রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সিনিয়র সাংবাদিক মাসুদ কামাল বলেছেন, আসলে এনসিপির রাজনীতিটা এরকম, তারা এটাই করতে চেয়েছিল। এতদিন তারা যে সমস্ত কথাবার্তা বলেছে তার অধিকাংশ ছিল নাটক। এতদিন তারা কি বলেছে? তারা একটা মধ্যপন্থা দল হিসেবে নিজেদেরকে আবির্ভূত করার চেষ্টা করেছে। তারা একটা গণতান্ত্রিক মধ্যপন্থা টাইপের দল।
চরম ডানপন্থী নয়। এগুলো তারা বলেছে। কিন্তু তাদের এই কাজটা কিন্তু সেই তাদের বক্তব্যটাকে ঠিক সেভাবে সমর্থন করে না। এখন হয়তো উনারা বলবেন যে আমরা নির্বাচনকে সামনে রেখে করেছি।
আমরা নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে চাই। এই জন্য করেছি। শেষ পর্যন্ত চূড়ান্ত ঘোষণাটা এসেই গেল। রবিবার (২৮ ডিসেম্বর) বিকেলে জাতীয় প্রেস ক্লাবে একটা জরুরি সংবাদ সম্মেলন করে জামায়াতের আমির শফিকুর রহমান ঘোষণা দিয়েছেন যে তারা আগে ৮টা দল ছিলেন একসঙ্গে নির্বাচনী সমঝোতায়।
এখন সেখানে আরো দুটি দল যুক্ত হয়েছে। সেই দল দুটি হলো জাতীয় নাগরিক পার্টি এনসিপি এবং কর্নেল অলি আহমেদের নেতৃত্বাধীন এলডিপি। এই দুটি পার্টি মিলে এখন তারা ১০ দলের একটা নির্বাচনী জোট করল এবং জোটে কে কয়টা আসন পাবে না পাবে এগুলো নিয়ে পরে আলোচনা হবে।
রবিবার (২৮ ডিসেম্বর) নিজ ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে মাসুদ কামাল এসব কথা বলেন।
মাসুদ কামাল বলেন, যতদূর জানা গেছে এনসিপিকে তারা আসন দিচ্ছে ৩০টির মতো। ৩০টি আসন নিয়ে বহুল সম্ভাবনা নিয়ে যে দলটা গঠিত হয়েছিল তরুণ সমাজের মুখপাত্র হিসেবে যাদেরকে বিবেচনা করা হতো আন্দোলনের সিফাসালা হিসেবে যারা নিজেদেরকে দাবি করত। সেই এনসিপি জামায়াতের কাছ থেকে ৩০টি আসন পেয়ে জামায়াতের সঙ্গে নির্বাচনী জোট করছে। এর অর্থ হলো তারা যে ৩০টি জায়গায় নির্বাচন করবে সেই ৩০ জায়গায় জামায়াত ইসলাম ইসলামী আন্দোলন অথবা এই জোটের অন্য নয় দলের কোনো প্রার্থী থাকবে না। আর বাকি যে ২৭০টি আসন আছে সেই আসনগুলোতে এনসিপির কোনো প্রার্থী থাকবে না।
মাসুদ কামাল আরো বলেন, এনসিপি তাদের জোটের প্রার্থীদের পক্ষে কাজ করবে এনসিপির লোকজন এবং এনসিপির ৩০টি আসনে জামাত এবং অন্যান্যরা যদি তাদের সেখানে অবস্থান থাকে তারাও তার জন্য ফাইট করবে। এই হল নির্বাচনী ঐক্যের মূল ভিত্তিটা। এখন সে ঐক্যের ফলাফল কি হবে? সামনের দিনগুলোতে কেমন হবে নির্বাচন? ৩০টির মধ্য থেকে এনসিপি কয়টা আসনে জিততে পারে কি জিততে পারে না? এগুলো নিয়ে বিস্তর আলোচনা। কিন্তু এখন সামনের দিনগুলোতে আমরা দেখব আলোচনা হবে।
