‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী’ ট্যাগের মাধ্যমে ভারতে ঘৃণা ছড়াচ্ছে বিজেপি

দশ বছরেরও বেশি আগে, যখন মুখতার আলম বিহার রাজ্যের একমাত্র মুসলিম-অধ্যুষিত জেলা কিশানগঞ্জের একটি সরকারি স্কুলে পড়তেন, তখন তাঁর হিন্দু বন্ধু ছিল।

আলম তাদের মধ্যে একজনের সঙ্গে বিশেষ ঘনিষ্ঠ ছিলেন। তারা একসঙ্গে পড়াশোনা করত, স্কুল প্রজেক্ট করত। আলম মাংস খাওয়া এড়িয়ে চলতেন, যাতে তার নিরামিষাশী বন্ধুটি অস্বস্তি না বোধ করেন।

কিন্তু দু’বছর আগে এক ঘটনায় তাদের বন্ধুত্বে ফাটল ধরে, যা এখনো মেরামত হয়নি।

বিহারের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দল বিজেপির সহযোগী জিতনরাম মাজি কিশানগঞ্জে এক নির্বাচনী জনসভায় বলেছিলেন, মুসলিম শেরশাহবাদি সম্প্রদায়ের লোকেরা ‘বাংলাদেশ থেকে আসা অনুপ্রবেশকারী’।

শেরশাহবাদি শব্দটি পশ্চিমবঙ্গের মালদহ-মুর্শিদাবাদ অঞ্চলকে নির্দেশ করে, যা ঐতিহাসিকভাবে ‘শেরশাহবাদ’ নামে পরিচিত। শের শাহ সুরি নামে এক আফগান শাসকের নামানুসারে এই নামের উৎপত্তি, যিনি ১৬শ’ শতকে মুঘলদের হারিয়ে বিহার ও বাংলার কিছু অঞ্চল (বর্তমান বাংলাদেশসহ) শাসন করেছিলেন।

বিহারে সাধারণভাবে ব্যবহৃত হিন্দি, উর্দুর পরিবর্তে শেরশাহবাদি মুসলমানরা বাংলা ভাষার একটি উপভাষায় কথা বলেন, যাতে হিন্দি ও উর্দুর শব্দও মিশে আছে। তাদের অনেক সময় বদিয়া বা ভাটিয়া বলে ডাকা হয় যা স্থানীয় ভাষায় ‘ভাটো’ (অর্থাৎ, নদীর স্রোতের উল্টো দিকে যাওয়া) শব্দ থেকে এসেছে, কারণ এই জনগোষ্ঠীর পূর্বপুরুষরা পশ্চিমবঙ্গের মালদা থেকে মুর্শিদাবাদ হয়ে গঙ্গার উজানে বিহারের সীমাঞ্চল এলাকায় এসেছিলেন।

“আমরা ওনাকে (মাঝির বক্তব্যকে) হুমকি মনে করেছিলাম,” বলেন ব্যবসা প্রশাসনের গ্র্যাজুয়েট মুখতার আলম।

তিনি চুপ থাকেননি, ফেসবুকে প্রতিবাদ পোস্ট করেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেখানে হিন্দিতে একটি মন্তব্য আসে, “তোমরা সবাই বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী।” এই মন্তব্যটি তার সবচেয়ে কাছের বন্ধুই করেছিলেন।

“মন্তব্যটি পড়ে আমার শরীর কেঁপে উঠেছিল,” বলেন ৩০ বছর বয়সী আলম। তিনি এখন একটি প্রাথমিক স্কুল চালান। “সেই মন্তব্য আমাদের বন্ধুত্বে ফাটল ধরায়। আমাদের মধ্যে বিশ্বাসের অভাব দেখা দেয়, ভাইয়ের মতো সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যায়।”

আলম বিহারে বসবাসকারী ১৩ লাখ শেরশাহবাদি মুসলমানের একজন, যা বিহার সরকারের ২০২৩ সালের জাতিগত শুমারি অনুযায়ী প্রকাশিত হয়েছে। তাদের বেশিরভাগই কিশানগঞ্জ ও কাটিহার জেলায় থাকেন।

ভারতের তৃতীয় জনবহুল রাজ্য বিহার যখন গুরুত্বপূর্ণ বিধানসভা নির্বাচনের দিকে এগোচ্ছে, তখন বিজেপি এই অঞ্চলে ‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী’ ইস্যুকে কেন্দ্র করে উচ্চস্বরে প্রচার চালাচ্ছে। নির্বাচন হবে দুটি ধাপে ৬ ও ১১ নভেম্বর, ফলাফল প্রকাশ ১৪ নভেম্বর।

শেরশাহবাদি মুসলমানদের টার্গেট কেন?

