'নারী কৃষকের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি চাই'

১৫ অক্টোবর আন্তর্জাতিক গ্রামীণ নারী দিবস। প্রতিবছরের ন্যায় এবারো বাংলাদেশসহ জাতিসংঘভুক্ত দেশগুলো যথাযথ মর্যাদায় এ দিবসটি পালন করবে।

বৈষম্য ও অবমূল্যায়ন নয়। রাষ্ট্রে, পরিবারে ও সমাজে নারীর কাজকর্ম, ভূমিকা ও অবদানের যথাযথ মূল্যায়ন করার লক্ষ্যে ২০০৭ সালের ১৮ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারন পরিষদের সভায় ১৫ অক্টোবর আন্তর্জাতিক গ্রামীণ নারী দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। জৈবকৃষি তথা পরিবেশবান্ধব উপায়ে চাষাবাদ, গ্রামীণ উন্নয়ন এবং খাদ্য নিরাপত্তা বা বিষমুক্ত নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনও দারিদ্র দূরীকরণের ক্ষেত্রে গ্রামীণ নারীদের অবদানের স্বীকৃতি স্বরুপ জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ তার রেজুলেশন নং ৬২/ ১৩৬ এর মাধ্যমে গ্রামীণ নারী দিবসটি উৎযাপনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এরপর ২০০৮ সাল থেকে জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলো ১৫ অক্টোবর আন্তর্জাতিক গ্রামীণ নারী দিবস হিসেবে পালন করে আসছে।

তবে এর পূর্বে ১৯৯৫ সালে গ্রামীণ নারীদের কৃষি তথা খাদ্য উৎপাদনসহ বহুমুখী কাজের স্বীকৃতির জন্য বেইজিং সম্মেলনে প্রতিবছর ‘১৫অক্টোবর’-কে আন্তর্জাতিক গ্রামীণ নারী দিবস হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়। পরবর্তীতে ১৯৯৭ সাল থেকে বিশ্বের সমগ্র গ্রামীণ নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সংগঠিতভাবে এ দিবসটি উৎযাপন করা হচ্ছে।

এবারে- ‘জৈবকৃষি তথা বিষমুক্ত নিরাপদ ফসল উৎপাদনে কিষাণীর অবদান এবং কৃষিতে নারী কৃষকের কাজের স্বীকৃতি চাই’- প্রতিপাদ্য বিষয়কে সামনে রেখে আমরা পালন করছি গ্রামীণ নারী দিবস। প্রয়োজনীয় দুমুঠো নিরাপদ খাবারের জন্য পুরো বিশ্বে জৈব বা পরিবেশবান্ধব কৃষি এখন বহুল আলোচিত ইস্যু। জৈব কৃষি এমন এক কৃষি যেখানে রাসায়নিক সার ও বালাইনাশক ব্যবহার না করে জৈব পদার্থের পুন:চক্রায়ণ। যেমন: কম্পোস্ট ও শস্যের অবশিষ্টাংশ, ফসল আবর্তন ও সঠিক ব্যবস্থাপনায় জমি চাষাবাদের মাধ্যমে মাটি ও ফসলের উত্তম অবস্থা বজায় রেখে বিষমুক্ত নিরাপদ ফসল উৎপাদন নিশ্চিত করা।

জৈব কৃষিতে রাসায়নিক সারের পরিবর্তে জৈব সার ও জৈব বালাইনাশক ব্যবহার করা। আর এ জৈব সার তৈরীর প্রধান কারিগর ও উৎস হল গ্রামীণ নারীরা। গরু-ছাগলের গোবর, হাঁস-মুরগীর বিষ্ঠা, ময়লা-আবর্জনা, প্রাণীর হাড় ও রক্তের গুড়া পঁচিয়ে কম্পোস্ট সার তৈরী এবং বিভিন্ন গাছেরপাতা ফল, ছাল, বীজ, মূল ইত্যাদি ব্যবহার করে জৈব বালাইনাশক তৈরীর কাজটিও গ্রামীণ নারীদের হাতেই শুরু হয়েছে। সুতরাং নারীরাই বিষমুক্ত নিরাপদ ফসল উৎপাদনের প্রধান সমন্বয়কারী। সৃষ্টির আদি পেশা কৃষিতথা জৈব পদ্ধতিতে কৃষি চাষাবাদ নারীর হাতেই সূচিত হয়েছে। জৈব সার ও বালাইনাশক ব্যবহার করে বিষমুক্ত নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনের জন্য যে কৃষি আবাদ তা নারীদের মাধ্যমে বিকাশ ঘটেছে।

রাইট টু ফুড এ্যান্ড নিউট্রিশন ওয়াচ ২০১৯ এর তথ্যমতে, বিশ্বব্যাপি যে পরিমাণ সবজি উৎপাদিত হয় তার প্রায় ৮০ ভাগই আসে গ্রামীণ নারীদের মাধ্যমে উৎপাদিত পারিবারিক কৃষি বা হোম গার্ডেন হতে যার সম্পূর্ণটাই জৈব বা বিষমুক্ত ও নিরাপদ।

আমাদের দেশের নারীরা গৃহস্থালির কাজ ছাড়াও শাক-সবজি চাষ (৪০ ভাগ), হাঁস-মুরগী পালন, গবাদি পশুপালন (৭৪ ভাগ) এবং মাঠে ফসল উৎপাদনের জন্য জমি তৈরি করা, জমিতে বীজ বপন, সেচ দেয়া, চারা রোপন, সার কীটনাশক ছিটানো, ফসল কেটে ঘরে তোলাসহ সকল কাজই করছেন। অনেক সময় নারীরা পুরুষের চেয়েও বেশি কাজ করে।

কর্মজীবী নারীর পরিসংখ্যান মতে, কৃষিখাতের ২০টি কাজের মধ্যে ১৭টি কাজে নারীর অংশগ্রহণ থাকলেও কৃষিতে নারীদের নেই কোন স্বীকৃতি। ফসলের বীজ সংরক্ষণ (৬৩ ভাগ) থেকে শুরু করে ফসল উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সংগ্রহে গ্রামীণ নারীর পুরোপুরি অংশগ্রহণ থাকলেও কৃষক হিসেবে তাদের নেই কোন পরিসংখ্যান, স্বীকৃতি বা মূল্যায়ন। এমনকি গ্রামীণ নারীরা কৃষি ঋণসহ কৃষকদের জন্য দেয়া সকল সুযোগ সুবিধা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে।

২০১২ সালের গ্রামীন জীবনযাত্রার স্থায়ী উন্নয়নের প্রচারাভিযান সূত্রে- বাংলাদেশের মোট নারী শ্রমশক্তির পরিমাণ প্রায় ১ কোটি ৬৩ লাখ। যার প্রায় ৭৮ ভাগই গ্রামীণ নারী এবং এর মধ্যে প্রায় ৬৮ ভাগ কৃষি, মৎস্য ও বনায়ন কাজের সঙ্গে জড়িত।

গ্রামীণ নারীদের অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠনের নেতাদের মতে, বাংলাদেশের বিশ্বব্যাপী সুনাম অর্জনের পেছনে গ্রামীণনারীদের বিশাল অবদান থাকাসত্বেও তা স্বীকার করা হয়না বা স্বীকৃতি দেয়া হয় না। শুধুমাত্র কৃষক হিসেবেই নয়, প্রবাসে নারী কর্মী, শিল্পকারখানার নারী কর্মী হিসেবে কাজ করে নারীরা দেশের সার্বিক অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করছে। গ্রামীণ নারীদের এ সকল অবদান শুধুমাত্র বর্তমান সময়েই নয়, আবহমানকাল থেকেই দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। অথচ এ নারীরাই প্রতিনিয়ত কর্মঘন্টা বৈষম্য, মজুরি বৈষম্যসহ নানাবিধ বৈষম্যের স্বীকার হচ্ছে এবং রাষ্ট্র থেকে পাচ্ছে না তাদের কাজের কোন স্বীকৃতি।

উপরোক্ত তথ্যাবলী বিশ্লেষণ করলে একটি বিষয় প্রতীয়মান হয় যে, আবহমানকাল থেকেই সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে গ্রামীণ নারীর প্রতি বৈষম্য এবং টেকসই স্থায়িত্বশীল কৃষিতথা বিষমুক্ত নিরাপদ কৃষির সামগ্রীক উন্নয়নে নারীর অবদানকে যথাযথ মুল্যায়ন প্রদর্শন না করা ও স্বীকৃতি না দেয়া যেন একটি নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর এ অবস্থা চলতে থাকলে কৃষিতে নারী কৃষকের কাজের স্বীকৃতির স্বপ্ন রয়ে যাবে অধরাই। তাই টেকসই ও নিরাপদ কৃষির জন্য রাষ্টীয়, সামাজিক ও পারিবারিকভাবে কৃষিতে নারীর কাজের যথাযথ মূল্যায়ন এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারীর অংশগ্রহণের মাধ্যমে নারী কৃষকের কাজের স্বীকৃতি দাবি আরও জোরালো হওয়ার এখনই সময়।

আমরা চাই- কৃষি উৎপাদন অব্যাহত ও খাদ্য নিরাপত্তা অর্জন প্রক্রিয়ায় তত্ত্বাবধায়ন, বিতরণ, পরামর্শ ও পরিকল্পনায় নারী কৃষকের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হোক।

কৃষিপ্রধান গ্রামীণ ও জাতীয় অর্থনীতিতে নারী কৃষকের কাজের তালিকা লিপিবদ্ধকরণ ও স্বীকৃতি প্রদান করা হোক। কৃষিতে নারী কৃষকের কর্মঘন্টা বৈষম্য, মজুরি বৈষম্য দূরীকরণ ও সমকাজ সমমুজুরী নিশ্চিত করার জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

সরকারী ও বেসরকারিভাবে কৃষি উপকরণ, জৈব সার, বালাইনাশক, বীজ, কৃষিকার্ড ও ঋণ সুবিধা প্রদানের ক্ষেত্রে নারী কৃষকদের সমান সুযোগ নিশ্চিত করার কার্যকর প্রদক্ষেপ গ্রহণ করা হোক।

কৃষি, মৎস্য, গবাদি পশুপালন, হাঁস-মুরগী পালন ও বনায়নে নারী কৃষকদেরকে রাষ্ট্রীয়ভাবে উৎসাহিত করা ও প্রশিক্ষণ প্রদান করা হোক।

কৃষি উৎপাদনের সাথে সম্পৃক্ত (ফসলের জন্য মাঠ তৈরী থেকে শুরু করে সংগ্রহ, প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং বাজারজাতকরণ পর্যন্ত) সকল নারী শ্রমিকদের কৃষক হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিতে হবে।

নারী কৃষক সংগঠনগুলোর রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রদান এবং কৃষি উৎপাদন উপকরণ তৃণমূল নারী সংগঠনের মাধ্যমে সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।

কৃষিকাজে নারীদের অবদান রাখার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা চিহ্নিতকরণের জন্য যথাযথ গবেষণা কার্যক্রম গ্রহণ করা এবং চিহ্নিত অসুবিধাসমূহ দূরীকরণের জন্য রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

জমিতে ফসল উৎপাদন কর্মকান্ডে নারীরা অংশগ্রহন করে থাকে বিধায় বাস্তবায়নাধীন জাতীয় কৃষিসম্প্রসারণ নীতিতে নারী কৃষকদের বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করা হোক। সেই সঙ্গে গ্রামীণ নারী কৃষি উদ্যোক্তাদের বিকাশ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে রাষ্ট্রীয়ভাবে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হোক।

লেখক পরিচিত:
সরদার মো. জাহাঙ্গীর হোসেন
ডেপুটি কো-অর্ডিনেটর (এ্যাডভোকেসি এন্ড লবি)
উন্নয়ন ধারা, বাংলাদেশ আন্ডার ব্রেড ফর দ্যা ওয়ার্ল্ড, জার্মানি

 

টাইমস/এসএন

Share this news on:

সর্বশেষ

img
পাকিস্তানের সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনির মেয়াদ বাড়ছে আরও ৫ বছর Nov 14, 2025
img
ম্যাচটা অবশ্যই জেতা উচিত ছিল: হামজা চৌধুরী Nov 14, 2025
img
গাজীপুরে বিএনপিতে যোগ দিলেন ৮ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর পাঁচ শতাধিক সদস্য Nov 14, 2025
img
পুলিশ হেফাজতে ২ চীনা নাগরিক Nov 14, 2025
img
ক্রিকেটপাড়ায় তোলপাড় : স্মৃতি মান্ধানার ‘বিয়ের কার্ড’ ভাইরাল Nov 14, 2025
img
প্রধান উপদেষ্টার ভাষণের মাধ্যমে সংকট কেটে গেছে : নুরুল হক নুর Nov 14, 2025
img
যুবসমাজ মাতাতে গ্লোবট্রটর মঞ্চে আশিষ Nov 14, 2025
img
ফের জল্পনায় বলিউড ও আইপিএলের অনিরুদ্ধ-কাব্য জুটি! Nov 14, 2025
img
রাজধানীজুড়ে বাড়তি সতর্কতা, মাঠে ১২ প্লাটুন বিজিবি Nov 14, 2025
img
লকডাউন-অগ্নিসংযোগে নির্বাচন বিরোধী মহলেরও সম্পৃক্ততা থাকতে পারে : হাবিব Nov 14, 2025
দিল্লি যাচ্ছেন নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমান Nov 14, 2025
img
কেন পুতিনকে যুদ্ধ থামাতে রাজি করাতে পারছেন না ট্রাম্প? Nov 14, 2025
img
চট্টগ্রামে জোড়া খুন তুচ্ছ ঘটনায় এনায়েত বাজারে প্রাণ গেলো ব্যবসায়ির Nov 14, 2025
img
পুসকাস পুরস্কারের দৌড়ে উঠলেন ইয়ামাল, ফের মনোনীত মার্তা Nov 14, 2025
ঘাতক লিমন আটক, ৫ বছরের সম্পর্কের দাবি Nov 14, 2025
রাজশাহীতে বিএনপির নারী কর্মীকে মারধরের অভিযোগ জামায়াত কর্মীর বিরুদ্ধে Nov 14, 2025
img
অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে বিচারকের ছেলের মৃত্যু, জানালেন চিকিৎসক Nov 14, 2025
img
রংপুরের নতুন ডিসি এনামুল আহসান Nov 14, 2025
img
তারেক রহমানের প্রধানমন্ত্রিত্ব দেখতে মানুষ উন্মুখ হয়ে আছে : মো. আবুল কালাম Nov 14, 2025
img
হাসিনা আগেই টাকার বস্তা নিয়ে আত্মীয়-স্বজনকে ভাগিয়ে দিয়েছে : এ্যানি Nov 14, 2025