আগস্ট-সেপ্টেম্বরে আরও খারাপ হতে পারে ডেঙ্গু পরিস্থিতি

সারাদেশে বাড়ছে এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু রোগের প্রকোপ। ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়ে সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় রেকর্ড ১৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে সরকারি হিসাবে এ বছর ডেঙ্গুতে ১২৭ জনের মৃত্যু হলো। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে ডেঙ্গুর পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে।

ডেঙ্গু প্রতিরোধে সরকারের দৃশ্যমান প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও এ বছরের প্রথম ছয় মাসে দেশে রেকর্ড সংখ্যক মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। সেই সঙ্গে প্রতিদিনই পাল্লা দিয়ে বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা।

বিশেষজ্ঞদের মতে, আগের চেয়ে এডিস মশার ধরন বদলেছে। ফলে এডিস মশা এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি প্রাণঘাতী হয়ে উঠেছে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার ইউএনবিকে বলেন, “সামনের মাসগুলোয় ডেঙ্গুর পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। গবেষণাগারে নিজেদের গবেষণার সময় আমরা এডিস মশার জনসংখ্যার ঘনত্ব, ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা, তাপমাত্রা, আর্দ্রতা এবং বৃষ্টিপাতসহ কিছু বিষয় বিশ্লেষণ করে একটি মডেল তৈরি করি। এটা স্পষ্ট যে আগামী দিনগুলোয় ডেঙ্গুর পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে এটি মারাত্মক রূপ নিতে পারে।

তিনি বলেন, এ মুহুর্তে ডেঙ্গুর উৎপত্তিস্থলে অভিযান পরিচালনা করা এবং ইতোমধ্যে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়া এলাকায় এডিস মশার বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য ফগিং মেশিন ব্যবহার করা গুরুত্বপূর্ণ৷ সেক্ষেত্রে ঠিকানার মাধ্যমে কর্তৃপক্ষ আক্রান্ত ব্যক্তিদের শনাক্ত করতে পারে এবং ফগিং মেশিনের মাধ্যমে মশা নিধন করতে পারে। কারণ এই মশাগুলো যতদিন বেঁচে থাকবে, ততদিন সব এলাকায় ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়বে।

তিনি নগরবাসীকে ডেঙ্গু মোকাবিলা করতে এবং তাদের বাসা-বাড়ি ও আঙিনায় যেন এডিস মশা না জন্মায়, তা নিশ্চিতের আহ্বান জানান।

উচ্চ ঝুঁকিতে ঢাকার ৫৫টি ওয়ার্ড
গত ১৮ থেকে ২৭ জুন পর্যন্ত ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের অধীনে থাকা ৯৮টি ওয়ার্ডে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের (ডিজিএইচএস) পরিচালিত জরিপ অনুযায়ী, ৫৫টি ওয়ার্ড ডেঙ্গুর উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। জরিপ চলাকালে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) ৪০টি ওয়ার্ড এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) ৫৮টি ওয়ার্ডে ৪৩.৫৩% বহুতল ভবন, ২১.৩১% বাড়ি এবং ১৮.২১% নির্মাণাধীন ভবনে এডিস লার্ভা পাওয়া যায়।

ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের আওতাধীন ২, ৩, ৫, ৬, ১০, ১৩, ১৪, ১৫, ১৬, ১৭, ১৮, ১৯, ২০, ২১, ২২, ২৩, ২৫, ২৬, ২৭, ২৮, ২৯, ৩০, ৩১, ৩৩, ৩৫, ৩৭ ও ৩৮ নম্বর ওয়ার্ড ডেঙ্গুর উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। ডেঙ্গুর উচ্চ ঝুঁকিতে থাকা ডিএনসিসির এলাকাগুলোর মধ্যে রয়েছে- মিরপুর, পল্লবী, মাজার রোড, পীরেরবাগ, মনিপুর, শেওড়াপাড়া, কাফরুল, ইব্রাহিমপুর, খিলক্ষেত, কুড়িল, শাহারা, বনানী, গুলশান, বারিধারা, মহাখালী, রামপুরা, খিলগাঁও, মালিবাগ, কারওয়ানবাজার, তেজতুরী বাজার, আগারগাঁও, মোহাম্মদপুর, বায়তুল আমান, মগবাজার, ইস্কাটন ও বাড্ডা।

অন্যদিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের আওতাধীন ২, ৩, ৪, ৫, ৬, ৯, ১১, ১২, ১৩, ১৫, ১৬, ১৮, ১৯, ২২, ২৩, ২৬, ৩৩, ৩৪, ৩৬, ৪১, ৪৪, ৪৬, ৪৮, ৫০, ৫১, ৫৪, ৫৫ ও ৫৭ নম্বর ওয়ার্ড ডেঙ্গুর উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। ডেঙ্গুর উচ্চ ঝুঁকিতে থাকা ডিএসসিসির এলাকাগুলোর মধ্যে রয়েছে- গোরান, মেরাদিয়া, বাসাবো, সবুজবাগ, মুগদা, মাদারটেক, ফকিরাপুল, আরামবাগ, শাহজাহানপুর, পুরাতন রাজারবাঘ। পল্টন, বায়তুল মোকাররম, ধানমন্ডি, রায়েরবাজার, নীলক্ষেত, সায়েন্স ল্যাবরেটরি, এলিফ্যান্ট রোড, মিন্টো রোড, কাকরাইল, হাজারীবাগ, লালবাগ, আজিমপুর, পলাশী, বংশাল, সিদ্দিকীবাজার, শাখারিবাজার, ওয়ারী, সূত্রাপুর, মিল ব্যারাক, সৈয়দাবাড়ি, উত্তরপুর, সৈয়দাবাড়ি, উত্তরপাড়া। ধোলাইপাড়, গেন্ডারিয়া, জুরাইন ও কামরাঙ্গীরচর।

ডেঙ্গুতে মৃত্যুর কারণ

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, “এ বছরের প্রথম ছয় মাসে দেশে ডেঙ্গুতে রেকর্ড সংখ্যক মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। এর পেছনে কিছু কারণ রয়েছে। প্রথমত, এ বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ব্যক্তিদের অনেকেই আগে একবার বা দুবার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। তারা আবারও এ রোগে আক্রান্ত হলে তীব্রতা বেড়ে যায়।”

তিনি আরও বলেন, “তাদের বেশিরভাগই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত কী-না, তা শনাক্ত করতে ব্যর্থ হয় এবং কিছু মানুষ দ্বিধাগ্রস্ত ছিল। যখন তারা চিকিৎসা সেবা পেতে দেরি করে, তখন তারা জটিলতা বা শক সিনড্রোমের একটি অবস্থা তৈরি করে। ডেঙ্গুতে মৃত্যুর পেছনে এটি আরেকটি কারণ।”

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ডিএসসিসির কন্ট্রোল রুম

আগে এডিস মশা শুধু দিনের বেলাই কামড়াতো। তবে আচরণ পরিবর্তিত হওয়া এখন রাতেও এডিস মশা মানুষকে কামড়াচ্ছে। এডিস মশা এখন বাইরের কৃত্রিম আলোতেও সক্রিয় থাকায় ডেঙ্গু সংক্রমণ বেড়েছে।

ডা. লেনিন বলেন, “ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে এডিস মশা দমনে অবিলম্বে কোনো কর্মসূচি না নিলে আগামী দিনে আমাদের ওপর ভয়াবহ বিপর্যয় আসতে পারে বলে আমরা আশঙ্কা করছি “

কেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এখনো ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “সিটি কর্পোরেশনের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কার্যকর ব্যবস্থা নেয়নি। দ্বিতীয়ত, সিটি কর্পোরেশনের একার পক্ষে ডেঙ্গু মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। এ কারণে জনপ্রতিনিধি ও জনগণকেও ডেঙ্গু প্রতিরোধে সম্পৃক্ত করতে হবে।”

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বলেন, “এ বছর বর্ষার মৌসুম দেরিতে শুরু হওয়ায় ডেঙ্গু প্রকোপ দীর্ঘায়িত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আমরা জনবল সংকট কমাতে পদক্ষেপ নিয়েছি এবং ঢাকার সব হাসপাতালেই ডেঙ্গুর চিকিৎসা চলছে।”

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক ডা. রাশেদা সুলতানা ইউএনবিকে বলেন, “সব হাসপাতালে ডেঙ্গু কর্নার খোলা হয়েছে এবং হাসপাতালে একটি তথ্য ডেস্ক রয়েছে। ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসার জন্য হাসপাতালগুলোয় পর্যাপ্ত শয্যা রয়েছে।”

ডিএনসিসির ডেঙ্গু বিশেষায়িত হাসপাতালে ৮০০ শয্যা রয়েছে। মুগদা জেনারেল হাসপাতালে ৬০০টি, ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে ১২০টি, সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে ১৯৫টি, শিশু হাসপাতালে ৪৪টি, সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ১২০টি, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ২৫০টি এবং কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে ৭২টি শয্যা রয়েছে।

মঙ্গলবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১,৫৩৩ জন। এর মধ্যে রাজধানী ঢাকার হাসপাতালগুলোতে ভর্তি হয়েছেন ৭৭৯ জন। বাকি ৭৫৪ জন ঢাকার বাইরে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এক দিনে মারা যাওয়া ১৩ জনের মধ্যে ঢাকার বাসিন্দা নয়জন ও ঢাকার বাইরে চারজন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, বর্তমানে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি আছেন ৫,৫৬৯ জন রোগী। তাদের মধ্যে ঢাকায় ৩,৪৪৩ জন এবং ঢাকার বাইরের বিভিন্ন হাসপাতালে ২,১২৬ জন।

এ বছর ডেঙ্গুর প্রকোপ দ্রুত বাড়ছে। গত জুন মাসে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন ৫,৯৫৬ জন রোগী। এর মধ্যে মারা যান ৩৪ জন। জুলাইয়ের প্রথম ১৮ দিনেই সেই সংখ্যা বেড়ে তিনগুণ হয়েছে।

মাসের হিসাবে জানুয়ারিতে ৫৬৬ জন, ফেব্রুয়ারিতে ১৬৬ জন, মার্চে ১১১ জন, এপ্রিলে ১৪৩ জন, মে মাসে ১,০৩৬ জন এবং জুন মাসে ৫,৯৫৬ রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে জানুয়ারিতে ছয়জন, ফেব্রুয়ারিতে তিনজন, এপ্রিলে দুইজন, মে মাসে ২ জন এবং জুন মাসে ৩৪ জনের মৃত্যু হয়েছে।

এ বছরের জুন পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গুতে যত মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন ও যতজনের মৃত্যু হয়েছে, তা এর আগে কোনো বছরের প্রথম ছয় মাসে হয়নি। জুলাইয়ে ডেঙ্গুতে ৮০ জনের মৃত্যু হয়েছে। ২০২২ সালের জুলাইয়ে ডেঙ্গুতে ৯ জনের মৃত্যু হয়েছিল।

Share this news on:

সর্বশেষ

img
‘বাহুবলী ৩’ এখনো ঘুমিয়ে আছে, মরে যায়নি Jul 12, 2025
img
‘সরকার বরাবরের মতোই নীরব’, মিটফোর্ডের ঘটনায় বাঁধন Jul 12, 2025
img
মিটফোর্ডের ঘটনায় আরও একজনসহ মোট গ্রেফতার ৫ Jul 12, 2025
img
কেবল পর্দার সামনে নয়, ক্যামেরার পেছনেও আসছেন এই অভিনেতারা Jul 12, 2025
তোমরা তো ১৩ মাসের নেতা; মুখ খুললেন সাংবাদিক নেতারা! Jul 12, 2025
img
'তারেক রহমানকে নিয়ে রাজপথে যে অশ্লীল অশ্রাব্য স্লোগান দেয়া হচ্ছে তার পরিণতি ভালো হবে না' Jul 12, 2025
img
নতুন বাংলাদেশের আকাঙ্ক্ষা ও বাস্তবতায় আসমান জমিন ফারাক: রিফাত রশিদ Jul 12, 2025
img
শ্রীলঙ্কাকে উড়িয়ে দিলেও ফিনিশিংয়ে ভরসা পাচ্ছেন না কোচ Jul 12, 2025
img
কুবি শিক্ষার্থীদের ৩টি বাস উপহার দেওয়ার ঘোষণা দিলেন উপদেষ্টা আসিফ Jul 12, 2025
img
ফেনীর বন্যা দুর্গত এলাকা পরিদর্শনে উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম Jul 12, 2025
img
মধ্যপ্রাচ্যে ট্রাম্পের ‘শান্তির তত্ত্ব’ ভেস্তে গেছে: ইরান Jul 12, 2025
img
আবারও একসঙ্গে রাজ–মন্দিরা, আসছে ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ Jul 12, 2025
img
জোতাকে সম্মান জানিয়ে চিরতরে অবসরে লিভারপুলের ২০ নম্বর জার্সি Jul 12, 2025
img
পাশবিক এই হত্যাকাণ্ডের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা নেয়া হবে: আসিফ নজরুল Jul 12, 2025
img
অনুমতি ছাড়া মাছ ধরায় সৌদিতে বাংলাদেশি আটক Jul 12, 2025
img
ঠাকুরগাঁও সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে নিহত ১ বাংলাদেশি Jul 12, 2025
img
গাজাকে শিশুদের কবরস্থান বানাচ্ছে ইসরাইল: জাতিসংঘ Jul 12, 2025
img
মিটফোর্ডে হত্যাকাণ্ড নিয়ে রাষ্ট্রদূত মুশফিকের আবেগঘন প্রতিক্রিয়া Jul 12, 2025
img
উইম্বলডন থেকে বিদায় নিলেন সার্বিয়ান তারকা জোকোভিচ Jul 12, 2025
img
বিচ্ছেদের গুঞ্জনে মুখ খুললেন নয়নতারা Jul 12, 2025