ভারতের স্বাধীনতা দিবসে (১৫ আগস্ট) প্রধানমন্ত্রী মোদি লালকেল্লা থেকে জাতির উদ্দেশে ভাষণে ঘোষণা করেন, অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করতে একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন জনমিতিক মিশন গঠিত হবে।

তিনি বলেন, “কোনো দেশই নিজেকে অনুপ্রবেশকারীদের হাতে তুলে দেয় না। ভারতই বা কেন দেবে?”

হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীগুলো প্রায়শই বিহার, পশ্চিমবঙ্গ ও আসামের বাংলা ভাষাভাষী মুসলমানদের বিরুদ্ধে ‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী’ শব্দটি ব্যবহার করে। আসামে (যেখানে বিজেপি ২০১৬ সাল থেকে ক্ষমতায়), সরকারের অভিযানে বহু বাঙালি মুসলমানকে বহিষ্কার করা হয়েছে  যাদের অনেকের ভারতীয় নাগরিকত্বের বৈধ কাগজ ছিল।

আসামে মুসলিম জনসংখ্যা রাজ্যটির মোট জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ভারতের মধ্যে সর্বোচ্চ।

বিহারে মুসলিম জনসংখ্যা ১.৭ কোটি, যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ১৭ শতাংশ। এর মধ্যে প্রায় ২৮.৩ শতাংশ মুসলমান সীমাঞ্চল অঞ্চলে (কিশানগঞ্জ, কাটিহার, আরারিয়া, পূর্ণিয়া) কেন্দ্রীভূত। এই অঞ্চল বাংলাদেশের খুব কাছেই অবস্থিত।

বিজেপি বিহারে কখনো এককভাবে সরকার গঠন করতে পারেনি সর্বদা জোটের মাধ্যমে শাসন করেছে। এখন নির্বাচন সামনে রেখে বিরোধীদের অভিযোগ, বিজেপি “বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী” ইস্যু ব্যবহার করে সীমাঞ্চলে ভোটারদের ধর্ম ও ভাষার ভিত্তিতে ভাগ করছে।

আতঙ্ক আরও বেড়েছে

গত দুই বছরে আলমের উদ্বেগ আরও বেড়েছে, কারণ প্রধানমন্ত্রী নিজেই তার সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে অভিযানে নেতৃত্ব দিচ্ছেন।

গত বছর পুর্নিয়ায় এক নির্বাচনী ভাষণে মোদি বলেন, “ভোট ব্যাংকের রাজনীতি সীমাঞ্চলকে অনুপ্রবেশকারীদের কেন্দ্র বানিয়ে ফেলেছে যার ফলে এই এলাকার নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়েছে।”

এ বছরও তিনি এই বক্তব্য বিভিন্ন জেলায় পুনরাবৃত্তি করেছেন। তিনি বলেন, “আজ সীমাঞ্চলসহ পূর্ব ভারতে বড় ধরনের জনসংখ্যাগত সংকট তৈরি হয়েছে অনুপ্রবেশকারীদের কারণে।

প্রতিটি অনুপ্রবেশকারীকে তাড়িয়ে দেওয়া হবে।”

‘বাংলাদেশ থেকে এসেছে দানবেরা’

বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলোতে “বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী” দমন অভিযান জোরদার করা হয়েছে। আসাম, গুজরাট, মহারাষ্ট্র ও দিল্লি থেকে অনেক বাঙালি মুসলমানকে বিতাড়িত করা হয়েছে যদিও তাদের অধিকাংশের বৈধ নাগরিকত্ব ছিল।

এ মাসের শুরুতে বিজেপির আসাম শাখা একটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ভিত্তিক ভিডিও প্রকাশ করে। যার শিরোনাম “বিজেপি ছাড়া আসাম”। ভিডিওতে বলা হয়, মুসলমানরা ৯০ শতাংশ হয়ে উঠবে এবং চা-বাগান, বিমানবন্দর, স্টেডিয়াম দখল করবে, গরুর মাংস খাওয়া বৈধ করবে।

সীমাঞ্চলের মুসলমানদের কাছে ‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী’ ইস্যুটি নতুন নয় বরং এটাই তাদের বিরুদ্ধে প্রধান অস্ত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এলাকাবাসীরা বলেন, বিজেপি সীমাঞ্চলকে ‘হিন্দুত্ব ল্যাবরেটরি’তে পরিণত করতে চাইছে যেভাবে গুজরাটে হয়েছিল মোদীর শাসনকালে।

কিছুদিন আগে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী গিরিরাজ সিং বলেন, “অনেক দানব বাংলাদেশ থেকে এসেছে আমাদের তাদের হত্যা করতে হবে।”

২০২৪ সালে এক “হিন্দু গর্ব মিছিল” আয়োজন করে, তিনি বারবার মুসলিম বিরোধী বক্তব্য দেন যার মধ্যে ছিল রোহিঙ্গা শরণার্থী, ‘লাভ জিহাদ’ ইত্যাদি।

তিনি বলেন, “যদি এই বদিয়া বা শেরশাহবাদি অনুপ্রবেশকারীরা আমাদের একবার চড় মারে, আমরা একত্রিত হয়ে তাদের হাজার চড় মারব।”

বিজেপির দাবি: এটা ভোটের রাজনীতি নয়

বিজেপির বিধায়ক হরিভূষণ ঠাকুর বলেন, “এটা কোনো মেরুকরণের রাজনীতি নয়। সীমাঞ্চলে মুসলিম জনসংখ্যা বাড়ছে অনুপ্রবেশের কারণে। সময়মতো ব্যবস্থা না নিলে আগামী ২০-২৫ বছরে সীমাঞ্চল বাংলাদেশ হয়ে যাবে।”

কিন্তু মুম্বাইয়ের টাটা ইনস্টিটিউট অফ সোশ্যাল সায়েন্সেস-এর সাবেক অধ্যাপক পুষ্পেন্দ্র (একক নাম) মনে করেন, এই মেরুকরণ তেমন প্রভাব ফেলবে না।

তিনি বলেন, “২০২৪ সালে ঝাড়খণ্ডের নির্বাচনেও এই ইস্যু আনা হয়েছিল কিন্তু কাজ হয়নি, কারণ অভিযোগের ভিত্তি নেই। সীমাঞ্চল তো আসলে বাংলাদেশের সঙ্গে সীমান্তও ভাগ করে না।”
কয়েক দশকের পুরনো প্রচারণা

ভারতে, বাংলাভাষী মুসলিমদের বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী বলে অভিযুক্ত করার অভিযানটি প্রথম শুরু হয়েছিল আসামে ১৯৭০-এর দশকের শেষের দিকে, যখন একটি স্থানীয় ছাত্র গোষ্ঠী তাদের অপসারণের দাবিতে রাস্তায় নেমেছিল। ফলস্বরূপ, হাজার হাজার মুসলিমকে হয় দেশ থেকে বহিষ্কার করা হয় বা "সন্দেহজনক" নাগরিক ঘোষণা করা হয়, যার ফলে তাদের আইনি অবস্থান স্থগিত হয়ে যায় এবং তারা নিপীড়নের শিকার হওয়ার ঝুঁকিতে পড়ে।

‘উদ্বেগ ও অনিশ্চয়তার অবস্থা’

এদিকে, শেরশাহবাদী মুসলিমদের বিরুদ্ধে বিজেপির প্রচারের সামাজিক প্রভাবও পড়েছে। উদাহরণস্বরূপ, কিশানগঞ্জে মুসলিমদের দ্বারা পরিচালিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিতে হিন্দু শিক্ষার্থীদের ভর্তির সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে।

