গোলাম মাওলা রনি

নো হাংকি-পাংকি! বাঁকা আঙুলে ঘি তোলার হুমকি!

হাংকি-পাংকি নিয়ে আমার অভিজ্ঞতা এতটাই নাজুক যে আজকের নিবন্ধে সেই অভিজ্ঞতা কিভাবে বলি তা নিয়ে ভাবছি। অন্যদিকে সোজা আঙুলে ঘি উঠবে না বুঝেছি এবার আঙুল বাঁকা করতে হবে এমনতরো হুমকি-ধমকি সারা জীবন শুনে আসছি। কিন্তু আমার বাবার জন্মেও কোনো রাজনৈতিক নেতার মুখে রাজনীতির মঞ্চে দাঁড়িয়ে ওসব কথা উচ্চারিত হতে শুনিনি। অথচ হাল আমলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এমনকি ঘটল যার কারণে প্রতিপক্ষকে পরাস্ত কিংবা অপদস্থ করার জন্য ওসব হাবিজাবি বলতে হচ্ছে?

রাজনীতিতে হম্বিতম্বি একটি অপরিহার্য কৌশল।

কিন্তু কোনো অবস্থায়ই হাংকি-পাংকি দিয়ে রাজনীতি হয় না কোনো দেশে হয়নি এবং আগামী দিনেও হবে না। হাংকি-পাংকির সঙ্গে রাজনীতির কি সম্পর্ক তা যদি বিস্তারিত জানতে চান, তাহলে আপনাকে কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে বর্ণিত গণিকা অধ্যায় পড়তে হবে। গণিকাবিষয়ক মন্ত্রী ও গণিকা মন্ত্রণালয় মৌর্য সাম্রাজ্যে কী কাজ করত তা যদি হাল আমলের হাংকি-পাংকি বক্তা করতে চান, তাহলে সেটা হয়তো ভিন্ন প্রসঙ্গ হতে পারে। আবার হাংকি-পাংকির সঙ্গে ঘিয়ের কি সম্পর্ক তা যদি মৌর্য বংশের তিন মহামতি যথা চন্দ্রগুপ্ত, বিন্দুসার ও অশোক দ্য গ্রেটকে জিজ্ঞাসা করা হতো, তাঁরা নির্ঘাত জ্ঞান হারাতেন।

সারা দুনিয়ায় ঘি একটি উচ্চ মাত্রার স্নেহজাতীয় পদার্থ। তেল মারাকে যদি তোষামোদির সঙ্গে তুলনা করা হয়, তাহলে এ ক্ষেত্রে ঘিয়ের ব্যবহার রীতিমতো রাজকীয় ব্যাপারস্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। কথায় কথায় হর্তাকর্তাদের তোষামোদ এবং মন্ত্রী-এমপিদের দালালরূপে আওয়ামী লীগ জামানায় একজন লোক এতটা কুখ্যাতি পেয়েছিলেন যে তাঁকে লোকজন ঘি বাবুল হিসেবে ডাকত। ঘি নিয়ে তোষামোদির ওই একটি উদাহরণই আমার জানা আছে।

কিন্তু বাংলা প্রবাদ-প্রবচনে যেভাবে আঙুল বাঁকা করে ঘি ওঠানোর কথা বলা হয়েছে তার সঙ্গে বাস্তব জীবনের শক্তিমত্তা প্রদর্শন-দাম্ভিকতা বা জোরজবরদস্তির কী মিল রয়েছে, তা আমার জানা নেই।

আগেই বলেছি ঘি একটি স্নেহজাতীয় পদার্থ। আমাদের দেশের শীতকালের তাপমাত্রায় ঘি জমে যায় এবং সেই ঘি তোলার জন্য আঙুল বাঁকা করতে হয়। অন্যদিকে বসন্ত, হেমন্ত ও শরতে ঘি অনেকটা দানাদার অবস্থায় থাকে, যখন আঙুল ঢুকালে এমনিতেই কিছুটা ঘি উঠে আসে। কিন্তু গ্রীষ্মকালে ঘি তেলের মতোই পাতলা থাকে এবং সে অবস্থায় আঙুল বাঁকা করলেও কাজ হয় না।

