রাজধানীর নিকুঞ্জ-২ এলাকায় অবস্থিত পেট্রোবাংলার রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি লিমিটেডের (আরপিজিসিএল) প্রধান কার্যালয় ও সংলগ্ন সিএনজি ফিলিং স্টেশনের চারপাশের ফুটপাত অবশেষে অবৈধ দখলমুক্ত করা হয়েছে।
প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দীর্ঘদিনের নীরবতা ও উদাসীনতার সুযোগে এই গুরুত্বপূর্ণ সরকারি স্থাপনাটির পাশে গড়ে ওঠা একের পর এক অবৈধ দোকান, চায়ের স্টল, হোটেল এবং খোলা রান্নার চুল্লি জননিরাপত্তা ও স্থাপনার সুরক্ষাকে গুরুতর ঝুঁকির মুখে ফেলেছিল।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীন আরপিজিসিএল ভবনে প্রতিদিন প্রায় ৩,০০০ পিএসআই (পাউন্ডস পার স্কোয়ার ইঞ্চ) চাপযুক্ত গ্যাস ব্যবহৃত হয়, যা সর্বোচ্চ আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী সংরক্ষণ করা আবশ্যক।
বিশেষজ্ঞদের মতে, উচ্চ চাপযুক্ত এই গ্যাস স্থাপনার পাশে ফুটপাত দখল করে খোলা আগুনে রান্নার চুলা ও তেলের চুল্লি বসানো ছিল অত্যন্ত বিপজ্জনক। সামান্য গ্যাস লিকেজ অথবা স্ফুলিঙ্গের সংস্পর্শ ঘটলে যেকোনো মুহূর্তে এখানে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটে যেতে পারত, যা কেবল স্থাপনাটি নয়, আশপাশের সরকারি অফিস ও ঘনবসতিপূর্ণ আবাসিক এলাকাকেও ধ্বংস করে দিতে পারত।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, বিগত দুই বছরে আরপিজিসিএল কর্তৃপক্ষ অন্তত তিনবার খিলক্ষেত থানায় লিখিতভাবে আবেদন করে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের অনুরোধ জানালেও, দুর্ভাগ্যবশত কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। বরং সময়ের সাথে সাথে দখলদারদের সংখ্যা বাড়তেই থাকে, যা স্থানীয় এলাকাবাসীর মধ্যে তীব্র ক্ষোভ ও উদ্বেগের জন্ম দেয়।
অবশেষে, স্থানীয়দের দীর্ঘ আন্দোলন এবং গণমাধ্যমের ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশের পর টনক নড়ে প্রশাসনের। খিলক্ষেত থানা পুলিশ আজ সোমবার সকালে এক উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করে। এই অভিযানে ফুটপাত দখল করে গড়ে তোলা সব দোকান, অস্থায়ী কাঠামো ও বিপজ্জনক রান্নার চুল্লি সম্পূর্ণরূপে ভেঙে ফেলা হয়।
খিলক্ষেত থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. সাজ্জাদ হোসেন এই প্রসঙ্গে বলেন, “জননিরাপত্তা নিশ্চিত করা আমাদের প্রধান দায়িত্ব। আমরা বিষয়টি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে বুঝেছি যে স্থাপনাগুলো বাস্তবেই বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি করছে। তাই প্রভাবশালী মহলের চাপের তোয়াক্কা না করে আমরা উচ্ছেদ অভিযান চালিয়েছি। ভবিষ্যতেও এ ধরনের অবৈধ দখলের বিরুদ্ধে আমাদের কঠোর অবস্থান অব্যাহত থাকবে।”
এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা ও সমাজকর্মী জাহিদ ইকবাল বলেন, “বছরের পর বছর ধরে আমরা এই ভয়াবহ প্রশাসনিক গাফিলতির বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলাম। একটি সরকারি গ্যাস স্থাপনার পাশে খোলা রান্নার চুলা জ্বালানো ছিল প্রশাসনিক উদাসীনতার চরম উদাহরণ। অবশেষে পুলিশের টনক নড়ায় আমরা স্বস্তি পেয়েছি, তবে যারা এই বিপজ্জনক পরিস্থিতি তৈরি করেছিল, সেই দায়ীদের শনাক্ত করে জবাবদিহি নিশ্চিত না হলে পুনরায় দখলের আশঙ্কা থেকেই যায়।”
স্থানীয়দের এখন মূল দাবি হলো, উচ্ছেদকৃত এই এলাকাটি যেন পুনরায় দখল না হয়— সেজন্য এটিকে ‘নূন্যতম নিরাপত্তা দূরত্ব জোন’ হিসেবে ঘোষণা করা হোক। পাশাপাশি, নিয়মিত পুলিশি টহল ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের নিরাপত্তা শাখা থেকে তদারকি নিশ্চিত করা জরুরি।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, এই উচ্ছেদ অভিযান কেবল একটি প্রশাসনিক পদক্ষেপ নয়, বরং এটি বহু বছরের অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে জনগণের জাগরণের ফল। তবে প্রশ্ন থেকেই যায়— কেন এতদিন প্রশাসন নীরব ছিল এবং কেন আগে এই বিপজ্জনক পরিস্থিতি রোধ করা হয়নি?
আজকের এই অভিযান জননিরাপত্তা ও জবাবদিহির একটি ইতিবাচক দৃষ্টান্ত বটে, তবে এর স্থায়ী সমাধান নির্ভর করছে পরবর্তী নজরদারি ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উপর জবাবদিহি নিশ্চিত করার ওপর। যদি দায়ীদের চিহ্নিত ও শাস্তির ব্যবস্থা না হয়, তাহলে পুনর্দখলের ছায়া আবারও ফিরে আসতে পারে এই গুরুত্বপূর্ণ জ্বালানি স্থাপনার প্রাচীর ঘেঁষে।
এসএন