কিন্তু এর মধ্যে যে ঘটনাটা ঘটতে শুরু করেছে সেটা হলো এনসিপি ভাঙতে শুরু করেছে। এনসিপি থেকে এরই মধ্যে তাদের খুবই শীর্ষ স্থানীয় কয়েকজন পদত্যাগ করেছেন এবং সেই পদত্যাগুলো চোখে পড়ে, চোখে পড়ে কেন এনসিবির যে মুখ ছিল যারা যে লোকগুলোকে এনসিপির মুখ হিসেবে বিবেচনা করা হতো, ফেস হিসেবে বিবেচনা করা হতো। সেরকম একাধিক লিডার কিন্তু অলরেডি পদত্যাগ করেছেন। আমরা এনসিপির মুখ বলতে আপনারা কাকে বুঝেন বলুন। নাহিদ ইসলাম উনি এ দলের আহবায়ক, আখতার হোসেন উনি দলের সদস্য সচিব, এর বাইরে হাসনাত আব্দুল্লাহ, সারজি আলম। তার বাইরে আরেকজন খুব পরিচিত মুখ ডাক্তার তাসনিম জারা, তাসনুভা জাবিন উনিও কিন্তু খুবই পরিচিত মুখ। আরেকজন কে সামান্তা শারমিন এও বেশ পরিচিত মুখ। এই যে লোকগুলো এদের মধ্যে কিন্তু তাসনিম জারা পদত্যাগ করেছেন গত শনিবার এবং পদত্যাগ করে বলেছেন উনি এই দলের সঙ্গে নাই এবং উনাকে যে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে যে আসন থেকে।
উনি সেই আসন থেকেই নির্বাচন করবেন এবং স্বতন্ত্রভাবে করবেন। আরেকজন তাসনুভা জাবিন উনিও বলেছেন উনি দলের সঙ্গে থাকবেন না। উনি বিশাল একটা পোস্ট দিয়েছেন সেই পোস্টে তাদের বিরুদ্ধে অনেক কথা বলেছেন সেগুলো নিয়ে আমি একটু পরে আলোচনা করব এবং উনি নির্বাচন আর করবেন না বাট উনি দলে আর থাকবেন না। আর তারও আগে এই দলটির একজন খুবই পরিচিত নেতা মীর আরশাদুল হক উনি গত বৃহস্পতিবার পদত্যাগ করেছেন। আর জেষ্ঠ্য যুগ্ম আহবাক ছিলেন সামান্তা শারমিন এই সামান্তা শারমিন উনিও বলেছেন, উনি পদত্যাগ করেননি এখন পর্যন্ত বলেছেন যদি এনসিপি জামায়াতের সঙ্গে একটা নির্বাচনী জোট করে এর জন্য এনসিপিকে কঠিন মূল্য দিতে হবে। কঠিন মূল্য দিতে হবে এবং তারপরে তারা নিজে নিজের বক্তব্যগুলো নিজেদের এই যুক্তিগুলো তারা নানাভাবে জাস্টিফাই করেছেন। আমরা যদি এই যে নেতৃবৃন্দ যারা নাকি পদত্যাগ করেছেন অথবা সমালোচনা করেছে তাদের বক্তব্যটা একটু শুনি, তাহলে আপনারা বুঝতে পারবেন যে তারা কেন এই কথাটি বলেছেন।
মাসুদ আরো বলেন, সামান্তা শারমিন স্পষ্টভাবে বলেছেন যে এনসিবির যে এতদিনের যে অবস্থানটা ছিল তার মূলনীতিটা কি ছিল যে তাদের যে মূলনীতিটা ছিল সেই মূলনীতির সঙ্গে জামায়াতের যে রাজনীতি সেটা একদম ভিন্ন। এই হলো উনার বক্তব্য এবং উনি বলেছিলেন যেটা গড়ে উঠেছিল যে বিচার সংস্কার ও গণপরিষদ নির্বাচন তথা সেকেন্ড রিপাবলিককে কেন্দ্র করে। আর এই তিনটা বিষয়ে যদি কারো সঙ্গে আপনি মিত্রতা করতে যান এই তিনটা বিষয় হতে হবে তার পূর্বশর্ত। মৃত্রতার পূর্বশত্রু। কিন্তু এ পূর্ব শর্তগুলো জামাত ধারণ করে না। কাজেই জামাতের সঙ্গে মিত্রতা করা যায় না। এ হলো রাজনৈতিক ব্যাখ্যা সামান্তা শারমিন দিয়েছেন এবং তাসনুভা জাবিন যিনি রবিবার পদত্যাগ করেছেন এবং তিনি উল্লেখ করেছেন যে উনি কেন পদত্যাগ করেছেন। তাকে কিন্তু ঢাকা-১৭ আসনে প্রার্থীও করা হয়েছিল। উনি বলছেন যে উনি নির্বাচনও করবেন না। উনি এখন আর স্বতন্ত্রভাবেও নির্বাচন করবেন না। এবং তিনি কতগুলো কথা বলেছেন যে এমন একসময়ে এনসিপি এই কাজটা করল যে যখন নাকি তারা ঠেলতে ঠেলতে আলোচনা করতে করতে এমন এক সময় গেল যে আগামীকালকে কিন্তু মনোনয়ন জমা দেওয়ার শেষ দিন হাতে মাত্র এক দিন আছে।
এই এক দিন সময়ের মধ্যে যদি কোনো প্রার্থী চান যে আমি এনসিপিতে থাকব না এবং আমি স্বতন্ত্র নির্বাচন করব সেই সুযোগও আর তারা রাখেনি। কারণ আপনারা জানেন যে আমাদের এখানে উদ্ভট একটা নিয়ম আছে। উদ্ভট নিয়মটা হলো যদি কেউ স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে চান তাকে ওই এলাকার টোটাল যা ভোটার আছে সেই ভোটারের এক শতাংশ ভোটারের স্বাক্ষরযুক্ত কাগজ জমা দিতে হয়। মানে এক শতাংশ লোক বলবে যে আমি এই ভদ্র লোককে অথবা এই প্রার্থীকে ভোট দিতে চাই অথবা এই প্রার্থীর ভোটার হওয়া উচিত। এই এক শতাংশ লোকের স্বাক্ষরযুক্ত কাগজ জমা দেওয়ার পরেই কেবলমাত্র তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে পারবেন। এটা হলো নিয়ম বর্তমানে।
নিয়মটা খুবই উদ্ভট এবং খুবই বাজে একটা নিয়ম। এই নিয়মটা শেখ হাসিনার আমলে ছিল। আমাদের এই সরকার শেখ হাসিনার বিরোধী সরকার মহা আনন্দে সে অসম্ভব খারাপ নিয়মটাকে বুকে তুলে নিয়েছে এবং তাকে সেই আইনটা এখন প্রয়োগ করতে হচ্ছে এবং এজন্য জামিন বলেছেন যে আপনারা এটাকে ঠেলতে ঠেলতে এমন একটা জায়গায় নিয়ে এসেছেন যখন নাকি আর কেউ স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে পারবে না। এই জিনিসটা কিন্তু ডাক্তার তাসনিম জারা উনি যেহেতু এক দিন আগেই করেছেন পদত্যাগ। উনি কিন্তু এ জন্যই ঘোষণা দিয়েছেন যে উনি এক দিনের মধ্যে সংগ্রহ করতে পারবেন।
মাসুদ কামাল বলেন, আমি যতদূর জানি এরই মধ্যে তাসলিম জারা তার পক্ষে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে উনার দাঁড়ানোর পক্ষে সাক্ষ্য সংগ্রহ শুরু করেছেন এবং মোটামুটি বোধহয় অর্ধেকের বেশি ওনার সংগ্রহ হয়ে গেছে এবং এটাও হতে পারে রবিবার রাত ১০টা পর্যন্ত চলবে ততক্ষণ ওনার সাক্ষ্য সংগ্রহ সম্পন্ন হতে পারে। তারপর সোমবার সে একটা সময় পাবে দুপুর ১২টা পর্যন্ত।
