ইতিহাসে বিচারের মুখোমুখি হওয়া রাষ্ট্রপ্রধানরা

গত বছর জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে করা মামলার রায় ঘোষণা করা হবে আজ। তবে, ইতিহাসে তিনি একমাত্র ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী নন, রয়েছেন এমন অনেক ক্ষমতাচ্যুত সরকারপ্রধানরা। চলুন দেখে নেয়া যায় বিচারের মুখোমুখি হওয়া রাষ্ট্রপ্রধানদের পরিণতি।

নিকোলাই চচেস্কু
ষাটের দশকে ঠাণ্ডা যুদ্ধ যখন তুঙ্গে, পূর্ব ইউরোপ তখন সোভিয়েত ইউনিয়নের হাতের মুঠোয়। তখন এক রাষ্ট্রনেতা রুখে দাঁড়িয়ে ঘোষণা দিলেন, মস্কোর খবরদারি আর চলবে না। কমিউনিস্ট হয়েও, হাটলেন সংস্কারের পথে। দেশের মানুষ ভাবলো, এবার বুঝি মুক্তি আসছে। পশ্চিমারাও দারুণ খুশি, নতুন এক হিরো পেয়ে। কিন্তু সেই ‘হিরো’ সবার চমকে দিয়ে বনে যায় ভয়ঙ্কর এক ভিলেন। ইতিহাসের অন্যতম বিভীষিকাময় স্বৈরশাসক। সেই নেতার নাম নিকোলাই চচেস্কু।

চচেস্কু ১৯৬৫ সালে ক্ষমতায় আসেন। কয়েক বছরের মধ্যেই ক্ষমতা তাকে পরিবর্তন করতে শুরু করে। ১৯৭১ সালে উত্তর কোরিয়া এবং চীন সফরে গিয়ে কিম ইল সুং ও মাও সেতুং-এর শাসনধারা দেখে তিনি প্রভাবিত হন। এরপর রোমানিয়ায়ও একই ধরনের কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা ও কঠোর নিয়ন্ত্রণ চালু করেন। নিজের এবং স্ত্রী এলেনার পক্ষে ব্যক্তিপূজা শুরু হয়—স্কুলের বই থেকে শুরু করে শহরের বিশাল মূর্তি পর্যন্ত সব জায়গায়।

দেশের গোয়েন্দা সংস্থা ‘সিকিউরিটেট’ ছিল তার সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। জনসংখ্যার প্রতি ৪৩ জনের একজন এজেন্ট বা ইনফর্মার ছিলেন। তারা শুধু ফোন, চিঠি বা কথোপকথনই নজরদারি করত না, পরিবারের সদস্যদের ওপরও নজর রাখত। ডাক্তাররা রোগীদের গোপনে রেকর্ড করতে বাধ্য হন, শিশুরা স্কুলে কী বলছে তা রিপোর্ট করা হতো। এর ফলে দেশজুড়ে ভীতিকর পরিবেশ তৈরি হয়।

অর্থনীতিও পরিস্থিতি আরও খারাপ করেছিল। চচেস্কু ব্যয়বহুল উন্নয়ন প্রকল্পে বিপুল ঋণ নেন, কিন্তু প্রকল্পগুলো প্রায় কোন কাজের ফল দেয়নি। ঋণ শোধ করতে কৃষিপণ্য রপ্তানি বাড়ালে দেশের মানুষ খাদ্য ও জ্বালানি সংকটে পড়ে। সাধারণ মানুষ প্রতিদিন রুটির জন্য লম্বা লাইনে দাঁড়াত, কিন্তু চচেস্কু নির্বিকার থাকতেন।

১৯৮৯ সালের ডিসেম্বর, টিমিসোয়ারা শহরে এক পাদ্রী লাস্লো টোকেশ ধর্মীয় স্বাধীনতার দাবি তোলেন। তাকে গ্রেপ্তার করলে জনতা ক্ষুব্ধ হয়। ১৫ ডিসেম্বর তারা সড়কে নামলে পুলিশি নিপীড়ন শুরু হয়। তাতেই আন্দোলন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে, সাধারণ মানুষ কমিউনিস্ট শাসনের বিরুদ্ধেই প্রতিবাদ শুরু করে। সেনারা গুলি চালাতে অস্বীকৃতি জানায়, বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে রাজধানী বুখারেস্টেও।

