কোভিড-১৯ এবং আমার শান্তিনিকেতনে থেকে যাওয়া  

কোভিড-১৯ এর ভয়াবহ প্রাদুর্ভাবের ফলে সারাবিশ্ব এখন ইতিহাসের ভয়ঙ্করতম সংকটের মধ্যে আছে। যত দিন যাচ্ছে মনে হচ্ছে যেন এর ভয়াভবহতা ততই প্রকট হচ্ছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে শুধু শারীরিক ভাবে সংক্রমিত না হয়েও মানসিকভাবে কোটি কোটি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। তার উপর মরার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে এসেছিল আম্ফান। এখন আবার বাংলাদেশ উত্তরাঞ্চলে এবং ভারতের আসামে বন্যা! সব মিলেয়ে বলা চলে ২০২০ সালের এই করুণ পরিস্থিতি কোন ভাবেই কারো কাছেই কাম্য ছিল না।

ভয়াবহতার এই সময়ে মানুষ স্বভাবতই তার পরিবারের সাথে থাকতে চায়, আমার ক্ষেত্রেও এটি ব্যতিক্রম নয়। পড়াশুনার খাতিরে আমি ভারতের পশ্চিমবঙ্গে বসবাস করছি এবং এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে আমি দেশে না ফিরে আমার প্রিয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিশ্বভারতী শান্তিনিকেতনে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। যদিও বাবা-মা চেয়েছিল আমি যেন বাড়ি ফিরি, কোভিড-১৯ এ যদি মৃত্যু থাকে তাও যেন পরিবারের সবাই এক সাথেই মরতে পারি। তবে একজন বিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে এই মহামারীর সময়ে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গাতে যাওয়া উচিত বলে মনে করিনি, তাই এখানে থেকে যাওয়া।

সেই মার্চ থেকে এখন আগস্ট অবধি এতগুলি দিন শান্তিনিকেতনেই আছি। বলতে গেলে কোভিড-১৯ এর প্রকোপের পরে পুরো পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে এখনও যদি কোনও নিরাপদ জায়গা থেকে থাকে তবে এই শান্তিনিকেতনের নাম সবার প্রথম সাড়িতে থাকবে। কারণ করোনা তার তাণ্ডব এখানে এখনও সেই অর্থে শুরু করতে পারে নি। তার দুটো কারণ; প্রথমে কঠোর লকডাউন এবং ধীরে ধীরে শান্তিনিকেতন ফাকা হয়ে যাওয়া।

লকডাউন উঠে যাওয়ার পর বিগত কয়েকদিনে বীরভূম জুড়ে কয়েকজন করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ায় বীরভূম জেলা প্রশাসন আবারও কঠোর নিয়ম-নীতি মানতে জনগণকে বাধ্য করছে। প্রতি সপ্তাহে রাজ্য সরকার ঘোষিত লকডাউন মেনে চলা হচ্ছে।

সত্যি কথা বলতে ২১শে মার্চ এর আগে আমি নিজেই ভালো করে জানতাম না লকডউন কী? হঠাৎ শুনি ২৫শে মার্চ থেকে ১৪ই এপ্রিল টানা ২১ দিন  লকডাউন। সে মোতাবেক বিশ্ববিদ্যালয়ও ছুটি হয়ে গেল।

শুরু হয়ে গেল সকলের বাড়ি ফেরার তাড়া! আমি খুব অবাক হয়ে দেখলাম আমার সব কাছের বন্ধুরা বাড়িতে ফেরার জন্য লিভ পেপারে সই করাচ্ছে। সবার মুখে একটাই কথা ছিল- বেঁচে থাকলে দেখা হবে। মানে এমন একটা মুহূর্ত তখন তৈরি হয়েছিল- সবাই বাঁচার জন্য নিরাপদ আশ্রয়ে ছুটছে।

সেদিন থেকেই শুরু হল নীরবতার প্রহর গোনা, অরশ্রী মার্কেট থেকে রতন পল্লি, শান্তিনিকেতন থেকে শ্রীনিকেতন, সব জায়গায়  যেন ছেয়ে গেল অন্ধকার শ্মশানের মত নিশ্ছিদ্র স্তব্ধতা।

লকডাউন শুরুর সময়টায় খুব কঠোর ভাবেই মেনে চলেছি বা চলার চেষ্টা করেছি। জরুরী প্রয়োজন ছাড়া তেমন বাইরে কোথাও যেতাম না। ভিড় এড়ানোর জন্য বেশিরভাগ সময়ে চেষ্টা করতাম সন্ধ্যার পরে বের হওয়ার।

তবে ওই সময়ে বাইরে বের হলে খুব অবাক হয়ে যেতাম, এক সময়ের কলরবপূর্ণ জায়গা সমূহের নিস্তব্ধতা দেখে। এ যেন এক রহস্যময় খেলা, কখন যে কোথায় আনন্দ থাকবে আর কোথায় বেদনা থাকবে, সেটা শুধুমাত্র এই খেলার আয়োজকই ভালো জানেন।

এভাবে প্রায় ১৪ দিন কেটে গেল। তারপর একদিন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বদৌলতে জানতে পারলাম বিশ্ব ভারতীর বেশ কয়েক জন শিক্ষক-ছাত্র একত্রিত হয়ে মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছে। তাদের দেখে আমি নিজেও বেশ অনুপ্রাণিত হলাম। অতঃপর তাদের সাথে যোগাযোগ করে ত্রাণ কার্যক্রমে যুক্ত হলাম আমিও।

প্রথম ত্রাণকার্যে অংশগ্রহণ করলাম ১২ এপ্রিল, সেদিন প্রায় শতাধিক মানুষকে সাহায্য করা হয়েছিল, তারপর থেকে থেকে দুই মাস বেশ ভালই কেটে গিয়েছিল ব্যস্ততায়। বাড়ি থেকে বের হতাম ঠিকই, মৃত্যু ভয়ও ছিল, কিন্তু কোথাও যেন একটা ভালো লাগা কাজ করত। শান্তিনিকেতন যদিও আমার জন্মভূমি না, আমি ভারতীয় নাগরিকও নই, তবুও মানুষ হয়ে মানুষের পাশে দাঁড়ানোটা কর্তব্য বলেই মনে হয়েছে।

আমাদের লোকবল কম হওয়ার কারণে স্বাভাবিকের তুলনায় একটু বেশি শ্রম দিতে হত।  ত্রাণ এর প্যাকেটগুলি প্রস্তুত করতে সময় লাগতো সব থেকে বেশি। সেই সাথে সেই ত্রাণ আবার আমরাই বিতরণ করতাম। সব মিলিয়ে এই কাজের প্রতি একটা ভালোবাসা জন্মে গিয়েছিল, মনে করতাম এখন এটাই আমার কাজ এটাই আমার একমাত্র দায়িত্ব।

আমরা শুধু শান্তিনিকেতনের মধ্যে আমাদের ত্রাণ কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রাখিনি। শান্তিনিকেতন বেষ্টিত যেসব গ্রাম ছিল, যেমন- কমলাকান্তপুর, রাইপুর, মির্জাপুর, বাঙালপাড়া সহ আরও অনেক গ্রামে প্রায় সহস্রাধিক মানুষের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছিলাম।

সেই দুই মাসে আরও অনেক বাংলাদেশী ভাই বোন দেশে ফিরেছে। তাদের বেশির ভাগের সাথে যাওয়ার আগে দেখা করেছি, মন খারাপও হয়েছিল ভীষণ, তবে নিজেকে কাজে ব্যস্ত রেখেছিলাম।

তবে সমস্যাটা শুরু হয়েছে ত্রাণ কার্যক্রম মোটামুটি শেষ হবার পর। তখনও বেশ কিছু সংখ্যক বাংলাদেশী ভাই বোন ছিল, আড্ডা তো দিতাম না, কিন্তু তাও ঐ চোখের দেখা, মনের ভাল লাগা।

গত এক মাসে তারাও অনেকে দেশে ফিরে গেছে। তাই বলতে গেলে আমার একাকীত্বের শান্তিনিকেতন শুরু হয়েছে প্রায় এক মাস হলো। তখন থেকেই চলছে একা বেঁচে থাকার লড়াই।

আনলক-এক হওয়ার পর, বেশ কিছুদিন বিকালবেলা সাইকেলে পুরো শান্তিনিকেতন ঘুরে বেড়াতাম। কিন্তু নতুন করে আবার করোনা শনাক্তের পর, এখন আর ঘর থেকে বেরুচ্ছি না। বলতে গেলে সারাদিনে এখন সময় কাটে মোটামুটি জেলখানার কয়েদির মতন। জেলখানার কয়েদের তাও কথা বলার মানুষ আছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে আমার পাশে সেরকম কেউ নেই। তাই সারাদিন সময় কাটে গল্পের বই পড়ে। বই এখন আমার সব থেকে কাছের বন্ধু।

যেহেতু বাইরের খাবার থেকে করোনা ছড়ানোর একটা সম্ভাবনা থেকেই যায়, তাই মার্চ মাস থেকে নিজের খাবার নিজেই তৈরি করি। সেই সাথে ইদানীং ঐ পুরনো লেখালেখির বদভ্যাস মাথায় বেশ চড়াও হয়ে উঠেছে। এখন দৈনন্দিন দিনলিপি বলতে আর কিছুই নেই। আলাদা আলাদা করে সময় ভাগ করে এখন আর কিছু করতে হচ্ছে না। মাঝেমাঝে তো এটাও ভুলে যাই আজকে কি বার বা কত তারিখ। তবুও বেঁচে থাকতে হয়, নতুন দিনের আশায়।লেখক: শিক্ষার্থী, বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, ভারত।

 

টাইমস/এসএন

Share this news on:

সর্বশেষ

img
বিশ্বকাপ সাফল্যের মূল চাবি পেলেন আনচেলত্তি Nov 16, 2025
img
ভিয়েতনামে পুল পার্টিতে আবেদনময়ী মনামী ঘোষ Nov 16, 2025
img
ভারতে বিয়ের মাত্র ১ ঘণ্টা আগে হবু বরের হামলায় প্রাণ গেল নারীর Nov 16, 2025
img
তোমায় পেয়ে আমরা আনন্দে আত্মহারা : অমিতাভ Nov 16, 2025
img
গাড়িতে আগুন ও ককটেল নিক্ষেপকারীকে গুলির নির্দেশ ডিএমপি কমিশনারের Nov 16, 2025
img
গাজীপুরে নতুন কমিশনার, ৬ জেলার এসপি বদলি Nov 16, 2025
img
মেহজাবীনের বিরুদ্ধে মামলা করা কে সেই আমিরুল! Nov 16, 2025
img
স্টারবাকস বয়কটের ডাক দিলেন মামদানি Nov 16, 2025
img
পুলিশের ঊর্ধ্বতন আরও ২৩ কর্মকর্তাকে বদলি Nov 16, 2025
img
বাংলাদেশ কী ভাবে চলবে তা স্থির করবে আগামী দিনের সংসদ সদস্যরা: মেজর হাফিজ Nov 16, 2025
img
৪৫ বাংলাদেশিসহ মালয়েশিয়ায় ১২৩ অভিবাসী শ্রমিক আটক Nov 16, 2025
img
অতিরিক্ত পরিশ্রম নয়, সুস্থতাই সাফল্য, বলছেন দীপিকা Nov 16, 2025
img
জামিন পেলেন অভিনেত্রী মেহজাবীন Nov 16, 2025
img
চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আধুনিক প্রশিক্ষণ ও পেশাদারিত্ব বাড়ানোর আহ্বান সেনাপ্রধানের Nov 16, 2025
img
চাঁদপুরে সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আটক Nov 16, 2025
আ.লীগ ইস্যুতে জাবি জিএসের কড়া হুশিয়ারি! | Nov 16, 2025
img
ওয়াশরুম ভিডিও ইস্যুতে বিতর্ক তুঙ্গে, মুখ খুললেন মিথিলা Nov 16, 2025
img
নভেম্বরের প্রথম ১৫ দিনে এলো ১৮ হাজার কোটি টাকার রেমিট্যান্স Nov 16, 2025
img
হাসিনার রায় যাই হোক সেটা কার্যকর হবে : স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা Nov 16, 2025
img
বিকিনি পরার কারণ ব্যাখ্যা করলেন মিথিলা Nov 16, 2025