খুলনা বিভাগে প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের বদলি ও পদায়নের প্রক্রিয়ায় ঘুষ লেনদেনের অভিযোগ নতুন নয়—তবে সাম্প্রতিক সময়ে এটি যেন একপ্রকার ‘ওপেন সিক্রেট’-এ পরিণত হয়েছে। এসিল্যান্ড ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) পদে পদায়নের পেছনে লক্ষাধিক টাকা লেনদেনের অভিযোগ উঠেছে, যার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন সদ্য বিদায়ী বিভাগীয় কমিশনার মো. ফিরোজ সরকার।
২০২৪ সালের ১২ ডিসেম্বর খুলনা বিভাগীয় কমিশনার হিসেবে যোগ দেন মো. ফিরোজ সরকার। দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই তার বিরুদ্ধে প্রশাসনিক পদায়নে অনিয়ম ও ঘুষ বাণিজ্যের অভিযোগ উঠতে থাকে। মাত্র ১০ মাস ৩ দিনের দায়িত্বকালে তিনি নাকি খুলনা প্রশাসনে গড়ে তোলেন একটি অঘোষিত ‘পোস্টিং মার্কেট’—যেখানে একমাত্র মানদণ্ড ছিল, “টাকা দাও, পদায়ন নাও”।
অভিযোগ রয়েছে, এই পদায়ন বাণিজ্যে অর্থ লেনদেনের মূল সমন্বয়ক ছিলেন অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (রাজস্ব) মো. ফিরোজ শাহ।
জায়গা ভেদে বদলির ‘দর’
বিশ্বস্ত সূত্রের তথ্যমতে, ঘুষের অঙ্ক নির্ধারিত হতো স্থানভেদে। লাভজনক বা গুরুত্বপূর্ণ স্টেশনগুলোর জন্য দর ছিল বেশি। উদাহরণস্বরূপ, যশোর সদর উপজেলার এসিল্যান্ড পদে একজন কর্মকর্তাকে ১০ লাখ টাকা ঘুষের বিনিময়ে পদায়ন করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে—যা নিয়ে প্রশাসনের ভেতরে তোলপাড় শুরু হয়েছে।
“টাকা না দিলে পদ নেই”—চুয়াডাঙ্গা সদরে এসিল্যান্ড শূন্য
দীর্ঘদিন ধরে চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার এসিল্যান্ড পদটি শূন্য। বিভাগীয় কমিশনারের দপ্তর থেকে পাঁচ লাখ টাকা ঘুষ দাবি করা হয়েছিল বলে সূত্র জানিয়েছে। কোনো কর্মকর্তা অর্থ দিতে রাজি না হওয়ায় পদটি এখনো পূরণ হয়নি। ফলে ভূমি সংক্রান্ত জনসেবা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।
অভয়নগরে ইউএনও নিয়োগেও ঘুষের শর্ত
অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ যশোরের অভয়নগর উপজেলায় ইউএনও পদ দীর্ঘদিন ধরে শূন্য। একাধিক প্রার্থী অভিযোগ করেছেন, পছন্দের স্টেশন অভয়নগরে পদায়নের জন্য কমিশনার অফিস থেকে মোটা অঙ্কের ঘুষ দাবি করা হয়েছে। কেউ ঘুষ দিতে না চাওয়ায় ওই পদটি শূন্যই রাখা হয়েছে।
শ্রীধরপুর ইউনিয়নের কোদলা গ্রামের বাসিন্দা আবু কালাম বলেন,
“দীর্ঘদিন ইউএনও না থাকায় সরকারি ফান্ডের অর্থ বিতরণসহ নানা উন্নয়ন কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। সাধারণ মানুষ সরকারি সেবার জন্য কোথাও যেতে পারছে না।”
ইউনিয়ন পর্যায়েও অঘোষিত ‘ট্যারিফ সিস্টেম’
ঘুষ বাণিজ্য শুধু উপজেলা বা জেলা পর্যায়ে সীমাবদ্ধ নয়—ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা পদায়নেও চলছে অঘোষিত ‘ট্যারিফ সিস্টেম’।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ইকবাল হোসেন, ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা, ১ জুলাই ২০২৫ তারিখে ডুমুরিয়ার থুকড়া ইউনিয়ন থেকে যশোরের কেশবপুর উপজেলার পাঁজিয়া ইউনিয়নে বদলি হন। কিন্তু মাত্র ১৫ দিনের ব্যবধানে আবার দৌলতপুর ইউনিয়ন, দিঘলিয়া, খুলনায় বদলি হন—অভিযোগ রয়েছে, কমিশনার অফিসে অর্থ প্রদান করেই তিনি এ বদলি নিশ্চিত করেছেন।
একইভাবে নিলুফা ইয়াসমিন, আবদুল্লাহ আল মাহমুদ, মোস্তফা খায়রুজ্জামান ও সাখাওয়াত হোসেনসহ কয়েকজন ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তার বদলিতেও অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। একাধিক কর্মকর্তা দাবি করেছেন, এসব বদলির ‘ম্যানেজমেন্ট’ করেন কমিশনার অফিসের অফিস সহকারী রফিকুল ইসলাম।
‘অযৌক্তিক শর্ত’ না মানায় ইউএনও বদলি আটকে
খুলনার দিঘলিয়া ও সাতক্ষীরা সদর উপজেলার ইউএনওরা পারস্পরিক বদলির জন্য আবেদন করলেও, বিভাগীয় কমিশনার ‘অযৌক্তিক শর্ত’ আরোপ করে বদলির অনুমোদন দেননি। কর্মকর্তাদের দাবি, এসব শর্তের মূল উদ্দেশ্যও ছিল আর্থিক সুবিধা অর্জন।
প্রশাসনের স্বচ্ছতা প্রশ্নবিদ্ধ
খুলনা বিভাগের প্রশাসনিক কাঠামোয় এই ঘুষ বাণিজ্য সরকারের সুশাসন ও স্বচ্ছতা প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। প্রশাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমন দুর্নীতিগ্রস্ত পদায়ন প্রক্রিয়া জনসেবার মান ধ্বংস করে এবং সাধারণ মানুষের আস্থা নষ্ট করে দেয়।
কমিশনারের বক্তব্য
এই বিষয়ে জানতে চাইলে সদ্য বিদায়ী বিভাগীয় কমিশনার মো. ফিরোজ সরকার কোনো মন্তব্য দিতে রাজি হননি। তবে প্রশাসনের ভেতরে ও বাইরে তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলোর নিরপেক্ষ তদন্ত এখন সময়ের দাবি হয়ে উঠেছে।