২১ ডিসেম্বর, চচেস্কু পরিস্থিতি সামলাতে বিশাল জনসভা ডাকেন। কিন্তু বক্তব্য শুরু হতেই জনতা স্লোগান দিতে শুরু করে। রাষ্ট্র টিভি হঠাৎ সম্প্রচার বন্ধ করে দেয়। এরপর ২২ ডিসেম্বর, আরও বড় ঢলে বুখারেস্টের রাজপথ পূর্ণ হয়। সেনারা জনগণের পাশে দাঁড়ায়। চচেস্কু বাসভবনে অবস্থান করলে জনতা ইট-পাটকেল ছুঁড়ে প্রতিবাদ জানায়। অবশেষে তিনি এবং এলেনা হেলিকপ্টারে পালান, কিন্তু ধরা পড়েন।

২৫ ডিসেম্বর, উৎসবের দিন। চচেস্কু এবং এলেনাকে বুখারেস্টের এক সামরিক ঘাঁটিতে নেয়া হয়। সেখানে তড়িঘড়ি সামরিক আদালত বসানো হয়। তিনটি অভিযোগ আনা হয় তাদের বিরুদ্ধে: গণহত্যা, অর্থনীতি ধ্বংসের ষড়যন্ত্র, ও রাষ্ট্রের সম্পদ অপচয়। চচেস্কু-এলেনা বিচারকদের ভর্ৎসনা করে দাবি করেন, সব বিদেশি চক্রান্ত, তারা এখনও রোমানিয়ার বৈধ শাসক। তবে তাতে কেউ কান দেয়নি, কারণ এটা ছিল আনুষ্ঠানিকতা মাত্র, রায় তো আগে থেকেই নির্ধারিত; যার উদ্দেশ্য জনগণের প্রতিশোধের মনোভাবকে প্রশমিত করা।

দুই ঘণ্টায় শেষ হয় বিচারকাজ। দুজনকেই মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই কয়েকজন সেনা সদস্য সেই রায় কার্যকরও করে ফেলেন। কথা ছিলো হত্যার দৃশ্য সরাসরি টিভিতে সম্প্রচার হবে। কিন্তু উত্তেজনায় ক্যামেরার জন্য অপেক্ষা না করেই গুলি চালিয়ে দেয় সেনারা। দুজনের শরীরে ১২০টি গুলির চিহ্ন পাওয়া যায়। তাদের গুলিবিদ্ধ লাশের দৃশ্য ফলাও করে প্রচার হয় রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে।

এই বিচার ও মৃত্যুদণ্ডের পদ্ধতি নিয়ে সমালোচনা আছে, বিশেষ করে পশ্চিমা দেশগুলিতে। তাদের মতে, চচেস্কুর বিচার আরও দীর্ঘ এবং আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন হওয়া উচিত ছিল। তবে রোমানিয়ার সাধারণ মানুষের কাছে এটি ছিল ন্যায়সঙ্গত প্রতিশোধ। দীর্ঘদিনের দমন-পীড়ন, দুর্নীতি, এবং অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের প্রতিফল হিসেবে চচেস্কু এবং তার স্ত্রীর মৃত্যুদণ্ডকে তারা যৌক্তিক ও জরুরি বলে মনে করেছিলেন।

সাদ্দাম হোসেন
২০০৬ সালের নভেম্বর মাসে ন'মাসব্যাপি বিচারের পর মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত হয়েছিলেন ইরাকের ক্ষমতাচ্যুত শাসক সাদ্দাম হোসেন। ইরাকে ২০০৩ সালে মার্কিন নেতৃত্বাধীন অভিযানের সময় ক্ষমতাচুত হন সাদ্দাম হোসেন, আর তিনি মার্কিন সৈন্যদের হাতে ধরা পড়েছিলেন তারও প্রায় আট মাস পর।

