হারিয়ে যাওয়া শহরে একদিন

লোক ও কারুশিল্প জাদুঘর এবং বাংলার প্রথম রাজধানী হিসেবে খ্যাত পানামনগর। রাজধানী ঢাকা থেকে ২৪ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত নারায়ণগঞ্জ জেলার সোনারগাঁও উপজেলায় অবস্থিত এটি। কলেজ থেকে এই বছরের শিক্ষাসফরের গন্তব্য বারো ভূঁইয়া খ্যাত ঈশা খাঁর রাজধানী। যাওয়ার দিনক্ষণ ঠিক করা হল শুক্রবার (৬ মার্চ)।

আগেই জানিয়ে দেয়া হয়েছিল, শুক্রবার সকাল সাড়ে সাতটায় ঢাকা কলেজ থেকে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে বাস ছেড়ে যাবে। সেই মোতাবেক সকালেই সবাই কলেজ ক্যাম্পাসে হাজির। কিন্তু নানা আনুষঙ্গিক কাজ শেষ করে বাস ছাড়ে প্রায় ৮টায়। গন্তব্যে পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় সাড়ে ন’টা। বাস থেকে নেমে সেখানে আগেই ঠিক করে রাখা রিসোর্টে গিয়ে উঠি সবাই।

রিসোর্টে একটু বিশ্রাম নিয়ে আমরা সকল শিক্ষক-শিক্ষার্থী রওনা হলাম আমাদের প্রথম গন্তব্য লোক ও কারুশিল্প জাদুঘরের উদ্দেশে। যা শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে ১২ মার্চ সোনারগাঁয়ের ঐতিহাসিক পানাম নগরীর একটি পুরনো বাড়িতে বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন নামে প্রতিষ্ঠা করেন। আবহমান গ্রাম বাংলার লোক সংস্কৃতির ধারাকে বিকশিত করার প্রত্যয়ে তিনি এটি করেছিলেন। পরে ১৯৮১ সালে বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন কমপ্লেক্সটি প্রায় ১০০ বছর পুরাতন সর্দার বাড়িতে স্থানান্তরিত করা হয়। পরে ১৯৯৬ সালে প্রতিষ্ঠিত তিনতলা বিশিষ্ট ভবনে গড়ে তুলা হয় বর্তমান জাদুঘরটি।

মূল গেট দিয়ে প্রবেশ করে প্রথমেই আসি লোক ও কারুশিল্প জাদুঘরে সামনে। সেখানে সকল শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নিয়ে চলে ফটোসেশন। কেউ সেলফি তুলছে, কেউ দেখাচ্ছে হাতে থাকা ডিএসএলআরে ছবি তুলার কারিশমা। এরকম একক, গ্রুপ নানাভাবে ছবি তুলা শেষে এবার জাদুঘরে ঢুকার পালা। জাদুঘরে প্রথমে ঢুকতেই চোখে পড়লো নানা রকম লোক ও কারুশিল্পকর্মের বিক্রয় কেন্দ্র। তার পর হাতের বাম দিক দিয়ে ঢুকে একে একে দেখলাম বাংলাদেশের প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যে কাঠ থেকে তৈরি বিভিন্ন কারুপণ্য, কাঠের তৈরি প্রাচীন ও আধুনিককালের নিদর্শন যা ধারাবাহিক প্রক্রিয়ায় আকর্ষণীয়ভাবে কারুশিল্পের কর্মপরিবেশকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।

দ্বিতীয় তলায় রয়েছে জামদানী, নকশিকাঁথা গ্যালারি। যেখানে রয়েছে সোনারগাঁয়ের তৈরি ঐতিহ্যবাহী জামদানি শাড়ি এবং দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বৈচিত্র্যময় নকশিকাঁথা প্রদর্শন। সেই সঙ্গে অত্যন্ত আকর্ষণীয় বাংলাদেশের প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের বয়নশিল্পের কর্মপরিবেশ ও বিপণন চিত্র।

তৃতীয় তলায় রয়েছে তামা কাঁসা পিতলের নিদর্শন। যেখানে রয়েছে বিভিন্ন সময়ে ব্যবহৃত মহিলাদের তামা, কাসা, ও পিতলের নানা রকম অলঙ্কার।

জাদুঘর থেকে বের হয়ে ঘুরলাম শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনের সৃষ্টি অপূর্ব এক শৈল্পিক গ্রাম। এর ফাঁকে ফাঁকে নানা জায়গায় নানা রকমের ফটো সেশন। তারপর সেখান থেকে রওনা হই ঈশা খাঁর স্মৃতি বিজড়িত পানামনগরের উদ্দেশে।