গত এক দশক ধরে কিশানগঞ্জে একটি বেসরকারি স্কুল পরিচালনা করছেন তাফহীম রহমান, তিনি আল জাজিরাকে বলেন, “আজ, খুব কম হিন্দু পরিবারই তাদের সন্তানদের মুসলিম পরিচালিত স্কুলে পাঠায়।”

রহমান বলেন, এক দশক আগে যখন তিনি তাঁর স্কুল শুরু করেছিলেন, তখন প্রায় ১৬ শতাংশ শিক্ষার্থী ছিল হিন্দু। এখন তা মাত্র ২ শতাংশ।

তিনি আরও যোগ করেন, “আসলে, এমনকি ধনী মুসলিম পরিবারগুলিও এই স্কুলগুলি এড়িয়ে যাচ্ছে। ভাগ করে নেওয়া শিক্ষাক্ষেত্র থেকে এই নীরব প্রস্থান একটি আরও বিপজ্জনক পরিবর্তনের প্রতিফলন যা প্রতিদিনের জীবনে সাম্প্রদায়িক বিভাজনের একটি স্বাভাবিকীকরণ, যা নির্বাচনী রাজনীতির দ্বারা আকার পাচ্ছে এবং আরও গভীর হচ্ছে।”

সূত্র: আল জাজিরা

এমকে/টিকে

Share this news on:

সর্বশেষ

img
ফেসবুল পোস্টে কটাক্ষের শিকার শবনম ফারিয়া Oct 08, 2025
img
নাহিদকে পরিষ্কার করতে হবে, কারা সেফ এক্সিট চায়: রিজওয়ানা হাসান Oct 08, 2025
img
গুমের সঙ্গে জড়িতদের দায় ব্যক্তির, কোনো বাহিনীর নয়: চিফ প্রসিকিউটর Oct 08, 2025
img
উদ্ধার করা হলো তুষার-ঝড়ে আটকে থাকা শতাধিক এভারেস্ট আরোহীদের Oct 08, 2025
img
ডোনাল্ড ট্রাম্প চাইলেও হয়ত তার হাতে শান্তিতে নোবেল পুরষ্কারটি উঠেছে না! Oct 08, 2025
img
ইনজুরিতে মারুফা, পরের ম্যাচ খেলা নিয়ে অনিশ্চয়তা Oct 08, 2025
img
বঙ্গোপসাগরে পাঁচ দিন ধরে ভাসতে থাকা ২৬ জেলে উদ্ধার Oct 08, 2025
img
বরিশালের উজিরপুরে চোরের গাড়িচাপায় প্রাণ হারাল ১, আহত ২ Oct 08, 2025
img
সম্মান থাকতে রোহিতকে অবসর নেওয়ার পরামর্শ দিলেন তিওয়ারি Oct 08, 2025
img
পুলিশ জবাবদিহিতা কমিশনের সভা ৯ অক্টোবর Oct 08, 2025
img
এটাকে নির্বাচন বলা যাবে না, হাস্যকর ছাড়া আর কিছুই নয় : তামিম ইকবাল Oct 08, 2025
img
জনপ্রিয় গায়ক রাজবীর জওয়ান্দা আর নেই Oct 08, 2025
আদালতে হাজির সাবেক এমপি বুবলী, কেঁদে ফেললেন মেয়ে নাজা Oct 08, 2025
img
ঘরোয়া ক্রিকেট বর্জনের ঘোষণা দিলেন বিদ্রোহী সংগঠকরা Oct 08, 2025
img
শহিদুল আলমকে দেশে ফেরাতে ব্যবস্থা নিতে সরকারের প্রতি আহ্বান মির্জা ফখরুলের Oct 08, 2025
img
বিসিবি নির্বাচন স্থগিত না করায় ক্রিকেট বর্জনের ঘোষণা ৪৮ ক্লাবের Oct 08, 2025
img
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচন দেখতে চায়: আমীর খসরু Oct 08, 2025
img
রাউজানে গুলিতে নিহত হাকিম বিএনপির কেউ নয় : রিজভী Oct 08, 2025
img
মিষ্টি জান্নাতকে দেখা যাবে নতুন চলচ্চিত্রে Oct 08, 2025
img
বিসিবি সভাপতি হওয়ার একদিন পরই অস্ট্রেলিয়া গেলেন বুলবুল Oct 08, 2025