বাগদাদের এক আদালতে অনুষ্ঠিত হয় তার বিচার । এই বিচারের সাদ্দাম হোসেনকে আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য যে আইনী দল দেয়া হয়েছিল - তার অংশ ছিলেন আমেরিকান র‍্যামজি ক্লার্ক।
সাদ্দাম হোসেনের বিচার হয় শিয়া-প্রধান শহর দুজাইলের এক হত্যাকান্ডের জন্য - যাতে নিহত হয়েছিলেন ১৪৮ জন লোক। ১৯৮২ সালে সাদ্দাম হোসেনকে হত্যার এক ব্যর্থ প্রচেষ্টার পর এই ঘটনা ঘটেছিল।

অবশেষে, ২০০৬ সালের ৫ই নভেম্বর সাদ্দাম হোসেনকে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের দায়ে দোষী সাব্যস্ত করা হয়, এবং ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়। তাকে আপীলের অধিকার দেয়া হয়েছিল কিন্তু সে আপীল প্রত্যাখ্যাত হয়, মৃত্যুদন্ড বহাল থাকে। মৃত্যুদন্ড কার্যকর হয় ২০০৬ সালের ডিসেম্বরের ৩০ তারিখ।

হোসনি মোবারক
মিশরের সাবেক প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারক, যিনি তিন দশকের শাসনামালে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও ব্যাপক লুটপাটের অভিযোগে দীর্ঘ ‘নিষ্ফল’ বিচার প্রক্রিয়া শেষে মুক্তি পান। মোবারকের বিরুদ্ধে অনেক গুরুতর অভিযোগ আনা হলেও ছোটোখাটো একটি দুর্নীতি মামলাতেই শুধু তার সাজা হয়েছে।

প্রথম আরব নেতা হিসেবে দেশের সাধারণ আদালতে বিচারের মুখোমুখি হওয়ার সময় মোবারককে প্রাথমিকভাবে কুখ্যাত টোরা কমপ্লেক্সে বন্দি হিসেবে রাখা হয়েছিল। এরপর তাকে মাদি সামরিক হাসপাতালে নেওয়া হয়। তার বিরুদ্ধে তাহরির স্কয়ারে বিক্ষোভে পুলিশ দিয়ে ২৩৯জন আন্দোলনকারীকে হত্যা, রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে কয়েক মিলিয়ন ডলার লুট, ২০১১ সালের বিক্ষোভের সময় পুরো দেশের ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার মতো গুরুতর অভিযোগ ছিল।

হিসেন হাব্রে
আফ্রিকান রাষ্ট্র শাদ (চাদ)-এর স্বৈরাচারী শাসক হিসেন হাব্রে’র মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য ২০১২ সালে সেনেগাল ও আফ্রিকান ইউনিয়নের মধ্যকার চুক্তির মাধ্যমে সেনেগালে প্রতিষ্ঠিত হয় এক্সট্রাঅর্ডিনারী আফ্রিকান চেম্বারস। ২০১৫ সালে হিসেন হাব্রে’র বিচার শুরু হয় এবং ২০১৭ সালের এপ্রিল মাসে তাকে দোষী সাব্যস্ত করে আদালত রায় দেন।
তবে, ইতিহাস সাক্ষী দেয় এমন বহু শাসক ছিলেন যারা দেশ ছেড়ে পালিয়ে গিয়ে অন্যদেশে আশ্রয় নিয়েছেন। তাদের বিচার হয়নি কিংবা নির্বাসনেই মারা গিয়েছেন।

নেতাদের পালিয়ে যাওয়া বা নির্বাসন
ইউক্রেনের সাবেক প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ রাশিয়াপন্থি হিসেবে পরিচিত ছিলেন। যদিও তিনি গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্ট ছিলেন।
তার রাশিয়াপন্থি নীতির প্রতিবাদে ২০১৪ সালে তার বিরুদ্ধে ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু হয় এবং এক পর্যায়ে বিরোধীরা রাজধানী কিয়েভ দখল করে নেয়।
তখন ইউক্রেনের পার্লামেন্ট ইয়ানুকোভিচকে বরখাস্ত করে এবং তিনি রাশিয়ায় পালিয়ে যান। তখন থেকে তিনি রাশিয়াতে অবস্থান করছেন।

এছাড়াও সিরিয়ায় দুই যুগ ধরে ক্ষমতায় ছিলেন বাশার আল-আসাদ। এর মধ্যে প্রায় এক দশক তাকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে বড় ভূমিকা পালন করে রাশিয়া।

তবে সিরিয়ায় গতবছরের ৯ ডিসেম্বর বিস্ময়কর এক ঘটনা ঘটে যায়। বিদ্রোহীদের অভিযানে বাশার আল-আসাদের পতন হয়েছে। তিনি রাশিয়ায় পালিয়ে গেছেন।

ক্রেমলিনের একটি সূত্রের বরাত দিয়ে রুশ সংবাদ সংস্থা ও দেশটির রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন জানিয়েছে, মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে বাশার আল-আসাদ ও তাঁর পরিবারকে রাজনৈতিক আশ্রয় দিয়েছে মস্কো।

টিজে/টিকে 

Share this news on:

সর্বশেষ

img
বন্ধু ছাঁটাই করার দিন আজ Nov 17, 2025
img
বেলিংহ্যামকে সতর্ক করলেন ইংল্যান্ড কোচ Nov 17, 2025
img
শেখ হাসিনা যাদের মায়া করে নাই, তাদের উচিত না তার জন্য মায়া দেখানো: রাশেদ খান Nov 17, 2025
img

মেহজাবীন চৌধুরী

‘ভাইরাল হওয়ার জন্য অন্যকে ব্যবহার করা খুবই সহজ’ Nov 17, 2025
img
রাজস্থান রয়্যালসের হেড কোচের দায়িত্বে সাঙ্গাকারা Nov 17, 2025
img
ধানমন্ডি ৩২-এর সামনে সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ, বুলডোজার সরানোর নির্দেশ Nov 17, 2025
img
রাজধানীতে আওয়ামী লীগের আরো ২৫ নেতাকর্মী গ্রেপ্তার Nov 17, 2025
img
কুমিল্লায় জামায়াত কর্মীর গাড়িতে আগুন Nov 17, 2025
img
ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বুলডোজার নিয়ে যাওয়া দলকে ‘রাজাকার’ আখ্যা অভিনেত্রী শাওনের Nov 17, 2025
img
রাঙামাটির কাপ্তাইয়ে যুবলীগ নেতা গ্রেপ্তার Nov 17, 2025
img

বিবিসিকে চিফ প্রসিকিউটর

রায় ঘোষণায় ঘণ্টাখানেক সময় লাগতে পারে, আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি Nov 17, 2025
img
আইসিইউতে ভর্তি নির্মাতা শেখ নজরুল ইসলাম Nov 17, 2025
img
আমি যে স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত সে কথা ভাবতেও পারিনি: মহিমা চৌধুরী Nov 17, 2025
img

রিজভী

ফ্যাসিস্ট আমলে যারা অপরাধ করেছে, তারাই বাসে আগুন দিচ্ছে Nov 17, 2025
img
বিচারকদের নিরাপত্তায় কার্যকর পদক্ষেপ চায় রাজশাহী বিচার বিভাগ Nov 17, 2025
img
শাটডাউনের প্রভাব মুক্ত ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক Nov 17, 2025
img
এবারের নির্বাচন দেশ রক্ষার নির্বাচন : প্রধান উপদেষ্টা Nov 17, 2025
img
হাসিনার রায় ঘিরে সারা দেশে নিরাপত্তা জোরদার : আইজিপি Nov 17, 2025
img
স্ত্রী-মেয়েসহ সাবেক মন্ত্রী নানকের মোট ৫৭টি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ Nov 17, 2025
img
আহান শেঠি-জিয়া শংকরের গুঞ্জনময় প্রেমের উত্তাপ নেটদুনিয়ায় Nov 17, 2025