গাড়িচাপা দিয়ে ‘সাহেদ’র হাসপাতালে নিলেই চালক পেত আট হাজার টাকা!

রিজেন্ট গ্রুপ ও রিজেন্ট হাসপাতাল লিমিটেডের চেয়ারম্যান সাহেদ করিম ওরফে মো. সাহেদ। নমুনা পরীক্ষা ছাড়াই করোনার ভুয়া রিপোর্ট দেওয়া, লাইসেন্সের মেয়াদ না থাকাসহ নানা অভিযোগে তার মালিকানাধীন বেসরকারি রিজেন্ট হাসপাতালের উত্তরা ও মিরপুর শাখা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সাহেদের সহযোগী তরিকুল ইসলাম শিবলীসহ আট কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আট কর্মীকে জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া বিভিন্ন তথ্য যাচাই করা হচ্ছে। ছায়া তদন্ত করছে র‌্যাব। তদন্তের সূত্র ধরে শনিবার তার কার্যালয়ে তল্লাশি চালিয়ে পাসপোর্ট ও একটি কম্পিউটারের হার্ডডিস্কসহ কিছু আলামত জব্দ করা হয়।

তবে এখনও ধরাছোঁয়ার বাহিরে সাহেদ। তবে এরই মধ্যে বেরিয়ে আসছে সাহেদের অভিনব কায়দায় প্রতারণার অনেক তথ্য।

হাবিব গ্রুপের একটি অঙ্গপ্রতিষ্ঠান রিজেন্ট এয়ারওয়েজকে সাহেদ করিম তার গ্রুপের বলে প্রচার করতেন। এছাড়া ‘রিজেন্ট হাবিবগ্রুপ’ নামে চট্টগ্রামের একটি কোম্পানির কক্সবাজারের জমিতে টাঙানো সাইনবোর্ডের সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলে ফেসবুকে ‘ফিল্ড ভিজিট’ বলে প্রচার করেছেন সাহেদ। এছাড়া টাকার বিনিময়ে পরিচিত চালকদের দিয়ে পথচারীকে গাড়িচাপা দেওয়াতেন সাহেদ, তারপর চাপা খাওয়া সেই পথচারীকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে চালক পেতো আট হাজার টাকা। আর আহত ব্যক্তি নিয় সাহেদ করতেন বানিজ্য। সাহেদের প্রতারণার জালে আটকা ছিল রিকশাচালকরাও।

তদন্তসংশ্লিষ্ট ও ভুক্তভোগী সূত্রে জানা গেছে, হাবিব গ্রুপের একটি অঙ্গপ্রতিষ্ঠান রিজেন্ট এয়ারওয়েজ দেশের পুরনো বেসরকারি বিমান পরিবহন সংস্থা। প্রতারণার দায়ে অভিযুক্ত সাহেদ করিম এই এয়ারওয়েজ তার গ্রুপের বলে প্রচার করতেন। তার অপকর্ম ফাঁস হওয়ার পর রিজেন্ট এয়ারওয়েজ কর্তৃপক্ষও বিব্রত। তারা সাহেদের এই প্রতারণার বিচার চেয়েছেন।

রিজেন্ট এয়ারওয়েজ ব্র্যান্ড অ্যান্ড কমিউনিকেশন কো-অর্ডিনেটর আবদুল্লাহ আল মুকিত বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে নামের মিল থাকায় বিতর্কিত একটি হাসপাতালের সঙ্গে রিজেন্ট এয়ারওয়েজের সম্পৃক্ততা নিয়ে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে। হাবিব গ্রুপ চট্টগ্রামভিত্তিক একটি স্বনামধন্য শিল্পপ্রতিষ্ঠান, যা ১৯৪৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে রিজেন্ট এয়ারওয়েজের সঙ্গে রিজেন্ট হাসপাতাল বা রিজেন্ট গ্রুপের কোনো সম্পৃক্ততা নেই।

সূত্র জানায়, ‘রিজেন্ট গ্রুপ’ নামে চট্টগ্রামের একটি কোম্পানি আছে, যেটি ১৯৮৮ সালে রেজিস্টার্ড অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানি থেকে নিবন্ধন করা। কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার জালিয়াপালং ইউনিয়নের ইমামের ডেইল এলাকায় চট্টগ্রামের রিজেন্ট গ্রুপের সাইনবোর্ড লাগানো কিছু জমি রয়েছে। সেই জমির সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলে নিজের ফেসবুক পেজে আপলোড করে তা নিজের দাবি করেন। বাস্তবে তা চট্টগ্রামের রিজেন্ট গ্রুপের মালিক সাবেক রাষ্ট্রদূত চট্টগ্রামের গোলাম আকবর খন্দকারের। একই নামে সাহেদ কিভাবে একটি প্রতিষ্ঠান খুললেন, তা তদন্তের দাবি জানিয়েছেন চট্টগ্রামের রিজেন্ট গ্রুপসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

পুলিশ ও র‌্যাবের তদন্ত সূত্র জানায়, হাজার কোটি টাকার প্রতারণা ও জালিয়াতিতে অভিযুক্ত সাহেদের কবল থেকে দরিদ্র রিকশাচালকরাও রেহাই পায়নি। সাহেদের কার্যালয়ে প্রায় ৫০০ রিকশার লাইসেন্স পাওয়া যায়। তুরাগের হরিরামপুর ইউনিটের চেয়ারম্যান ও সচিব স্বাক্ষরিত লাইসেন্সগুলো সাহেদের নামে ইস্যু করা। উত্তরা ও তুরাগ এলাকায় চলা রিকশার জন্য এই লাইসেন্স দিতেন সাহেদ। এ জন্য রিকশাচালকদের কাছ থেকে প্রথমেই দুই হাজার টাকা এবং প্রতি মাসে ৫০০ টাকা হাতিয়ে নিতেন সাহেদ। কেউ টাকা না দিলে ভয় দেখাতেন, নির্যাতনও করতেন।

অনুসন্ধানে সাহেদের প্রতারণার আরেকটি ভয়ঙ্কর তথ্য পেয়েছে তদন্তসংশ্লিষ্টরা। জানা গেছে, রাজধানীর উত্তরা এলাকায় কয়েকজন গাড়িচালকের সঙ্গে চুক্তি ছিল সাহেদের। তারা রাস্তায় ঘুরে ঘুরে পথচারীকে চাপা দিয়ে রোগী বানিয়ে গাড়িতে করে তার মালিকানাধীন রিজেন্ট হাসপাতালে রেখে চলে যেত। এভাবে একজন রোগী রেখে দিতে পারলে তাকে দেওয়া হতো আট হাজার টাকা করে। আর অচেতন অবস্থায় রোগীকে হাসপাতালের আইসিইউতে ঢুকিয়ে তার স্বজনদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা আদায় করতেন সাহেদ।

কয়েকজন চালককে টাকার লোভ দেখিয়ে সাহেদ এই ভয়ংকর অপকর্ম চালাচ্ছিলেন বলে পুলিশ ও র‌্যাবের তদন্তকারীর কাছে কয়েকজন ভুক্তভোগী এই অভিযোগ করেছেন।

তারা বলেন, সাহেদের হয়ে রিজেন্ট হাসপাতালে জনসংযোগ কর্মকর্তা তারেক শিবলী এ লেনদেন করতেন। আইসিইউয়ের প্রয়োজন নেই সামান্য আহত এমন কয়েকজন রোগীকে দ্রুত আইসিইউতে নিয়ে আটকে রেখে তাদের কাছ থেকে দুই লাখ টাকা আদায় করায় স্বজনরা সন্দেহ করেন। পরে দুর্ঘটনার জন্য দায়ী এবং হাসপাতালে বহন করে নিয়ে যাওয়া চালকদের সঙ্গে রিজেন্ট হাসপাতালে যোগাযোগের তথ্য পান ভুক্তভোগীরা।

তবে রোববার পর্যন্ত এসব অপকর্মে মূল হোতা সাহেদ করিমকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্যরা।

এ বিষয়ে র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আশিক বিল্লাহ বলেন, ‘রিজেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান সাহেদকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। র‌্যাবের গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। সাহেদের অবস্থান নিশ্চিত করতে র‌্যাবের একাধিক টিম কাজ করছে। আশা করি দ্রুতই তাকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হবে।

রোববার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আইন-শৃঙ্খলাবিষয়ক সভা শেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, রিজেন্টের সাহেদ করিমের বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তাকে আত্মসমর্পণ করতে হবে। অন্যথায় গ্রেপ্তার করা হবে। সূত্র: কালেরকণ্ঠ

উত্তরার পর রিজেন্ট হাসপাতালের মিরপুর শাখাও সিলগালা

রিজেন্টের মালিক সাহেদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা

 

টাইমস/এইচইউ

Share this news on: