‘‘বিগত সরকারের প্রধানমন্ত্রী জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করেছিলেন, ‘প্রথম আলো আওয়ামী লীগের শত্রু, গণতন্ত্রের শত্রু, দেশের মানুষের শত্রু।’ প্রথম আলোকে ধ্বংস করার, এর মালিকানা নিয়ে নেওয়া ও সম্পাদক বদলের কঠিন উদ্যোগও নেওয়া হয়েছিল। পরিহাস হলো, তিনি (শেখ হাসিনা) আজ দেশছাড়া, আর প্রথম আলো এখনো রয়ে গেছে দেশের মানুষের সবচেয়ে জনপ্রিয় কাগজ ও ডিজিটাল গণমাধ্যম হিসেবে। পেয়েছে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও।’’
দৈনিক প্রথম আলোর ২৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষকী আজ। এ উপলক্ষে এক লেখায় পত্রিকাটির কঠিন পথচলার কথা উল্লেখ করেছেন প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান। ‘নতুন দিনে সত্যই সাহস’ শিরোনামে এ লেখায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রসঙ্গও টেনেছেন তিনি।
প্রথম আলো-কে সব সময়েই, সব সরকারের আমলে, ক্ষমতাবানদের দমন-পীড়নের শিকার হতে হয়েছে বলে উল্লেখ করে মতিউর রহমান লিখেছেন, ‘১৯৯৮ সালের নভেম্বরে যাত্রা শুরুর পর ২০২৪ সাল পর্যন্ত ১০০টির বেশি মামলার মুখোমুখি হতে হয়েছে প্রথম আলোর সম্পাদক ও সাংবাদিকদের। বিগত সরকারের আমলে দেওয়া ৫২টি মামলার সুরাহা এখনো হয়নি। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেও মামলা রুজু হয়েছে একটি।’
এ প্রসঙ্গে প্রথম আলোর সম্পাদক আরও লেখেন, ‘‘বিগত সরকারের প্রধানমন্ত্রী জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করেছিলেন, ‘প্রথম আলো আওয়ামী লীগের শত্রু, গণতন্ত্রের শত্রু, দেশের মানুষের শত্রু।’ প্রথম আলোকে ধ্বংস করার, এর মালিকানা নিয়ে নেওয়া ও সম্পাদক বদলের কঠিন উদ্যোগও নেওয়া হয়েছিল। পরিহাস হলো, তিনি (শেখ হাসিনা) আজ দেশছাড়া, আর প্রথম আলো এখনো রয়ে গেছে দেশের মানুষের সবচেয়ে জনপ্রিয় কাগজ ও ডিজিটাল গণমাধ্যম হিসেবে। পেয়েছে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও।’’
দেশে সাংবাদিকতার চ্যালেঞ্জ প্রসঙ্গে মতিউর রহমান লেখেন, ‘‘স্বৈরাচারী শাসনের অবসানের পর গণমাধ্যমের জন্য মুক্ত, স্বাধীন, নির্ভয় পরিবেশ তৈরি হবে বলে যে আশা দেখা দিয়েছিল, বাস্তবে তার দেখা মেলেনি। বরং ফেক নিউজ, ব্যক্তিগত কুৎসা, সংবাদমাধ্যম কার্যালয়ের সামনে নজিরবিহীন বিশৃঙ্খলা এবং প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে ভীতি প্রদর্শন—বর্তমান সময়ে নির্ভীক সাহসী বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার পক্ষে মোটেই সহায়ক হয়নি। ‘আমি তোমার সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করতে পারি, কিন্তু তোমার মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য আমি জীবন দিতে প্রস্তুত’—১৯০৬ সালে ফরাসি দার্শনিক ভলতেয়ার-সম্পর্কিত বইয়ে ব্রিটিশ লেখক ইভেলিন বিয়াত্রিস যে উক্তি করেছিলেন, আমাদের দেশের বাস্তবতা তা থেকে যোজন যোজন দূরে। ‘তোমাকে বা তোমার মত আমি পছন্দ করি না, কাজেই আমি তোমাকে আক্রমণ করব’—এটাই যেন কোনো কোনো মহলের ঘোষিত ও চর্চিত পথ।’’
সাংবাদিকতায় চ্যালেঞ্জের বৈশ্বিক পরিস্থিতি বর্ণনা করতে গিয়ে মতিউর রহমান লেখেন, ‘সারা পৃথিবীতেই ঐতিহ্যবাহী সাংবাদিকতা আজ চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। মিথ্যা, গুজব, ফেক নিউজের ভিড়ে আসল তথ্য আলাদা করা বেশ কঠিন। নতুন প্রযুক্তির কল্যাণে যে কেউ যেকোনো খবর ছড়িয়ে দিতে পারেন, প্রতিটা স্মার্টফোন একেকটা চলন্ত টেলিভিশন প্রচারকেন্দ্র। নেতিবাচক শক্তিগুলো প্রকাশের অযোগ্য ভাষায় কুৎসা রচনা করে, সহিংস আক্রমণের প্ররোচনা দেয়; আবার খবরের মোড়কে, সাংবাদিকতার মুখোশের আড়ালে গুজব, মিথ্যা, ক্ষতিকর প্রচারণা চালায়। এটা শুধু বাংলাদেশের সমস্যা নয়, ইউরোপ-আমেরিকারও সমস্যা।’
এ প্রসঙ্গে প্রথম আলো সম্পাদক আরও লেখেন, ‘ঐতিহ্যবাহী সংবাদপ্রতিষ্ঠানগুলো এটাকেই সুযোগ বলে মনে করে, তারা জোরেশোরে বলে, এখনই সবচেয়ে বেশি দরকার সাংবাদিকতা, এখনই সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সত্য, অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন সত্য জানার জন্য বস্তুনিষ্ঠ সংবাদমাধ্যমের ওপর মানুষ ভরসা রাখে বেশি। অন্ধকার যেমন ছড়ি ঘুরিয়ে দূর করা যায় না, আলো জ্বালতে হয়, তেমনি ফেক নিউজের আঁধারের বিরুদ্ধে স্প্যানিশ ভাষার জনপ্রিয় উপন্যাসের চরিত্র সেই দোন কিহোতের মতো তরবারি চালিয়ে লাভ নেই, শুধু জ্বালাতে হবে সত্যের আলো।’
কেএন/টিকে