কুয়েত মৈত্রী হসপিটাল থেকে লিখছি: করোনার সাথে বসবাস (পর্ব-৪)

ভোর বেলা উঠে আব্বাকে ফ্রেশ করে গারগেল করালাম। সকাল পৌনে ৮ থেকে ৮ টার মাঝে এখানে নাস্তা দিয়ে গেলো। প্রতিদিন এই সময়েই দেয়। নাস্তার মেন্যুও প্রতিদিন সেইম। তিন পিস পাউরুটি, একটি কলা ও একটি ডিম। ডিম এখানে তিন বেলা দেয়, এটাই নাকি ওষুধ হিসাবে কাজ করে। আমরা বাসা থেকে জেলি নিয়ে এসেছিলাম। সব মিলিয়ে নাস্তা করে নিলাম। সকাল ১০টার দিকে স্যাম্পল কালেক্টর এসে আমেনার ব্লাড ও কোভিড-১৯ স্যাম্পল নিয়ে গেলো। আরেকজন এসে তাকে নিচে নিয়ে এক্সরে করালো। রুমটা একটু গুছিয়ে বাসায় ফোনে কথা বলতে বলতেই ডা. আসলো, তার সঙ্গে একজন ওয়ার্ডবয়। ওয়ার্ডবয় এসে আগেই জানিয়ে দেয় ফ্যান অফ করুন, মাস্ক পরুন। সকালে নাস্তার সাথে প্রত্যেকেই প্রতিদিন একটি করে সার্জিক্যাল মাস্ক দিয়ে যায়। আমরা মাস্ক পড়ে সবাই সবার বেডে অবস্থান করলাম। ডা. প্রত্যেকের আলাদা আলাদা খোজ খবর নিলেন, কার কি সমস্যা জেনে নিলেন। ডা. যাবার পর নার্স এসে আব্বা, মীমকে ইনজেকশন দিয়ে গেলো, আমেনাকেও কিছু ওষুধ দিলো। আব্বার টয়লেটে যাওয়াটা কমছেনা। ড. বলে গিয়েছে স্যালাইন খেতে হবে বেশী করে, এটা হবে স্বাভাবিক।

দুপুরে হাসপাতালের খাবারের পাশাপাশি বড় বোনের বাসা থেকে খাবার আসে। আমার বড় বোনের বাসা টঙ্গীতে। উত্তরা থেকে তার বাসা কাছাকাছি। মূলত এটা ফুফুর বাসা। ফুফাতো ভাইয়ের সাথে বোনের বিয়ের কারণে এটা এখন ফুফু কাম বোনের বাসায় রূপান্তর হয়েছে। বোন, ফুফু দুইজনই একটু অসুস্থ কিন্তু একজনের ভাই আরেকজনের বাবা দুই ভালোবাসা মিলে শারীরিক অসুস্থতা পাত্তা পায়নি।

এখানে খাবার দেবার সিস্টেমটা ভালো। নিচের গেইটে যে কোনো কিছু পার্সেল আকারে গ্রহণ করে। পার্সেল দেবার সময় ব্যাগে বেড নাম্বার, নাম, ফোন নাম্বারের টোকেন লাগিয়ে দিতে হয়। সিকিউরিটি গার্ড তা গ্রহণ করে রেজিস্ট্রি করে রাখে, পরে কন্ট্রোল রুমে পাঠিয়ে দেয়। কন্ট্রোল রুমে পাঠানোর পর তারা ওয়ার্ডবয়কে দিয়ে খাবার কিংবা পার্সেল বেডে বেডে পৌঁছে দেয়। একটু জলদি পার্সেল পেতে চাইলে কিংবা নিচে গেইটে দিয়ে যাবার পর আসতে দেরি করলে কন্ট্রোল রুমে ফোন দিয়ে পার্সেলের কথা বললে ওরা জলদি পাঠানোর ব্যবস্থা করে। তবে সকালের নাস্তা ৭-৭:৩০ টা, দুপুরে ১২-১২:৩০ আর রাতে ৭-৭:৩০ এ পার্সেল গেইটে পৌঁছে দিলে সহজেই পাওয়া যায়। যাইহোক এসব নিয়ম প্রথম দিন না জানায় খাবার পেতে একটু দেরি হয়। তবে আমি, মীম আর আমেনা হসপিটালের খাবার খেয়ে নেই। আব্বা একটু পর তার বোনের আর মেয়ের হাতের রান্না করা খাবার খায়। খুব বেশী খেতে চায়না, জোর করে একটু খাওয়ানো হয় তারপর শুয়ে পরে।

এভাবে ঐ দিন পার হবার পর পরের দিন নতুন কিছু সমস্যা দেখা দেয়। মীম আর আমেনাও দুর্বল হয়ে যেতে থাকে। টয়লেটের সমস্যা তাদেরও শুরু হয়। আমারতো শুরু থেকেই একটি নির্দিষ্ট সময়ে সমস্যা হয়। তবে মূল সমস্যা দেখা দিলো মাঝে মাঝে টয়লেটে পানি শেষ হয়ে যাচ্ছে। এমন সময় টয়লেটে পানি শেষ হয়ে যাওয়া মানে মরার উপর খরার ঘা এর মত। কি আর করা যাবে শেষ পর্যন্ত মিনারেল ওয়াটার দিয়ে প্রাথমিকভাবে কাজ সেরে ফেলা হলো। এখানে বারান্দায় সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মুক্তা মিনারেল ওয়াটার সকলের জন্য উন্মুক্ত থাকে। যেকোনো ভর্তি রোগী তার প্রয়োজন মত বিনামূল্যে এই পানি নিতে পারে। মূলত এখন পর্যন্ত কোভিড টেস্টের জন্য ২০০ টাকা ব্যতীত কোনো টাকা লাগেনি। সকল কোভিড রোগীদের চিকিৎসায় বিনামূল্যে করা হচ্ছে। কিন্তু ফ্রি পেয়েতো খাবার পানি এভাবে নষ্ট করা যায়না। তাই কন্ট্রোল রুমে ফোন দিয়ে সমস্যার কথা জানালে ঐদিনের মত সমস্যা সমাধান হয়।

পরের দিন একটু বুদ্ধি করে পানি থাকা অবস্থায় খালি কিছু পানির বোতল ভরে রাখি যেনো পানির সমস্যা হলে ঐগুলো ব্যবহার করতে পারি। কিন্তু সমস্যা আরেকটু ঘনীভূত হলো। আমি গতকাল ফোন দেবার পর এখানকার ম্যানেজমেন্ট পানির সমস্যাটা সমাধান করার জন্য আমাদের ওয়ার্ডের পাশের ওয়াশরুমটা তালা লাগিয়ে দিলো। নিচে কি প্লাম্বিং সমস্যা আছে তা ঠিক করাতে হবে। এখন শুরু হলো নতুন মসিবত। পাশের ওয়াশরুম বন্ধ মানে বিপরীত পাশের ওয়ার্ডের ওয়াশরুমে যাওয়া লাগবে। এটা একটু দূর হয়ে যায় বিশেষ করে আব্বার জন্য। কিন্তু সমস্যার সাথে আল্লাহ যেনো সমাধানও দিয়েছেন। কন্ট্রোল রুমে বিষয়টা জানানোর পর প্রথমে তারা আব্বাকে আমাদের ওয়ার্ডের ঠিক পাশের কেবিনে স্থানান্তর করতে চায়, ঐখানে হাই কমোডও আছে, কিন্তু একা আব্বাকে রাখা যাবেনা তাই আমি রাজী না। বিপরীত পাশের ওয়ার্ডটাও সম্পূর্ণ খালি চাইলে ঐখানেও যেতে পারি তারা বলল। কিন্তু আমি তাতেও রাজী না। কারণ কাল পরশুই টেস্টের রেজাল্ট আসলে ৭ তলার এই ফ্লোর ছাড়তে হবে তাই নতুন করে আর চেঞ্জ করা যাবেনা।

পরবর্তীতে তারা পাশের কেবিনের তালা খুলে ওয়াশরুমটাই পরিষ্কার করে দিলো। আর বলল আপনারা তাহলে শুধু ওয়াশ রুমটা ব্যবহার করেন যতক্ষণ সমস্যা সমাধান না হয়। আমরা সানন্দে তা ব্যবহার শুরু করলাম। এর মাঝে পানি আসা যাওয়ার খেলা চলল। তবে আমি এসবে মোটেও বিচলিত না। আমি খুব ভালো করেই জানি এসব সাময়িক সমস্যা ঠিক হয়ে যাবে নয়তো হেমারিং করে করাতে হবে। প্রথমে একটু কষ্ট হলেও আখেরে ফল মিঠাই হবে।

২ জুলাই দুপুর পর্যন্ত পানি আর টয়লেটের এই সমস্যা রয়েই গেলো। আব্বা ধৈর্য হারিয়ে অস্থির হয়ে যাচ্ছেন। আব্বা যতই অস্থির হোক আমাকে ততই স্থির থাকতে হবে। আমি একাই এখনো একটু বেশী সুস্থ, তাই ধীর স্থির থাকতে হবে। দুপুরের পর আমাদের কোভিড-১৯ এর রেজাল্ট আসে। স্বাভাবিকভাবে সবারই রেজাল্ট কোভিড-১৯ পজিটিভ। আব্বা যদিও আশাবাদী ছিলেন উনার নেগেটিভ রেজাল্ট আসবে।

রেজাল্ট আসার পরেই আমাদের জানিয়ে দেয়া হলো আমাদেরকে ফ্লোর শিফট করে পজিটিভ ইউনিটে পাঠাবে, সব যেনো গুছিয়ে নেই। আমরা জলদি সব গুছিয়ে নিলাম। ৫ তালার ৫২৭-৫৩২ ওয়ার্ডটি আমাদের জন্যই। ওয়ার্ডবয় ট্রলি নিয়ে এসে মালামাল সব নিয়ে গেলো। দুইবারে মালামাল শিফট করে আমরা ৫ম তলায় নতুন ওয়ার্ডে পৌঁছলাম। এখন আপাতত সব ঠিক থাকলে কমপক্ষে ১৪-১৫ দিনের জন্য এখানে সংসার পেতে বসতে হবে। এই রুম ৭ তলার রুমটা থেকে পরিষ্কার। মনে হলো আল্লাহ যা করে নিশ্চয়ই ভালোর জন্যই সময় মত আমাদের নতুন স্থানে পৌঁছে দিয়েছেন।

সব গুছিয়ে নিলাম, এখানকার বারান্দা ওয়াশরুম সবই পূর্বের রুম থেকে আরেকটু ভালো। মূলত এটা পূর্বের রুমটারই ঠিক দুই ফ্লোর নিচের সেইম আরেকটি ওয়ার্ড শুধু পরিচ্ছন্ন গোছানো একটি ওয়ার্ড। শুরু হলো নতুন আরেক জীবন। (চলবে...)

লেখক: ডিরেক্টর, ডেলটা হেলথ কেয়ার, যাত্রাবাড়ী লি.

কুয়েত মৈত্রী হসপিটাল থেকে লিখছি: করোনার সাথে বসবাস (পর্ব-৩)

 

টাইমস/এইচইউ

Share this news on:

সর্বশেষ

img
বিসিবি নির্বাচনে খেলোয়াড় প্রতিনিধি চায় কোয়াব! Sep 15, 2025
img
নয় ঘণ্টার ম্যারাথন জেরা শেষে ইডির দপ্তর থেকে বের হলেন মিমি Sep 15, 2025
img
আমরা ১৭ বছর ক্ষমতায় নাই, তবুও মানুষের পাশে থাকার চেষ্টা করেছি: শামা ওবায়েদ Sep 15, 2025
img
আদালতকেন্দ্রিক ড্রামায় শাহ্‌ বানু চরিত্রে ইয়ামি গৌতম Sep 15, 2025
img
মাঝআকাশে যাত্রীর প্রাণ বাঁচালেন রাশিয়ার স্বাস্থ্যমন্ত্রী Sep 15, 2025
রানীর মতো ফিরলেন অপু বিশ্বাস, ব্রাইডাল লুকে মুগ্ধ ভক্তরা Sep 15, 2025
‘আমি স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম’ হেনস্তা নিয়ে মুখ খুললেন সোহা Sep 15, 2025
আশা টিকে আছে! সুপার ফোরে উঠতে বাংলাদেশের সামনে তিনটি পথ Sep 15, 2025
ইউরোপে তিন পরাশক্তির জয়ের হ্যাটট্রিক Sep 15, 2025
গতকালের ঘটনার যে ব্যাখ্যা দিলেন সূর্যসেন হলের ভিপি Sep 15, 2025
৪৫বছরেও আলোর মুখ দেখেনি কুমিল্লা-ঢাকা সরাসারি রেল যোগাযোগ Sep 15, 2025
রাশিয়া জানালো, ভারত-বিরোধী যে কোনো পদক্ষেপ ফলহীন! Sep 15, 2025
img
আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের উপকরণ সংগ্রহ শুরু করেছে ইসি Sep 15, 2025
img
মহারাষ্ট্রীয় সংস্কৃতি ঘিরে আসছে শ্রদ্ধার বড় বাজেটের সিনেমা Sep 15, 2025
img
অতিরিক্ত আইজি সরদার তমিজউদ্দীন আহমেদের বিদায় সংবর্ধনা Sep 15, 2025
img
কুয়েতে পৌঁছেছেন বাংলাদেশের ব্যবসায়ী নেতারা Sep 15, 2025
img
আসন্ন দুর্গাপূজার প্রস্তুতি নিয়ে হিন্দু ধর্মীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠক Sep 15, 2025
img
বিভিন্ন দূতাবাসে বদলি প্রশাসনের ১৭ কর্মকর্তা Sep 15, 2025
img
পিআরের দাবি জানিয়ে নির্বাচন নিয়ে সংশয় তৈরি করা হচ্ছে : আশরাফ উদ্দিন Sep 15, 2025
img
ড. ইউনূসের ডানে-বাঁয়ে গণ্ডগোল, কথার ফুলঝুরি চলছে না : রনি Sep 15, 2025