ইন্টারনেট ঘেঁটে জানতে পারলাম, পানাম নগর পৃথিবীর ১০০টি ধ্বংসপ্রায় ঐতিহাসিক শহরের অন্যতম একটি। বড় নগর, খাস নগর, পানামনগর- প্রাচীন সোনারগাঁওয়ের এই তিন নগরের মধ্যে পানাম ছিল সবচেয়ে আকর্ষণীয়। সোনারগাঁওয়ের ২০ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে গড়ে উঠেছিলো এই নগরী। সোনারগাঁও লোক ও কারুশিল্প জাদুঘর থেকে উত্তর দিকে হাঁটাপথেই পৌঁছানো যায় পানামনগরে। সিএনজি, রিকশা বা অটোরিকশাও রয়েছে যাতায়াতের জন্য। অর্ধচন্দ্রাকৃতির ধ্বংস প্রায় পানাম পুলে পৌঁছাতে সময় লাগে ৫ থেকে দশ মিনিট। এই পুল পেরিয়েই আগে ঢুকা হতো পানাম নগরীতে। আর সড়কের দুপাশে সারি সারি সাজানো একতলা, দ্বিতল তিনতলা ভবনের পানাম নগর।

বর্তমান টিকে থাকা পানামনগরে ৫ মিটার প্রস্থ ও ৬০০ মিটার দীর্ঘ সড়কের দুই পাশে রয়েছে মোট ৫২টি বাড়ি। যার মধ্যে সড়কের উত্তর পাশে আছে ৩১টি আর দক্ষিণ পাশে ২১টি বাড়ি। কালের সাক্ষী হয়ে রাস্তার দুইপাশে দাঁড়িয়ে থাকা বাড়িগুলোয় যেনো সাক্ষী দিচ্ছে আমাদের সমৃদ্ধ ইতিহাস আর ঐতিহ্যের কথা। যদিও বর্তমানে দাঁড়িয়ে থাকা ভবনগুলোর নির্মাণ আঠারো শতকের শুরু দিকে। এর নিচেই চাপা পড়ে আছে পানাম নগরীর আদি ইতিহাস। পানাম ও এর আশপাশ ঘিরে পঞ্চদশ শতক থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত ছিল এক সমৃদ্ধ জনপথ। রাস্তার দুই পাশে আবাসিক ভবন ছাড়াও মসজিদ, মন্দির, গির্জা, মঠ, পুকুর, গোসলখানা, নাচঘর, পান্থশালা, চিত্রশালা, দরবার কক্ষ, গুপ্তপথ, বিচারালয় ও পুরনো জাদুঘর, সরাইখানা, ঠাকুর ঘর, কূপ, খাজাঞ্চিখানা, টাঁকশাল, প্রশস্ত দেয়াল, প্রমোদালয়, এই সব কিছুই জানান দেয় প্রাচীন এই নগরীর সমৃদ্ধির কথা।

ঘুরতে ঘুরতে বেলা যে কখন পশ্চিম আকাশে হেলে গেছে তার ভ্রুক্ষেপ নেই কারো। তার সাথে পেটে টান! টের পেতেই অতীত-বর্তমানের দোলাচল থেকে বের হয়ে দুপুর ২টার দিকে রওনা হলাম রিসোর্টের দিকে। সেখান পৌঁছে পেটের দায় শোধ করে শুরু হলো আমাদের ভ্রমণের দ্বিতীয় পর্ব।

দ্বিতীয় পর্বটি শুরু হয় গান গাওয়ার মধ্য দিয়ে। ছিলো আবৃত্তি ও সোনারগাঁওয়ের ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে আলোচনা। তারপর শুরু হয় খেলাধুলার পর্ব। প্রথমেই চলে শিক্ষকদের পিলো ফ্লাইট। তবে পিলোর অনুপস্থিতিতে ফুটবল দিয়ে কাজ চালিয়ে দেয়া হয়। কে, কার হাত থেকে বল সরিয়ে পাশের জনের হাতে ধরিয়ে দিবেন চলে সে প্রতিযোগিতা। তারপর শুরু হয় বাংলার ঐতিহ্যবাহী হাড়ি ভাঙ্গা খেলা। প্রথমে শিক্ষকদের শুরু হলেও তাতে আমরা শিক্ষার্থীরাও অংশ নিই। কেউ হাড়ির দু’হাত পিছনে থাকছেন ত আবার কেউ চলে যাচ্ছেন সামনে। কেউ ডানে যাচ্ছেন ত কেউবা আবার বায়ে। কেউ হাড়ি ভাঙ্গছেন ত আবার কেউ যাচ্ছেন মাথা ফাটাতে। এমনই হাসিখুশির ছলে কখন যেনো দুপুর পার হয়ে বিকেল, বিকেল পার হয়ে সন্ধ্যা নেমে আসলো।

