সিনিয়র সাংবাদিক মোস্তফা ফিরোজ বলেছেন, ‘সবাইকে সন্তুষ্ট রেখে সংকটের সমাধান করবেন, এমন আশাতেই এগিয়ে এসেছিলেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। কিন্তু রাজনৈতিক বাস্তবতা তাকে সেই সুযোগ দেয়নি। বিএনপি, জামায়াত কিংবা এনসিপি, কোনো পক্ষই এখন তার সিদ্ধান্তে সন্তুষ্ট নয়। যে ঐকমত্যের সেতুবন্ধ গড়ে তুলতে তিনি মাসের পর মাস চেষ্টা করেছেন, সেটাই আজ তার অগ্নিপরীক্ষার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
নিরপেক্ষতার ভারসাম্য রাখতে গিয়ে তিনি এখন পড়েছেন এক কঠিন দোটানায়। ডান দিকে গেলেও দোষ, বাঁ দিকে গেলেও দোষ, আর মাঝখানে থাকার আর কোনো পথ খোলা নেই।’
রবিবার (৯ নভেম্বর) নিজের ইউটিউব চ্যানেল ‘ভয়েস বাংলা’-তে মোস্তফা ফিরোজ এসব কথা বলেন।
মোস্তফা ফিরোজ বলেন, ‘ড. মুহাম্মদ ইউনূস সত্যিকার অর্থেই এখন এক কঠিন অগ্নিপরীক্ষার মুখে পড়েছেন।
তিনি কী করবেন, কাকে খুশি করবেন, কাকে অসন্তুষ্ট করবেন, এটা এখন বড় প্রশ্ন। যেখানে রাজনীতি ঘুরপাক খাচ্ছে বিএনপি ও জামায়াতকে ঘিরে, সেখানে কাউকেই উপেক্ষা করা সম্ভব নয়। জামায়াত ইতিমধ্যেই এখন আটদলীয় জোট গঠন করে আন্দোলন করছে, যা হয়তো নির্বাচনী জোটে পরিণত হবে।’
মোস্তফা ফিরোজ আরো বলেন, ‘ড. ইউনূস শুরুতে চেষ্টা করেছিলেন সবার সঙ্গে আলোচনা করে একটি ঐকমত্যে পৌঁছাতে।
তিনি (ড. ইউনূস) ভেবেছিলেন, এতে করে মেয়াদ শেষ হওয়া পর্যন্ত নির্বিঘ্নে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন। কিন্তু শেষ প্রান্তে এসে তিনি নিজেই আসামির আসনে বসেছেন। এনসিপিও তার প্রতি সন্তুষ্ট নয়; তারা মনে করছে, তাদের সঙ্গেও প্রতারণা করা হয়েছে। তাদেরও কিছু যুক্তি ও প্রত্যাশা ছিল। অন্যদিকে জামায়াত মনে করছে, ড. ইউনূস ও তার পরামর্শকরা বিএনপির দিকে হেলে গেছেন।
লন্ডনের বৈঠকও তারা ভালোভাবে নেয়নি। আবার বিএনপির অভিযোগ, ড. ইউনূস জামায়াতকে সমর্থন দিচ্ছেন।’
তিনি আরো বলেন, “সাত-আট মাস রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করেও ঐকমত্য কমিশনের কর্মকর্তারা এখন বড় দলগুলোর চোখে ‘ভিলেন’ হয়ে গেছেন। রাজনৈতিক দলগুলোকে সমঝোতায় আনতে তারা ব্যর্থ হয়েছে। বিএনপি প্রকাশ্যেই বলেছে, তাদের সঙ্গে সরকার ও ঐকমত্য কমিশন মিলে প্রতারণা করেছে। ফলে কমিশন কার্যত ব্যর্থ হয়েছে; এখন সব দায় এসে পড়েছে ড. ইউনূসের কাঁধে।”
মোস্তফা ফিরোজ বলেন, ‘এখন প্রশ্ন, তিনি কি সবাইকে খুশি রেখে কোনো সিদ্ধান্ত দিতে পারবেন? আসলে এই জটিল পরিস্থিতির জন্য অনেকাংশেই দায়ী ড. ইউনূস নিজেই। বাংলাদেশের রাজনীতি অত্যন্ত জটিল; এখানে রাজনৈতিক শক্তির বাইরে অন্য কেউ এই সংকট মীমাংসা করতে পারেনি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অভিজ্ঞতা দেখায়, তিন মাস পেরোলেই সরকার হিমশিম খায়। এমন পরিস্থিতি বিবেচনা করেই ড. ইউনূসের উচিত ছিল সুশীলা কার্কির মতো দৃঢ়ভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া, যে চার মাসের মধ্যেই নির্বাচন হবে, এক মাসের মধ্যে সংস্কার প্রস্তাব তৈরি করা হবে।
রাজনৈতিক দলগুলো যদি সংস্কার চায়, তারা করবে বাকি দায়িত্ব নির্বাচিত সংসদ নেবে। কিন্তু ড. ইউনূস সব দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নিলেন। একের পর এক কমিশন করলেন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নারী, প্রভৃতি নিয়ে আট-দশটি কমিশন। কিন্তু প্রত্যেক ক্ষেত্রেই বিরোধিতা দেখা দিল।’
তিনি আরো বলেন, “আওয়ামী লীগ অপসারিত হওয়ার পর ধর্মীয় উগ্র গোষ্ঠীগুলো সুযোগ নিয়ে ‘তৌহিদি জনতা’র নামে মাজার ভাঙা, দরগায় হামলা, এমনকি নুরাল পাগলার লাশ তুলে পুড়িয়ে ফেলার মতো উগ্রতা দেখিয়েছে। এমন একটি দেশে যেখানে তার নিজের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব বা অভিজ্ঞতা নেই, সেখানে এত বড় বড় কমিশন গঠন করে সময়ক্ষেপণ করা ছিল বড় ঝুঁকি, এখন তিনি তা বুঝতে পারছেন।”
মোস্তফা ফিরোজ বলেন, ‘এই দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়া উচিত ছিল না। সংকট যখন তৈরি হয়েছে, তখন দ্রুত নির্বাচনই ছিল একমাত্র সমাধান।অরাজনৈতিক বা অনির্বাচিত কোনো শক্তি দীর্ঘদিন টিকে থাকতে পারে না; রাজনৈতিক সংকটের সমাধানও রাজনৈতিক উপায়েই সম্ভব। এই জায়গাতেই ভুল করেছেন ড. ইউনূস। তাই এখন তিনি পড়েছেন সত্যিকার অর্থেই অগ্নিপরীক্ষার মুখে—ডান দিকে গেলেও দোষ, বাঁ দিকে গেলেও দোষ, মাঝখানে থাকার কোনো উপায় নেই।’
তিনি আরো বলেন, ‘এখন দেখার বিষয়, ড. ইউনূস কী সিদ্ধান্ত নেন। যদি তিনি শুরুতেই সুশীলা কার্কির মতো দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিয়ে চার থেকে ছয় মাসের মধ্যে নির্বাচন আয়োজনের রূপরেখা দিতেন, তাহলে আজকের পরিস্থিতি তৈরি হতো না। তখন একটি নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হতে পারত, যেখানে কোনো দলই প্রভাব বিস্তার করতে পারত না এবং পরবর্তীতে নির্বাচিত সংসদই সংস্কারের দায়িত্ব নিত। কিন্তু এখন জামায়াতের মনও পেলেন না, বিএনপির মনও পেলেন না, এমন অবস্থায় তার ব্যর্থতার আশঙ্কা বাড়ছে।’
মোস্তফা ফিরোজ বলেন, বিএনপি আপাতত সরকারের বিরুদ্ধে চরম অবস্থানে যেতে চাইছে না; তারা অনেক কিছুই উপেক্ষা করছে। কিন্তু সবাই তো এমন থাকবে না। বিএনপির নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদ ইতিমধ্যে বলেছেন, “সব কিছুর একটা সীমা আছে।” সেই সীমা অতিক্রম করলে বিএনপিও বসে থাকবে না। ফলে সামনে ড. ইউনূসের জন্য অপেক্ষা করছে এক কঠিন অগ্নিপরীক্ষা। তিনি এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবেন কি না—সেটি জানার জন্য এখন আর বেশি দিন অপেক্ষা করতে হবে না।
এমআর/এসএন