জামায়াতে ইসলামী Oct 05, 2025
img
গ্রেপ্তারের পর কারাগারে পাঠানো হয়েছে অপূর্ব পালকে Oct 05, 2025
img
মশিউর সিকিউরিটিজের গ্রাহকদের উদ্দেশ্যে ডিএসইর বিশেষ বার্তা Oct 05, 2025
img

বিসিবি নির্বাচন

রাতের ভোটকে হার মানিয়ে ফেলেছে, বললেন নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানো রেদুয়ান Oct 05, 2025
img
খালাতো ভাইকে বিয়ে করেছিলেন, স্বীকার করলেন পরীমনি Oct 05, 2025
img
গণমাধ্যমের সঙ্গে ইসির সংলাপ সোমবার Oct 05, 2025
খেলাপি ঋণে ফাঁসছেন গ্যারান্টররা Oct 05, 2025
'জোর করে ইসরায়েলের পতাকায় চুমু খাওয়ানো হয়েছে থুনবার্গকে' Oct 05, 2025
রাজনৈতিক আঁতাতে উপদেষ্টাদের বিশ্বাসঘাতকতা: উদ্বিগ্ন নাহিদ ইসলাম Oct 05, 2025
img
ইন্দোনেশিয়ায় স্কুল ভবন ধসে প্রাণহানীর সংখ্যা বেড়ে ৪৫ Oct 05, 2025
img
জয়ের সেঞ্চুরিতে চট্টগ্রামের বিশাল জয়, বিদায় সিলেটের Oct 05, 2025