সুইসাইড নোট খুঁজতে খুঁজতে সাহিত্য হয় অপাঙক্তেয়

পৃথিবীর বুকে মানবজীবন নতুনভাবে বিপর্যস্ত। তাই, সময়ের কড়িকাঠে শহীদ আবার শিল্প-সাহিত্য। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেই বহুল ব্যবহৃত বাণী আরেকবার মনে পড়ে যায়- “দেখো, দুটি ডাল-ভাতের সংস্থান না রেখে বাংলাদেশে কেউ যেন সাহিত্য করতে না আসে”। সম্প্রতি প্রয়োজনীয় ও অপ্রয়োজনীয় বিষয়বস্তুর মধ্যে তালিকাবিন্যাস করে দেখানো আরম্ভ হয়েছে, করোনা-পরবর্তী বিশ্বে শিল্পকেন্দ্রিক পড়াশুনা তথা উচ্চশিক্ষা কতটা ‘অপ্রয়োজনীয়’।

অবশ্য আন্তর্জাতিক প্রেক্ষিতে এই স্তরবিন্যাস অনেকদিন আগে থেকেই ঘটে চলেছে। নবীন প্রাণ জীবনের প্রথম সম্পূর্ণ বাক্যটা উচ্চারণ করবার আগেই জেনে গেছে, কোনো বিষয়ে পড়াশুনা করা তাঁর মানা। মা-বাবাদের উপর দায় চাপানো যায় না, তাঁদের প্রত্যুত্তর তৈরি- যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হবে। অতএব, যা তোমার তথাকথিত ‘সুরক্ষা’-র ধারণার পরিপন্থী, তাকে গোড়াতেই সমূলে বিনাশ কর।

স্বপ্ননির্মাণের জৈবিক ধারায় বিশ্বাস রেখো না, বরং যুগের হাওয়াকে গায়ে মেখে স্বপ্নকেও সেদিকে চালিত করতে হবে। ঘুমপাড়ানি গান শোনানো হবে ঠিকই, খানিক সুকুমার রায়ও সই অথবা নিদেনপক্ষে ‘টুনটুনির গল্প,’ ‘ক্ষীরের পুতুল,’ ‘বুড়ো আংলা’। তারপর সদ্য ফোটা কুঁড়িটি যদি সুকুমার রায়ে বিভোর হতে আরম্ভ করে, তার বেঁচে থাকার নির্যাস পেতে বিশ্বের বিশাল শিল্পভাণ্ডারের কাছে আত্মসমর্পণে ইচ্ছুক হয় তখনই পরিবারে বিপর্যয় নেমে আসে। স্বপ্নের ইমারত ধসে পড়ে যেন। উপার্জন, নিজের পায়ে দাঁড়ানো, অন্যের দায়িত্ব নেওয়া- সমস্তটার ভ্রূকুটি একসময় স্বপ্নটাকে মেরে ফেলে অথবা অন্তর্বাহিনী করে দেয়।

কাছের মানুষ সরে যায়, পরিজন মুখ বেঁকায়, স্বল্প সম্বলের মেয়েটা বা ছেলেটা ভাষার বা সুরের সাধনায় ডুব দেবে কি, বড় ঝাঁপটা দেওয়ার আগেই দেখতে পায় নির্বন্ধ উজানের জায়গায় তার সামনে কেবল বাঁধ আর বাঁধ। তখন সে নিজের পারগতাকে প্রশ্ন করতে থাকে, রোজ একই প্রশ্ন করতে করতে আর উত্তর না পেতে পেতে সে বুঝে যায় সে পাল্টে যাচ্ছে, তার মরিয়া স্বপ্ন-তলোয়ারের ধার একটু একটু করে কমে যাচ্ছে। এই নকশার ব্যতিক্রম নিশ্চয়ই আছে, কিন্তু নিছক ‘ব্যতিক্রম’ হিসেবেই আছে।

শিল্প-সাহিত্যের প্রথাগত সাধনা চোখের সামনে ঠিক কেমন করে কবে থেকে সক্ষম শ্রেণীর ‘বিলাসিতা’ হয়ে দাঁড়াল বোঝা যায় না। মানুষ আজকের ভাষাকে, অভিব্যক্তিকে, শ্রুতিমধুর অথবা শ্রুতিকটু যাবতীয় সাধারণ ভাবপ্রকাশকে গভীরতাবিহীন বলে আগেই ধরে নিয়েছে। একটুকরো সৎ শিল্পের পিছনে কত বিনিদ্র রজনী, কত কান্না যে জমে তার খবর কে রাখে। যদিও, শিল্প নিয়ে যারা বাঁচেন তাঁরা এই মনস্তাত্ত্বিক সংকটকে মোচন করার চেষ্টা করেন তাঁর শিল্প দিয়েই।

কিন্তু, যে সাহিত্যিক তৈরি হতে চলেছে, যে জানে তার ভালো লাগার সাথে জ্ঞানার্জনকে সমতারে বাধতে হবে; তাই তার সময় লাগবে, ভরসা লাগবে, আত্মবিশ্বাস লাগবে। অন্য ‘প্রয়োজনীয়’ বিষয়ের পড়ুয়ার যা যা লাগে তারও ঠিক তাই তাই লাগবে, বরং তার লড়াই কঠিন বলে আরও বেশী করে লাগবে। সে অভাগা হয়তো মানিয়ে নেবে যখন ‘আগন্তুক’ ছবির উৎপল দত্ত বলবেন- ‘আমি অবশ্য ওটাকে স্ট্রাগল বলি না, বলি মগজের পুষ্টি, মাংসপেশির পুষ্টি আর মানুষ চেনার পথে প্রথম পদক্ষেপ’। কিন্তু রোজ এই কথা তার কানে বাজাবে কে, সে নিজে ছাড়া?

ভাষার যে একটা যাত্রাপথ আছে, আজকের ভাবপ্রকাশের পিছনে অতীতের অযুতসংখ্যক সাধকদের যে আত্মবিসর্জন আছে, তালিকা বানানোর সময়ে আমরা তা ভুলতে বসি। সম্মিলিত স্মৃতির বয়ানের কাছে ব্যক্তিগত একগুঁয়েমি হার মেনে যায়। অন্য পেশা হল ‘সঠিক’ জীবনধারণের উপায়, আর যে দু-চারটি প্রাণ শিল্প-সাহিত্যে আগ্রহী থেকে সেই রাস্তায় অর্থনৈতিকভাবে সফল হতে পারবে তারা হল ‘ব্যতিক্রম’।

এই মাপকাঠি যারা তৈরি করছেন, তাঁরা ঘুণাক্ষরেও একথা ভাবছেন না যে বিনোদনবাচক শিল্পের মধ্যেও যেখানে সততা আছে, সেখানে শ্রমও আছে অসীম। কবিমাত্রেই তাঁকে দারিদ্র্যের সাথে লড়ে যেতে হবে এমন নিদান কেউ ঠিক করে দেয়নি। অথচ, সাহিত্য নিয়ে পড়াশুনা হয়ে দাঁড়িয়েছে বিলাসিতা। শিল্পীমাত্রেই থাকবে দারিদ্র্যের গল্প। শিল্পীমনের দরজা-জানালা খুলে রাখা প্রয়োজন, নয়তো সে মনে জৈবিক উপায়ে শিল্পের ধারা প্রবাহিত হতে পারে না। ব্যক্তিগতকে উদযাপন করতে হলেও সাহিত্যিককে নৈর্ব্যক্তিক হতে হয় তার ভাষার কাছে।

কিন্তু অস্তিত্বসংকটের মধ্যে পড়ে, ‘অপ্রয়োজনীয়’ কুশপুতুল পুড়িয়ে চলেছে ভেবে সাহিত্যিক যদি কলম তুলে নেয়? তারপর জীবনপ্রবাহে জড়িয়ে গিয়ে ভাষার সাধনা থেকে কয়েক ক্রোশ দূরে ছিটকে পড়ে? তবে প্রকৃতির সাথে মানুষের বন্ধন রচনা করবে কে? সম্পদে বা বিপদে, মানুষের বিভিন্নতাকে উন্মুক্ত করবে কে? প্রাতিষ্ঠানিক ইতিহাসের তাঁবেদার হয়ে সব মানুষ ক্রমশ ‘প্রজাতি’ হয়ে উঠবেন। তাঁদের আলাদা আলাদা বুলি, ভাবপ্রকাশ, অকথিত ভাষ্য বিবৃত না হতে হতে আদতে আমরা মানুষকেই হারাব না তো?

মূল প্রশ্ন হল, বিজ্ঞান ও শিল্পের মধ্যে একরকম যুদ্ধবৎসল সম্বন্ধ অনিবার্য ছিল কিনা। প্রযুক্তি-নির্ভর বিশ্বে জীবিকার ধারণা ক্রমশ বদলে যাচ্ছে। রাখঢাক না রেখেই বলা যায়, শিল্প-সাহিত্যের গঠনশৈলীর মধ্যে জীবিকা উৎপাদনের কাঠামো অনুপস্থিত। সীমিত সংখ্যক সুরক্ষিত জীবিকা অর্জনের সম্ভাবনা যেটুকু রয়েছে তা যেমন সময়সাপেক্ষ তেমনই প্রতিযোগিতা কেন্দ্রিক।

তা সত্ত্বেও বলতে হয়, শিক্ষাব্যবস্থাকে সর্বতোভাবে আন্তর্বিষয়ক (Interdisciplinary) করে তোলার চেষ্টায় খামতি ক্রমশ বাড়ছে বিংশ শতক পেরিয়ে একবিংশ শতকে। গ্রাম-শহরের ব্যবধানের মতোই শিল্প ও বিজ্ঞানের যোজনব্যাপী ব্যবধান তৈরি হচ্ছে; অথচ তা বড় বৈজ্ঞানিক যখন তাঁর গবেষণাকে ভাষায় প্রকাশ করেন সেই মুহূর্তে সাহিত্যিকের ভাষাবিজ্ঞান আর বৈজ্ঞানিকের ভাষাবিজ্ঞানের মধ্যে সেতুবন্ধন হয়। ভাবপ্রকাশের উত্তরঙ্গ ক্ষণে দু’জনেই খোঁজ করেন তাঁদের প্রার্থিত ভাষাকে। আইজাক নিউটনের ‘প্রিন্সিপিয়া ম্যাথেমেটিকা’ (১৬৮৭), চার্লস ডারউইনের ‘অরিজিন অফ স্পিসিস’ (১৮৫৯), জগদীশচন্দ্র বোসের লেখার মতো পৃথিবীব্যাপী অজস্র উদাহরণ রয়েছে যেখানে সাহিত্যের কাঁধে হাত রেখে বিজ্ঞানের অভ্যুত্থান হয়।

অধ্যাপক টমাস হেনরি হাক্সলে উনিশ শতকের শেষার্ধে তাঁর “দ্য কানেকশন বিটুইন সায়েন্স অ্যান্ড আর্টস অ্যান্ড লিটারেচার” (The Connection between Science and Arts and Literature) (১৮৮৭) শীর্ষক বক্তৃতায় বলেছিলেন, “আমি মনে করি শিল্পী তথা যেকোনো সৃষ্টিশীল মানুষের কাজ হল কল্পনার নিত্যনতুন বয়ান তৈরি করা, যে সমস্ত বয়ানের দিকে প্রশান্তির সাথে বারবার ফিরে তাকানো যায়। যে মনস্তত্ত্ব নিয়ে শিল্পকে আপন করা যায়, সেই একই মনের প্রতি কোষ্ঠে সামঞ্জস্য আনতে, যুক্তিবোধ সঞ্চার করতে সর্বোপরি স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে বিজ্ঞানের প্রয়োজন। মানবতার উত্তরণের জন্য শিল্প, বিজ্ঞান, সাহিত্য- তিনটিরই সমান অবদান থাকা দরকার। একটি নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে যিনি বিশেষজ্ঞ, তাঁকেও সমৃদ্ধির জন্য বাকি দুটির দিকে তাকাতেই হয়”।

যদিও বক্তৃতার শেষে তিনি শঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন যে আগামী দিনে বিজ্ঞানের একাধিপত্যের কাছে শিল্প-সাহিত্য অবদমিত হতে পারে। বিজ্ঞান-শিল্প-সাহিত্যকে নির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত না করলেও ফরাসী তাত্ত্বিক মিশেল ফুকো তাঁর ‘discourse’ বা ‘founders of discursivity’ সংক্রান্ত আলোচনায় অনেকটা একই ধরনের মেলবন্ধনের কথা বলতে চেয়েছিলেন। যেখানে তিনি কার্ল মার্ক্স বা সিগমুণ্ড ফ্রয়েডের দৃষ্টান্ত টেনে বুঝিয়ে দেন- এঁরা বিজ্ঞান ও শিল্প দুই ক্ষেত্রেই ভবিষ্যতের জন্য বিপুল পরিমাণ আকরিকের যোগান দিয়ে গিয়েছেন।

বর্তমানের চাপে ভবিষ্যতের আকার কেমন হবে তা অনুধাবন করা প্রত্যেক যুগে কঠিন থেকে কঠিনতর হচ্ছে। শিল্প-সাহিত্যকে অবজ্ঞা করলে ভবিষ্যতে ভাবের বিশ্বে যে যান্ত্রিকতা তৈরি হবে সেই যান্ত্রিকতায় হারিয়ে যাবে আমাদের একক চিন্তার রসদ। উৎপাদন পুরোপুরি হয়তো বন্ধ করা যাবে না। কিন্তু শৈশব থেকে কৈশোরের পথে পা বাড়ানো নবমুকুলের শিল্পপ্রীতি অভিভাবকের মনে আতঙ্ক বাড়িয়ে তুলবে।

উপমহাদেশের যৌবন এমনিতেই আর্থিক দৈন্যের কাছে মাথা নত করে আছে। পড়াশুনা চালিয়ে যাওয়ার জন্য কত কত আত্মত্যাগের কাহিনী জন্মাচ্ছে অথবা হারিয়ে যাচ্ছে রোজ। তার উপর হৃদয়ের তন্ত্রে যে পড়াশুনার সুর বেজে ওঠে, যে বিষয়বস্তু জীবিকার নিশ্চিন্তি দেয় না, সেই রাগের সাধনায় ত্যাগ আরও বেশী। তাই যাঁদের সামাজিক সামর্থ্য আছে, শিল্প-সাহিত্যের প্রাসঙ্গিকতাকে প্রচ্ছন্ন না রেখে স্পষ্টতর করার দায় থেকে যায় তাঁদের।

দৈনন্দিন যাপনের সাথে শিল্প-সাহিত্য কেমন করে শৃঙ্খলাবদ্ধ হয়ে আছে তাকে চিহ্নিত করতে হবে, বারবার। নতুন প্রজন্ম কেবল জসিমুদ্দীনের কৃচ্ছ্রসাধনের আলেখ্য জানবে না, এই প্রাসঙ্গিকতার বোধকেও হৃদয় দিয়ে জানবে। তারা বুঝবে, যে সমাজ আত্মহত্যার পরমুহূর্তেই ‘সুইসাইড নোট’-এর খোঁজ করে সেই সমাজ আর যাই হোক, শিল্প-সাহিত্যকে স্রেফ বিনোদনমূলকের তকমা এঁটে তাকে সাজিয়ে রাখতে পারে না।।


লেখক: তুলনামূলক সাহিত্যকেন্দ্রের গবেষক, বিশ্বভারতী

Share this news on: