বাউলশিল্পীদের ওপর হামলার ঘটনায় বাংলাদেশ আবৃত্তি ফেডারেশনের বিবৃতি

মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলায় গানের আসরে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে বাউলশিল্পী আবুল সরকারকে গ্রেপ্তার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। রোববার ২৩ নভেম্বর তার মুক্তির দাবিতে আয়োজিত শান্তিপূর্ণ মানববন্ধন কর্মসূচিতে একদল ব্যক্তি তার ভক্ত-অনুরাগীদের ওপর হামলা করে। এতে প্রায় ১০ জন আহত হন।

বুধবার ২৬ নভেম্বর ঠাকুরগাঁওয়ে আবারও বাউলশিল্পীদের ওপর হামলা করা হয়েছে এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে সাধারণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে স্থানীয় বাউলশিল্পীদের বিরুদ্ধে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে সহিংস পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হচ্ছে।

একজন শিল্পী বা সংস্কৃতিকর্মী একটি সমাজের দর্পণ। শিল্প-সংস্কৃতির সুস্থ ও ধারাবাহিক চর্চায় যেমন রাষ্ট্র ও সমাজের দায়বদ্ধতা আছে, তেমনি শিল্পী-সংস্কৃতিকর্মীরও সমাজ, রাষ্ট্র ও জনগণের কাছে দায় এড়ানোর কোনই সুযোগ নেই। বাউল সাধক আবুল সরকার বিচারগানের অনুষ্ঠানে যেভাবে শব্দচয়ন ও বাহাসে নিজেকে উপস্থাপন করেছেন, তা কোন অর্থেই শিল্পসম্মত ও গ্রহণযোগ্য নয়।

স্বাভাবিকভাবেই তা সকলকে আহত ও সংক্ষুব্ধ করে তুলেছে এবং রাষ্ট্রের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তাকে জবাবদিহিতার আওতায় এনেছে। প্রশাসন তার সুষ্ঠু ও ন্যায় বিচার করবে- আমরা এটাই প্রত্যাশা করি। কিন্তু তার ভক্ত ও অনুসারীদের উপর আক্রমণ, তার বক্তব্যের জন্য সারা দেশের বাউলশিল্পীদের দায়ী করে নিপীড়ন, নির্যাতন ও তাদের হুমকি-ধামকি দিয়ে ঘৃণা-ত্রাস সঞ্চার দেশে সুস্থধারার সংস্কৃতি চর্চার পরিবেশকে ধ্বংস করার শামিল।

গত ৪ দিন ধরে দেশের বিভিন্ন স্থানে যেভাবে স্লোগান-বক্তব্যে, হামলায় সকল বাউলশিল্পীর জীবন বিপন্ন করে তোলা হচ্ছে, তাতে আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন ও শঙ্কিত। আমরা বিশ্বাস করি, একজন বাউলশিল্পী আবুল সরকারের বক্তব্যের দায়ে কোন যুক্তিতেই সকল বাউলশিল্পীকে সামগ্রিকভাবে দায়ভূক্ত করে আক্রমণ বা অপরাধী করা, তাদের জীবনের নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি করা কিংবা স্বাভাবিক জীবনযাপনের অধিকার হরণ করার অধিকার রাষ্ট্র কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকেই দেয়না।

বাউল আবুল সরকারের ঘটনাকে কেন্দ্র করে দেশে বিশৃঙ্খলা, যথেচ্ছাচার ও বিভ্রান্তি ছড়িয়ে যে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করা হচ্ছে, তা রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থায় কোন সুফল বয়ে আনবেনা, বরং দেশের ভাবমূর্তি নিদারুণ প্রশ্নবিদ্ধ হবে।

আবুল সরকার কিংবা বাংলাদেশের কোন নাগরিকই আইনের উর্ধ্বে নয়, অপরাধ করলে তার বিচার আইনী প্রক্রিয়াতেই হবে- এটাই স্বাভাবিক, কিন্তু গত কয়েকদিন ধরে যেভাবে বাউলশিল্পীদের বিরুদ্ধে ঘৃণা-বিদ্বেষ ও প্রতিহিংসা ছড়ানোর চেষ্টা চলছে, তা কোনভাবেই ২০২৪ এর জুলাই বিপ্লবের মূল্যবোধকে ধারণ করেনা। আমরা গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করেছি যে, এর আগেও নানা সময়ে মাজার ভাঙা, দরগাহ ও ওরসকে কেন্দ্র করে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের মতো ন্যাক্কারজনক ঘটনাও ঘটেছে।

জুলাই ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর এ ধরনের ভয়াবহ ঘটনা অত্যন্ত উদ্বেগজনক ও উৎকণ্ঠার। জুলাই অভ্যুত্থানের প্রধান আকাঙ্ক্ষা ছিল ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠা; যেখানে দল, মত, ধর্ম, ধর্মীয় ধারা-উপধারা, জাতি ও শ্রেণি-নির্বিশেষে সকল নাগরিকের সমান মর্যাদা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত থাকবে। অথচ সরকারের পক্ষ থেকে এসব থামাতে, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এবং জুলাইয়ের গণমানুষের প্রত্যাশা পূরণে এখনও পর্যন্ত কোনো কার্যকর ও দৃশ্যমান উদ্যোগ আমরা প্রত্যক্ষ করিনি।

বাংলাদেশ বহুসংস্কৃতি ও ঋতুবৈচিত্রের দেশ, লোকজ সংস্কৃতির দেশ। ফকির লালন শাহ, হাছন রাজা, শাহ আব্দুল করিমের দেশ। শাহজালাল শাহপরানসহ বহু পীর-অলি-আউলিয়ার দেশ এই বাংলা। আছে মসজিদ, মন্দির, মাজার সংস্কৃতি। ধানের দেশ, গানের দেশ, বাউলের দেশ বাংলাদেশ। বাংলাদেশ আবৃত্তি ফেডারেশন যেমন ধর্মীয় অনুভূতিকে শ্রদ্ধা ও সম্মান করে, তেমনি প্রতিটি ধর্ম ও ধর্মীয় ধারা-উপধারার মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং নিজস্ব ঐতিহ্য, শিল্প-সংস্কৃতি চর্চার অধিকারকেও সমদৃষ্টিতে দেখে।

যে কোনো সংক্ষুব্ধ নাগরিকের আইনের আশ্রয় নেয়ার সুযোগ যেমন রাষ্ট্র দেয়, তেমনি অপরাধ করলে, অপরাধীরও ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার আছে। কিন্তু রাষ্ট্রকাঠামোকে অগ্রাহ্য করে কোন নাগরিকই বিচারের ভার নিজের হাতে তুলে নিতে পারেনা এবং এটি করা মানেই রাষ্ট্রকে অস্বীকার করা, রাষ্ট্রের আইন-কানুন লঙ্ঘন করা। কেউ রাষ্ট্রের আইন লঙ্ঘন করলে, শান্তি-শৃঙ্খলা ও জানমালের জন্য হুমকি সৃষ্টি করলে, সেও অপরাধী এবং তাকেও বিচারের আওতায় আনা উচিত বলেই আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।

সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের প্রতি বাউলশিল্পীসহ ফকির ও অন্যান্য ধর্মীয় ধারা-উপধারার ভিন্নমতাবলম্বীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি দেশের সর্বত্র সংস্কৃতি চর্চার পরিবেশ নিশ্চিত করা এবং উচ্ছৃঙ্খলতা ও উগ্রপন্থার মাধ্যমে দেশে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির সকল অপচেষ্টার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বাংলাদেশ আবৃত্তি ফেডারেশন স্পষ্ট ও সুদৃঢ় আহ্বান জানাচ্ছে।

টিকে/

Share this news on:

সর্বশেষ

img
জামায়াতে ইসলামীসহ ৮ দলের রাজশাহী বিভাগীয় সমাবেশ রবিবার Nov 27, 2025
img
সিরামিকশিল্পের সম্ভাবনা কাজে লাগাতে ব্যবসায়ীদের প্রতি বাণিজ্য উপদেষ্টার আহ্বান Nov 27, 2025
img
দেশকে মধ্যযুগীয় বর্বরতায় নিয়ে যাওয়ার ষড়যন্ত্র চলছে : বাসদ Nov 27, 2025
img
অগ্নিকাণ্ডের একদিন পর ১৬ তলা থেকে জীবিত উদ্ধার, প্রাণহানি বেড়ে ৬৫ Nov 27, 2025
img
স্বামী অন্য পুরুষের শয্যাসঙ্গী হওয়ার জন্য চাপ দিতেন, অভিযোগ সেলিনার Nov 27, 2025
img
মন্ত্রী-সচিব আলেম থেকে হলে দেশের চেহারা পাল্টে যাবে : ধর্ম উপদেষ্টা Nov 27, 2025
img
বিএনপি নেতা আব্দুল আউয়াল মিন্টুর গাড়ি বহরে হামলা, আহত ১০ Nov 27, 2025
img
ট্রাম্পের বিরুদ্ধে প্রায় ১০ লাখ ডলারের জরিমানা বহাল রেখেছেন আদালত Nov 27, 2025
img
ম্যাচ হেরে প্রতিশোধের হুমকি হ্যারি কেইনের Nov 27, 2025
img
সরাসরি চুক্তিতে রাজশাহীতে শান্ত Nov 27, 2025
img
নয়া কর্মসূচি দিলো বিএনপি Nov 27, 2025
img
আমিরকে দলে ভেড়ালো সিলেট টাইটান্স Nov 27, 2025
img
চট্টগ্রামের ফটিকছড়িতে মোটরসাইকেল সংঘর্ষে পুলিশের এএসআইসহ নিহত ২ Nov 27, 2025
img
পাবনায় জামায়াতের প্রচারণায় হামলা , আহত অর্ধশতাধিক Nov 27, 2025
img
বেগম জিয়ার সুস্থতা দেশের ভবিষ্যতের জন্য অত্যন্ত জরুরি : আমিন উর রশিদ ইয়াছিন Nov 27, 2025
img
বিস্তৃত হচ্ছে দুদকের পরিধি, নতুন অধ্যাদেশ অনুমোদন Nov 27, 2025
img
টঙ্গীতে ৫ দিনের জোড় ইজতেমা শুরু শুক্রবার Nov 27, 2025
img
কোনোভাবেই দলকে বিব্রত করা যাবে না : নজরুল ইসলাম আজাদ Nov 27, 2025
img
সশস্ত্র বাহিনীর কর্মক্ষেত্র ও চাহিদা বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত হয়েছে : বিমান বাহিনী প্রধান Nov 27, 2025
img
মোবাইল হ্যান্ডসেটের দাম নিয়ন্ত্রণে সতর্ক থাকার আশ্বাস বিটিআরসি'র Nov 27, 2025