যাইহোক এখন তাসনুভা জাবিন যে কথাগুলো বলেছেন, সে কথাগুলো আমি কিন্তু একদম উড়িয়ে দিতে পারি না। খুব লম্বা স্ট্যাটাস পোস্ট দিয়েছেন সব তো আর পড়া যায় না। তবে যতটুকু আমি দেখেছি আমার কাছে এটা কিন্তু খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। উনি যে প্রশ্নটা করেছেন যে আপনি এরকম একটা বড় সিদ্ধান্ত নিলেন কোনো আলাপ করলেন না। আলাপ না করে আপনি সিদ্ধান্ত নিলেন সবার সঙ্গে এককভাবে। এটা আসলে ঠিক হয়নি। কিন্তু আলাপ একদম হয়নি। আমি কিন্তু তাও মনে করি না। আপনারা জানেন যে ওদের সেন্ট্রাল কমিটিতে ২১৪ জন মেম্বার আছে এনসিপিতে। ২১৪ জন মেম্বারের মধ্যে এই জামায়াতের সঙ্গে যাওয়া না যাওয়া নিয়ে যে ভোটাভুটি হয়েছে।
সেখানে ১৮৪ জন সদস্য তারা বলেছে তারা জামায়াতের সঙ্গে যাওয়ার পক্ষে। আর ৩৪ জন বলেছিল যে তারা জামায়াতের সঙ্গে যেতে চায় না। কাজেই সংখ্যাগরিষ্ঠের মতের ওপর ভিত্তি করেই কিন্তু তারা এই সিদ্ধান্তটা নিয়েছেন। এখন সংখ্যাগরিষ্ঠ সিদ্ধান্ত নেওয়ার মাধ্যমে কি বোঝা গেল? আসলে এনসিপির রাজনীতিটা এরকম। তারা এটাই করতে চেয়েছিল। এতদিন তারা যে সমস্ত কথাবার্তা বলেছে তার অধিকাংশ ছিল নাটক। এতদিন তারা কি বলেছে? তারা একটা মধ্যপন্থা দল হিসেবে নিজেদেরকে আবির্ভূত করার চেষ্টা করেছে। তারা একটা গণতান্ত্রিক মধ্যপন্থা টাইপের দল। চরম ডানপন্থী নয়। এগুলো তারা বলেছে। কিন্তু তাদের এই কাজটা কিন্তু সেই তাদের বক্তব্যটাকে ঠিক সেভাবে সমর্থন করে না। এখন হয়তো উনারা বলবেন যে আমরা নির্বাচনকে সামনে রেখে করেছি। আমরা নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে চাই। এই জন্য করেছি।
কিন্তু আসলে কি তাই জামায়াতের সঙ্গে তাদের এই জোট কি তাদের নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার ক্ষেত্রে কোনো ধরনের সহায়তা করবে। আমি ব্যক্তিগতভাবে এতে খুব একটা আশাবাদী নই। আমি মনে করি না যে জামায়াতের এমন ভোট আছে জামায়াত কোন সিটগুলো এদেরকে দেবে একবার ভাবুন। যেগুলোতে জামায়াতের খুব সম্ভাবনাময় আসন সেগুলো কি জামায়াত ওদেরকে অফার করবে, আমার তো মনে হয় না। যেখানে সম্ভাবনাময় নয় জামায়াতের অবস্থান সেখানে জামায়াত সমর্থন করলেই এনসিবি খুব বেশি একটা আসন পেয়ে যাবে আমার সেটাও মনে হয় না। মাঝখান থেকে কি হলো আসনের আসন গেল মাঝখান থেকে দলটার ইজ্জত গেল, যদি তারা এটাকে ইজ্জত বলে মনে করে।
তারা জামায়াতের সঙ্গে যাচ্ছে এবং তাদের রাজনীতিও শেষ করে দিতে যাচ্ছে। দুই একটা আসন পাবে কিনা আমি জানি না। কিন্তু রাজনীতি আর থাকবে না। কিন্তু আমি যেটা বলেছিলাম সেটা ভুল ছিল এই কারণে যে যদি তারা একা একা থাকতো, এই লোকগুললো থাকতো। আসলে তো তাদের কোনো রাজনীতিই নাই। একটা রাজনীতিহীন একটা দল ছিল। এটা আমরা ভেবেছিলাম যে এদের মধ্যে একটা রাজনীতি আছে। আমাদের ভাবনাটাই ভুল।
ইউটি/টিএ