সর্বশেষ র‌্যাফেল ড্রয়ের মাধ্যমে সমাপ্ত হয় সারাদিনব্যাপী চলা অতীত বর্তমানের লুকোচরি আর শিক্ষক শিক্ষার্থীদের মিলনমেলার। লটারিতে এসে ঘটে আরেক কাণ্ড। যেহেতু স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষার্থীরা লটারি কেনে কম, আর শিক্ষকগণ বেশি। দেখা যায় শিক্ষকগণ অনেক শিক্ষার্থীদের দেয়ার পরে তাদের হাতে অনেক লটারি থেকে যায়। যে কারণে অনেক শিক্ষক একাধিক পুরষ্কার জিতে নিলেও শিক্ষার্থীরা পাচ্ছে না। তাই শিক্ষার্থীরা ‘মানি মানবো না’ বলে স্লোগান উঠায়, তখন সেটা বাতিল করে দিয়ে আবার নতুন কাউকে বেছে নেয়া হয়। এইভাবেই পরিসমাপ্তি ঘটে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর ভালবাসা আর সিনিয়র-জুনিয়র ভুলে গিয়ে সবাই এক সাথে আনন্দ উল্লাসে মেতে উঠার এক আনন্দময় মুহূর্তের। যার সাক্ষী হয়ে থাকল হারিয়ে যাওয়া একটি শহর!

 

টাইমস/আরএ/এইচইউ

Share this news on:

সর্বশেষ

img
শিগগিরই ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ শুরু করতে পারে ইরান: আব্বাস আরাঘচি Jul 01, 2025
‘আমরা একদলীয় দেশের বাসিন্দা’: ইলন মাস্ক Jul 01, 2025
img
উন্মুক্ত স্থানে ধূমপান সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করল ফ্রান্স Jul 01, 2025
img
সব আওয়ামী লীগারেরাই মেন্টালি সিক, তাদের থেরাপি ও রিহ্যাবে পাঠানোর পরামর্শ পিনাকির Jul 01, 2025
img
সবচেয়ে বেশি প্রযুক্তিনির্ভর হজ আয়োজন ২০২৫ সালে Jul 01, 2025
img
জুনে রেমিট্যান্সে রেকর্ড, ২৯ দিনেই এসেছে ২৭০ কোটি ডলার Jul 01, 2025
img
'সৌদি আরবই এখন আমার ঠিকানা' Jul 01, 2025
img
শাকিব খানের ‘মেগাস্টার’ ট্যাগ নিয়ে তোপের মুখে জাহিদ হাসান Jul 01, 2025
img
পুরো অর্থনীতিই এখন মব এবং মামলার বাণিজ্যের মধ্যে ঢুকে গেছে : গোলাম মাওলা রনি Jul 01, 2025
img
১টি ত্রিপল, ৩টি সেঞ্চুরি - এক ইনিংসে ৮২০ রানের কীর্তি Jul 01, 2025
img
‘বজরঙ্গী ভাইজান’-এ অভিনয় করে কত টাকা পারিশ্রমিক পেয়েছিলেন সেই মুন্নি! Jul 01, 2025
img
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নবনির্বাচিত কমিটির আত্মপ্রকাশ Jul 01, 2025
img
'ফুটবলের প্রতি যে ভালোবাসা এখনও আমার ভিতরে আছে তা আমাকে চালিয়ে নিচ্ছে' Jul 01, 2025
img
‘জুলাই বললে লাল হয়ে যায় স্মৃতি’- প্রেস সচিব শেয়ার করলেন কবিতা Jul 01, 2025
img
এবার ‘ক্যাপ্টেন কুল’ নামটিও নিজের করে নিতে চান ধোনি Jul 01, 2025
img
জুলাই কেবল আবেগ নয়, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের ডাক: প্রধান উপদেষ্টা Jul 01, 2025
img
শেখ হাসিনাসহ আসামিদের পক্ষে অভিযোগ গঠনের বিপক্ষে শুনানি আগামী সোমবার Jul 01, 2025
img
পাকিস্তানে ২ সপ্তাহের ব্যবধানে আবারও বাড়ল পেট্রোল ও ডিজেলের দাম Jul 01, 2025
img
আগামী বছরের শুরুতেই নির্বাচন, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে প্রধান উপদেষ্টা Jul 01, 2025
img
আরেক মেয়াদে টিটুর সঙ্গে চুক্তি নবায়ন করল বাফুফে Jul 01, 2025