সুতরাং রাজনীতির উত্তপ্ত গ্রীষ্মকাল বা তাপপ্রবাহ যখন চলতে থাকে, তখন আঙুল বাঁকা করে লাভ হয় না, বরং উল্টো প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। গরম আবহাওয়ার সময় আমাদের দেশে যেমন বিয়ে-থা, আচার-অনুষ্ঠান কিংবা আনন্দ-ফুর্তি হয় না, তেমনি প্রকৃতি বিরূপ থাকলে রাজনীতিও জমে ওঠে না। ফলে আমাদের দেশে শরৎ, হেমন্ত, শীত ও বসন্তকালকে রাজনীতির পালাবদলের উত্তম সময় বিবেচনা করা হয়।

রাজনীতিতে প্রাকৃতিক আবহাওয়া, প্রকৃতি-পরিবেশ অর্থাৎ স্থান-কাল-পাত্র অত্যন্ত জরুরি। এখানে উপযুক্ত প্রতিপক্ষ না থাকলে মারামারি, হানাহানি, জুলুম-অত্যাচার মারাত্মকভাবে বাড়তে থাকে। প্রতিপক্ষ বা প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকলে রাষ্ট্রব্যবস্থা মুখ থুবড়ে পড়ে। ন্যায়বিচার, সুশাসন, নাগরিক অধিকার ইত্যাদি বিষয় নির্বাসনে চলে যায়। ফলে সমাজ-সংসার-রাষ্ট্রে ভয়াবহ অশান্তি ও বিপর্যয় দেখা দেয়। শরীর দুর্বল হলে যেভাবে রোগ-জীবাণু বাসা বাঁধে, তেমনি রাষ্ট্র দুর্বল হলে, ছোট মুখে বড় কথা ছাগলে চাটে বাঘের গাল ইত্যাদি উপসর্গ ততটাই প্রকট হয়ে পড়ে যে মানুষ বেঁচে থাকার আনন্দ হারিয়ে ফেলে। অনেকের মধ্যে বৈরাগ্য দেখা দেয়। কেউ কেউ দেশান্তরি হওয়ার জন্য ইতিউতি শুরু করে দেয়।

প্রকৃতি কখনো শূন্যতা সহ্য করতে পারে না। শূন্যস্থান পূর্ণ করতে গিয়েই প্রকৃতিতে কালবৈশাখী, মরুঝড় সাইমুম কিংবা সুনামি অথবা অগ্ন্যুৎপাতের ঘটনা ঘটে। বন্যা-নদীভাঙন, পঙ্গপালের আবির্ভাব ইত্যাদি প্রাকৃতিক বির্যয়ের পেছনে থাকে শূন্যতা। সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় শূন্যতা থাকলে চুরি-ডাকাতি-গুণ্ডামি-রাহাজানি-টাউটারি-বাটপাড়ি অনিবার্য হয়ে পড়ে। শূন্যতার কারণেই ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প উৎপাদন, নতুন বিনিয়োগ মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হয় এবং একটি ধনী রাষ্ট্রও কয়েক মাসের মধ্যেই দেউলিয়া হয়ে পড়ে।

সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় অসংখ্য বিষয়ের শূন্যতা ঘটতে পারে। মেধা, মননশীলতা, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিচর্চার অভাব যেসব শূন্যতা সৃষ্টি করে অথবা ন্যায়বিচার, সুশাসন, গণতন্ত্রের চর্চা ইত্যাদির ঘাটতি থাকলে মানুষ যেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় তা রীতিমতো গজবে পরিণত হয়, যখন রাজনীতিতে শূন্যতা তৈরি হয়। রাজনীতির শূন্যতার কারণে যুদ্ধ-বিগ্রহ-মারামারি-হানাহানি-দুর্ভিক্ষ ইত্যাদি যত দ্রুত একটি দেশকে রসাতলে নিয়ে যায় তা অন্য কোনো প্রাকৃতিক শূন্যতা ঘটাতে পারে না।

আমাদের দেশের রাজনৈতিক বিপর্যয় শুরু হয়েছিল ২০০৭ সালে ১/১১-র মাধ্যমে। তখনকার দৈত্যরা যেসব জুলুম-নির্যাতনের পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছিল এবং যেভাবে দেশের শিল্পী-সাহিত্যিক-ব্যবসায়ী-বুদ্ধিজীবীকে রাষ্ট্রের প্রতিপক্ষ বানিয়ে মানুষের মেরুদণ্ডে আঘাত করেছিল তার ফলে অতি অল্প সময়ের মধ্যে রাষ্ট্রের মেরুদণ্ড ভেঙে যায়। ১/১১-র কুশীলবরা পালিয়ে যায় এবং রাজনৈতিক বন্দোবস্ত চালু হলে তা আবার হুমকির মুখে পড়ে ২০১৫ সালে রাজনীতির নামে হাংকি-পাংকি করার অভিলাষের মাধ্যমে। পরবর্তী ১০ বছরে যেভাবে রাজনীতির ময়দানের ক্ষমতাধররা প্রতিপক্ষের মেধা, মননশীলতা, সাহস ও শক্তির ওপর কুঠারাঘাত করেছে তার ফলে রাজনীতির ময়দানে রীতিমতো বুদ্ধি-বিবেক, সৌজন্য-ভদ্রতা-নম্রতার মড়ক শুরু হয়। একে একে হারিয়ে যেতে থাকেন বড় বড় রাজনীতিবিদ। কেউ কেউ মরে গিয়ে শূন্যতা তৈরি করেন আবার অনেকে চুপ থেকে শূন্যতা পয়দা করতে থাকেন। অনেকে আবার তাপে-চাপে, অর্থলোভে ক্ষমতার কাছে নিজেদের বিকিয়ে দিয়ে নিজেরা মোনাফেকি, আত্মপ্রবঞ্চনা, রাজনৈতিক ধোঁকাবাজি, বিশ্বাসঘাতকতার এক বিরল নিন্দিত উদাহরণ তৈরি করে পুরো ময়দানকে অনুর্বর, ঊষর ও বিরানভূমিতে পরিণত করেন।

উল্লিখিত ধারাবাহিক কর্মকাণ্ডের কারণে আমাদের দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে কি পরিমাণ শূন্যতার তৈরি হয়েছে এবং সেই শূন্যতার কারণে মানুষের প্রাণবায়ু কিভাবে কণ্ঠনালিতে চলে এসেছে, তা দেশের আঠারো কোটি মানুষ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। গত চৌদ্দ মাসে যা দেখেছি, যা শুনেছি এবং যা ঘটেছে তা আমাদের কতটা ক্ষতিগ্রস্ত করেছে তা হিসাব-নিকাশের চেয়ে চলমান বন্ধ্যাত্ব আমাদের আগামী দিনে কতটা রসাতলে নিয়ে যাবে সেই আতঙ্কে মানুষের ঘুম হারাম হয়ে গেছে।

দীর্ঘদিনের পক্ষাঘাতগ্রস্ত মানুষ যদি হঠাৎ দৌড় দেওয়ার চেষ্টা করে, বধির যদি ভান করে যে সে সব কিছু শুনছে অথবা অন্ধ যদি ব্যস্ত সড়কে চক্ষুষ্মাণের মতো দৌড় দেওয়ার চেষ্টা করে, তাহলে যে ধরনের পরিণতি ঘটে ঠিক তার চেয়েও ভয়াবহ পরিণতি ঘটে যদি রাজনীতিবিদের মেরুদণ্ড নষ্ট হয়ে যায়। নষ্ট মেরুদণ্ড নিয়ে বড়জোর বিষাক্ত সর্প হওয়া সম্ভব, কিন্তু কিয়ামত হয়ে গেলেও জুলিয়াস সিজার বা নেপোলিয়ন বোনাপার্ট হওয়া সম্ভব নয়।

রাজনৈতিক শূন্যতার সমূহ বিপদ হলো এখানে ঘসেটি বেগমরা সুযোগ পেলে জোয়ান অব আর্ক হয়ে হুংকার দেয়। মীরজাফরের দল রবার্ট ব্রুস অথবা মহাবীর হ্যানিবলের মতো হৈ-হুল্লোড় শুরু করে। উমিচাঁদ-জগেশঠরা দাতা হাতেম তাঈ, হাজি মুহম্মদ মুহসীন কিংবা খলিফা উমর ইবনে আবদুল আজিজ (দ্বিতীয় উমর) হয়ে যায়। আবদুল্লাহ বিন উবাইয়ের মতো মোনাফেক, মুসায়লামাতুল কাজ্জাবের মতো মিথ্যাবাদী, ভণ্ড, চেঙ্গিস খান, হালাকু খানের মতো অত্যাচারীরা হঠাৎ মানবতার ফেরিওয়ালা হয়ে মানবসমাজে দাজ্জালের মতো ফিতনা তৈরি করে ফেলে।

