করোনা বনাম লে-অফ

বর্তমান বাংলাদেশে শিল্প কল-কারখানায় কোভিড-১৯ তথা করোনা ভাইরাস যতটা না আলোচিত, তার চাইতেও অধিকতর স্থান দখল করে নিয়েছে ‘লে-অফ’ নামক শব্দটি। বাংলাদেশ লেবার ল এর ২০০৬-ধারা ১৬ মোতাবেক বর্তমানে আমরা ‘লে-অফ’ নামক বিষয়টা নিয়ে খুবই সোচ্চার।

লেবার ল ধারা ২ এর সংজ্ঞাসমূহের ৫৮ উপ ধারা অনুযায়ী: ‘লে-অফ’ অর্থ কয়লা, শক্তি ও কাঁচামালের স্বল্পতা অথবা মাল জমিয়া থাকা অথবা যন্ত্রপাতি বা কলকজ্বা বিকল বা ভাঙ্গিয়া যাওয়ার কারণে কোনো শ্রমিককে কাজ দিতে মালিকের ব্যর্থতা, অস্বীকৃতি বা অক্ষমতা।

এবার আসুন ধারা ১৬ অনুযায়ী লে-অফকৃত শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণের বিষয়টি জেনে নেই, ‘যে ক্ষেত্রে বদলী বা সাময়িক শ্রমিক নহেন এরূপ কোনো শ্রমিককে, যাহার নাম কোনো প্রতিষ্ঠানের মাস্টার রোলে অন্তর্ভুক্ত আছে এবং যিনি মালিকের অধীনে অন্তত: এক বৎসর চাকুরী সম্পূর্ণ করিয়াছেন, তাকে যদি লে-অফ করা হয়, তাহলে মালিক তাকে সাপ্তাহিক ছুটির দিন ব্যতীত তার লে-অফের সব দিনের জন্য ক্ষতিপূরণ প্রদান করিবেন।

তাহলে আমার জিজ্ঞাসা, যারা স্থায়ী শ্রমিক কিন্তু এখনো এক বছর পূর্ণ হই নাই, তাদের ব্যাপারে কি সিদ্ধান্ত নিব?

অনেকেই উপরে উল্লেখিত প্রশ্নের জবাবে হয়তো বলবেন, যাদের এক বছর পূর্ণ হয় নাই, তাদেরকে ছাঁটাইয়ের ব্যবস্থা করা যেতে পারে, ধারা-২০ অনুযায়ী।

তাহলে এবার আসুন, ধারা-২০ এর ছাঁটাই সম্পর্কে জেনে নিই: কোনো শ্রমিককে প্রয়োজন অতিরিক্ততার কারণে প্রতিষ্ঠান হইতে ছাঁটাই করা যাইবে। এখন আমার প্রশ্ন, আমরা যেই কারণে ছাঁটাই করছি আর এই ছাঁটাইয়ের সংজ্ঞার সঙ্গে এটা কতটুকু সামঞ্জস্যপূর্ণ?

আসুন আলোচনার স্বার্থে ধরে নিলাম- ফ্যাক্টরিতে লে-অফ ঘোষণা করা এবং যেসব শ্রমিক লে-অফের আওতাভুক্ত নয় তাদেরকে ছাঁটাই করা হলো, ইটস গুড। অবশ্যই একজন এইচআর কর্মকর্তা চাইবেন মালিক পক্ষকে সামনে রেখে কাজ করতে বা মালিকের স্বার্থটাকে প্রাধান্য দিয়ে কাজ করতে। নিঃসন্দেহে আমরা কোম্পানির সুবিধার কথা চিন্তা করে মালিক পক্ষকে লে-অফ বা ছাঁটাই করতে আইনগত কোনো সমস্যা নাই বলে নিশ্চিত করলাম। অবশ্যই এখানে কোম্পানি উপকৃত হয়েছে।

তাহলে আমার জিজ্ঞাসা, আমরা যারা বিভিন্ন কোম্পানির এইচআর কর্মকর্তা হিসেবে দীর্ঘদিন যাবৎ কাজ করছি, আমরা যারা মালিকের সুবিধার কথা চিন্তা করে লে-অফ বা ছাঁটাইয়ের বিষয়টি উপস্থাপন করছি, তারা কি লেবার ল অনুযায়ী শ্রমিকদের স্বার্থ সম্পর্কিত অন্যান্য বিষয়গুলো মালিকের সামনে উপস্থাপন করেতে পেরেছি? বিশেষ করে শ্রমিকের দেনা পাওনার বিষয়গুলো। এই সম্পর্কিত সাধারণ কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় তুলে ধরলাম:

  • আমরা কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকদের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার বিষয়টি শতভাগ নিশ্চিত করতে পেরেছি কিনা? (ধারা-৫,৬,৭,১২)
  • শ্রমিকদের ফাইনাল সেটেলম্যান্ট টা আমরা লেবার ল অনুযায়ী করতে পারছি কিনা ? (ধারা- ১৯,২০, ২২,২৩, ২৪, ২৬, ২৭, ২৮, ৩০, ৯৯, ১৫০, ১৫১ ও অন্যান্য)
  • আমরা শ্রমিকের অর্জিত ছুটি (EL) লেবার ল অনুযায়ী দিতে পারছি কিংবা দিচ্ছি কিনা? (ধারা-১১৭)
  • আমরা মাতৃত্বকালীন ছুটি (ML) লেবার ল অনুযায়ী দিতে পারছি কিনা? (ধারা-৪৬,৪৭,৪৮)
  • আমরা প্রযোজ্য ক্ষেত্রে গ্রুপ ইনস্যুরেন্স নিশ্চিত করতে পারছি কিনা? (ধারা-৯৯)
  • আমরা শ্রমিকদের জন্য প্রভিডেন্ট ফাণ্ডের ব্যবস্থা করতে পেরেছি কিনা? (ধারা-২৬৪ উপধারা-১০)
  • মাস শেষে আমরা লেবার ল অনুযায়ী শ্রমিকদের বেতন-ভাতা নিশ্চিত করতে পারছি কিনা? (ধারা-১০৮, ১২৩)

এছাড়াও লেবার ল অনুযায়ী শ্রমিকদের জন্য বেশ কিছু সেবামূলক কাজ রয়েছে, যা মালিক পক্ষ কর্তৃক প্রদেয়, যেমন: ক্যান্টিনের ব্যবস্থা, চাইল্ড কেয়ার রুম, বিশ্রামাগারের ব্যবস্থা, মেডিকেল রুমসহ অন্যান্য বিষয়সমূহ নিশ্চিত করতে পেরেছি কিনা?

বিশেষ করে, এই মহামারীর সময় যখন অনেক শ্রমিকের ঘরে খাবার নাই, এমন অবস্থায় আমরা কি পেরেছি গত (মার্চ) মাসের বেতন-ভাতা সম্পূর্ণ পরিশোধ করতে? (উল্লেখ্য যে, অনেক প্রতিষ্ঠানে ফেব্রুয়ারি ২০২০ সালের বেতন-ভাতার জন্য শ্রমিকদের অন্দোলন চলছে, যা বিভিন্ন মিডিয়ার তথ্যের ভিত্তিতে জানতে পারি।)

এই লেখাটি কাউকে জ্ঞান দেয়ার জন্য নয়, বরং দেশ তথা বিশ্বের এই ক্রান্তিলগ্নে আমরা যাতে শ্রমিক, মালিক ও দেশের কথা চিন্তা করে একটা যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত নিতে পারি, সেই কথা বলাই আমার মূল উদ্দেশ্য।

আমরা জানি না, ঠিক কতদিন আমাদেরকে এই সময়ের মধ্য দিয়ে যেতে হবে! এই আধার কাটিয়ে আমরা হয়তো আলোর দেখা একদিন ঠিকই পাব ইনশাল্লাহ। আমাদেরকে কিন্তু আবার নতুন করে সব কিছু শুরু করতে হবে। সেই শুরুটা যেন এখনকার ভুলের কারণে নষ্ট না হয়ে যায়, সেটা আমাদের খেয়াল রাখতে হবে। ভবিষ্যতে আমাদের যেন মনে না হয় যে, ওই সময় লে-অফ বা ছাঁটাইয়ের সিদ্ধান্ত নেয়াটা আমাদের ভুল ছিল। শ্রমিক, মালিক ও ভবিষ্যৎ ব্যবসার কথা মাথায় রেখে, মালিক তার শ্রমিকদের প্রাপ্যটুকু বুঝিয়ে দিয়ে যেন ব্যবসাটাকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

আমাদের মনে রাখতে হবে, সরকার বা দেশের একার পক্ষে সবার দায়িত্ব নেয়া সম্ভব নয়। আমারা যাদেরকে আজ আইনের দোহায় দিয়ে ছুড়ে ফেলে দিচ্ছি, তাদের কথাও আমাদেরকে চিন্তা করতে হবে। না হলে দেশ একটা ভয়ংকর সময়ের মুখোমুখি হবে, তখন আমি আপনি সবাই এর শিকার হব। আপনারা অনেকেই জানেন ইতোমধ্যে একটি ডায়ালগ বেশ ভাইরাল হয়েছে ‘পাইলে মানুষও খাইয়াফালামু’।

মালিক ও শ্রমিকদের সুসম্পর্ক বজায় রাখতে বহুদিন থেকে আমরা কাজ করে আসছি, আমার ধারণা বর্তমানে একটি সুন্দর সিদ্ধান্তই পারে মালিক ও শ্রমিক পক্ষের সম্পর্ক সুদৃঢ় করতে।