মানবজাতির ইতিহাসের ১০ হাজার বছরের রাজনৈতিক উপাখ্যানে যতবারই কোনো রাষ্ট্র রাজনৈতিক শূন্যতার কবলে পড়েছে, তখন সেই ভূখণ্ডের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব চলে গেছে। সভ্যতার সব নিদর্শন এমনভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে, যা পরবর্তীকালে আর উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। সিন্ধু ও মহেঞ্জোদারোর সভ্যতা ধ্বংস, পার্সিপোলিশ, গুরগাও কিংবা কার্থেজ নগরীর ধ্বংসের ইতিহাসের সঙ্গে রাজনীতির শূন্যতার কী সম্পর্ক তা যদি কলিকালের রাজনীতিবিদরা জানতেন, তাহলে ভুলেও রাজনীতির মঞ্চে দাঁড়িয়ে হাংকি-পাংকির কথা চিন্তা করতেন না কিংবা আঙুল বাঁকা করে রাজনীতির ঘি মন্থন করার কথা বলতেন না।

এমকে/এসএন

Share this news on:

সর্বশেষ

img
গণঅভ্যুত্থানে চানখারপুলে ৬ জনকে হত্যার মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ আজ Nov 12, 2025
img
ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ Nov 12, 2025
img
ভোট চাইতে গিয়ে কৃষকের ধান কেটে দিলেন মুফতি আমির হামজা Nov 12, 2025
img
নির্বাচনকে ঘিরে চরম অনিশ্চয়তা তৈরি হচ্ছে: জিল্লুর রহমান Nov 12, 2025
img
গুজবকে পেছনে ফেলে হাসপাতাল থেকে হাসিমুখে বাড়ি ফিরলেন ধর্মেন্দ্র Nov 12, 2025
img
নতুন অ্যালবাম ‘ভাল লাগে না’ নিয়ে ব্যস্ত শায়ান চৌধুরী অর্ণব Nov 12, 2025
img
৪৪তম বিসিএসের নতুন ফল প্রকাশ, উত্তীর্ণ ১৬৭৬ জন Nov 12, 2025
img
উদ্বোধনের কয়েক মাস পরই ধসে পড়ল চীনের হংকি সেতু Nov 12, 2025
img
অনশনের কারণে কিডনিতে জটিলতা, লাগবে ডায়ালাইসিস: তারেক Nov 12, 2025
img
সম্ভাব্য মার্কিন হামলা ঠেকাতে গেরিলা যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে ভেনেজুয়েলা Nov 12, 2025
img
বরিশাল বিভাগে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ১৮ হাজার ছাড়িয়েছে, মৃত্যু ৪৪ জনের Nov 12, 2025
img
তাইজুল-হাসানের জাদুতে ‘১৫ মিনিটে’ অলআউট আয়ারল্যান্ড Nov 12, 2025
img
হঠাৎ অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি গোবিন্দ Nov 12, 2025
img
গাজীপুরে এক রাতে ৩ বাসে আগুন Nov 12, 2025
img

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন

মির্জা ফখরুলের বক্তব্য জুলাইয়ের অবদানের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা Nov 12, 2025
img
আজও ঢাকায় দুপুর পর্যন্ত তাপমাত্রা অপরিবর্তিত Nov 12, 2025
img
আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ঢাকা ও আশপাশের জেলায় বিজিবি মোতায়েন Nov 12, 2025
img
ওয়ানডে ফরম্যাটে আবারও সুপার লিগ চালুর সিদ্ধান্ত আইসিসির Nov 12, 2025
img
টাঙ্গুয়ার হাওরে অভিযান, ৫ লাখ টাকার জাল জব্দ Nov 12, 2025
img
নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল, আটক ৩ Nov 12, 2025