প্রসঙ্গক্রমে বলা যায়, মাকিল পক্ষ প্রায়ই শ্রমিকদের কর্মক্ষমতা নিয়ে অসন্তুটিতে ভোগেন। হাস্যকর কিন্তু প্রসঙ্গগত একটি উপমা দেয়া যেতে পারে: আমার এক সহপাঠীর ভাষ্যমতে, সব স্বামীই ক্যাটরিনা, দিপিকা কিংবা ঐশ্বরিয়ার মত বউ চায়, কিন্তু তারা মোটেও ধারণা রাখে না যে, সেই নায়িকাদের ফিটনেস ধরে রাখতে মাসিক কত টাকা খরচ হয়।

উল্লেখ্য যে, যারা আজকে লে-অফ ও ছাঁটাইয়ের বিষয়ে লেবার ল এর উদ্ধৃত দিয়ে মালিক পক্ষকে পরামর্শ দিচ্ছেন, আমার জিজ্ঞাসা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে শ্রমিকের দেনা-পাওনা সম্পর্কিত নিষ্পত্তিগুলো লেবার ল অনুযায়ী দিতে পারবেন তো?

আমি বিজ্ঞজনদের কাছ থেকে, বিশেষ করে যারা দীর্ঘদিন যাবৎ মানবসম্পদ ও প্রশাসন বিভাগে কর্মরত আছেন তাদের কাছ থেকে সময় উপযোগী, সুচিন্তিত ও ফলপ্রসূ পরামর্শ আশা করছি। যাতে এই খারাপ সময় পার করার পর আমরা ভবিষ্যৎ বাংলাদেশকে সুন্দরভাবে গড়ে তুলতে পারি।

লেখক: প্রাক্তন শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
উপ-ব্যবস্থাপক (মানব সম্পদ, প্রশাসন ও কমপ্লায়েন্স বিভাগ)
রানার ফুটওয়্যার লিমিটেড।

Share this news on:

সর্বশেষ

img
কুমিল্লায় নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের ৪৪ নেতাকর্মীকে আটক করেছে পুলিশ Nov 16, 2025
img
পুলিশকে কামড়ে পালিয়েছেন ছাত্রদল নেতা Nov 16, 2025
img
শেখ হাসিনার রায় আগামীকাল, সরাসরি সম্প্রচার করবে বিটিভি Nov 16, 2025
img

বাংলাদেশ দূতাবাস, মানামা

বাহরাইন প্রবাসীদের জন্য বিশেষ সচেতনতামূলক মোবাইল কনস্যুলার ক্যাম্পের আয়োজন Nov 16, 2025
img
ভোটারদের কেন্দ্রে আনা ও নিরাপদ নির্বাচনি পরিবেশের জন্য দলগুলোর সহযোগিতা গুরুত্বপূর্ণ: সিইসি Nov 16, 2025
img
ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নিচে সবুজায়ন করবে ডিএনসিসি Nov 16, 2025
img
১৫০ কিমি গতিতে বোলিং করতে পারি: শাহীন আফ্রিদি Nov 16, 2025
img
বাংলাদেশ এক পা এগোলে, পাকিস্তান দুই পা এগিয়ে আসবে: মাওলানা ফজলুর Nov 16, 2025
img
যুক্তরাজ্যে স্থায়ী নাগরিকত্ব পেতে সময় লাগবে ২০ বছর! Nov 16, 2025
img
যারা একসময় মজলুম ছিল, তারা এখন জালিম সাজছে: তথ্য উপদেষ্টা Nov 16, 2025
img
মিঠুনদা আমার বাবার মতো: দেব Nov 16, 2025
img
নিজের প্রতি বিশ্বাসই শাহরুখকে কিং করেছে: শিল্পা শেট্টি Nov 16, 2025
img
ইরান ভয়াবহ সংকটে, মসজিদে দোয়া Nov 16, 2025
img
রাজধানীর নিউ ইস্কাটনে ককটেল বিস্ফোরণে পথচারী আহত Nov 16, 2025
img
অনিয়মের প্রমাণ পায়নি বিসিবি Nov 16, 2025
img
বৈষম্য দূর করতে প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ: সেলিমা রহমান Nov 16, 2025
img

জাতীয় সংসদ নির্বাচন

৬টি দলের সঙ্গে ইসির সংলাপ শুরু Nov 16, 2025
img

মো. ফখরুল ইসলাম

‘তারেক রহমান প্রধানমন্ত্রী হলে নোয়াখালী হবে সিঙ্গাপুর’ Nov 16, 2025
img
সিলেট শহীদ শামসুদ্দিন হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্সে মধ্যরাতে আগুন Nov 16, 2025
img
স্কুলের গুরুত্ব তখনই বোঝা যায়, যখন আমরা স্কুল থেকে বেরিয়ে আসি: সোনাক্ষী সিনহা Nov 16, 2025