আজ তারা, কাল হয়তো আমি কিংবা তুমি

চারদিকে আগুনের লেলিহান শিখা। আকাশ ঢেকে গেছে কালো ধোঁয়ায়। বাতাসে শুধু পোড়া লাশের গন্ধ। মর্গে জমা হচ্ছে সারি সারি লাশ। একের পর এক লাশ এসে শামিল হচ্ছে মৃত্যুর মিছিলে।

কেউ কেউ ছবি তুলছেন মৃত্যুপুরীর। বাঁচাও বাঁচাও আর্তনাদে প্রকম্পিত হয়ে ওঠছে আকাশ-বাতাস। কেউ কেউ নির্বাক শ্রোতা হয়ে সেই আহাজারি শুনছে। শত শত গণমাধ্যমকর্মীরা সেই দৃশ্য ক্যামেরাবন্দী করতে ব্যস্ত।

দমকল কর্মীদের অক্লান্ত চেষ্টার ফলে একসময় সেই ধ্বংসলীলার ইতি ঘটে। আর দিন শেষে খবরের শিরোনাম হয় ‘অবশেষে আগুন নিয়ন্ত্রণে’।

ওপরের দৃশ্যপট কোনো সিনেমার নয়। এটা বাস্তব। বাংলাদেশে রোজকার ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে আগুন লাগার ঘটনা। ঘটনা যখন ঘটে তখন সাধারণ জনগণ থেকে শুরু করে সাংবাদিক আর প্রশাসন সবাই ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে দোষারোপ করতে থাকি। সরকার ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি ও পরিবারকে কিছু টাকা ক্ষতিপূরণ দেবার আশ্বাস দেন। এরকম ঘটনার পুনরাবৃত্তি না হবার একটি আনুষ্ঠানিকতার প্রতিশ্রুতি দেন। যে প্রতিশ্রুতি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কেবল সম্মান রক্ষার্থে করা হয়। সংবাদ সংগ্রহ করতে করতে দিন শেষে সাংবাদিকরাও ক্লান্ত হয়ে পড়েন। ধীরে ধীরে ঘটনার রেশ কেটে যায়। আর এ নিয়ে কারো মাথা ব্যাথাও থাকে না।

তবে এসব নিয়ে কিন্তু অনেক তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। কমিটি প্রতিবেদন জমা দেয়, সুবিধা মতো দোষারোপ করে এবং সমস্যা প্রতিরোধে এক বিশাল লম্বা সুপারিশমালা তুলে ধরে। তবে সেই সুপারিশ ওই প্রতিবেদনের পাতায়ই আটকে থাকে। বাস্তবায়নের কোনো চেষ্টাও দেখা যায় না। কিছু দিন পত্রপত্রিকার শিরোনাম হবার পর সাংবাদিকরাও বিরক্ত হয়ে পড়েন। ফলে অবস্থা দাঁড়ায় এমন যে, ‘যেই লাউ সেই কদু’।

কিছুদিন পর আবারো সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। সেই কান্না, সেই আহাজারি, সেই লাশের মিছিল। আবারো সেই তদন্ত কমিটি, পারস্পরিক দোষারোপ আর প্রতিশ্রুতির সংস্কৃতি।

অথচ আমরা কখনো এটা ভাবতে পারি না যে, আজ হয়ত এই হতভাগা মানুষগুলোর মৃত্যু হয়েছে, কাল তো আপনার কিংবা আমার একই পরিণতি হতে পারে? তবে কেন আমরা এই দোষারোপ আর প্রতিশ্রুতির ন্যাক্কারজনক সংস্কৃতি থেকে বের হতে পারি না? আমাদের সমস্যাটা কোথায়? আমাদের কি এরকম ঘটনার পুনরাবৃত্তি প্রতিরোধ করার সামর্থ্য নেই? না কি আমাদের একটু সদিচ্ছা আর মানুষের প্রতি ভালোবাসার অভাব আছে? তা না হলে কেন আমরা প্রতিনিয়ত একের পর এক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের সম্মুখীন হচ্ছি? আমাদের গলদ কোথায়?

পুরান ঢাকার নিমতলীর অগ্নিকাণ্ডের কথা তো সবারই মনে আছে? আর ২০ ফেব্রুয়ারি পুরান ঢাকার চুড়িহাট্টার ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড। যা প্রায় ৮০ জনেরও বেশি নিরীহ মানুষের জীবন কেড়ে নিয়েছে। এর মাত্র কয়েকদিন আগে চট্টগ্রামে আরেকটি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নয় জন মারা যায়।

চুড়িহাট্টা ট্রাজেডির রেশ কাটতে না কাটতেই আবার সেই ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড। ২৮ মার্চ বনানীর ২২ তলা ভবন এফআর টাওয়ারে এই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এতে অন্তত ২৫ জন মারা যায় এবং অর্ধশতাধিক মানুষ গুরুতর আহত হয়। ক্যামেরার সামনে জীবন্ত মানুষগুলো পুড়ে যাওয়ার সেই দৃশ্য আর বেঁচে থাকার আকুতি দেখলে গা শিউরে ওঠে।

অথচ দুঃখজনক হলেও সত্য আধুনিক বহুতল ভবনটিতেও ছিল সেই অব্যবস্থাপনা। একটি আধুনিক বহুতল ভবন হওয়া সত্ত্বেও সেখানে পর্যাপ্ত অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা ছিল না বলে অভিযোগ ওঠেছে। যে সামান্য ব্যবস্থাটুকু ছিল তাও কার্যকর ছিল না বলে ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা জানিয়েছেন। তাছাড়া ভবন নির্মাণেও নীতিমালা অনুসরণ করা হয়নি।

কিন্তু প্রশ্ন হলো- এখন কেন আমরা এরকম দোষারোপ করছি? এতে কি যারা হারিয়ে গেছে তাদের ফিরে পাওয়া যাবে? তা না হলে এতদিন এই বিষয়গুলো খতিয়ে দেখা হলো না কেন? একটি অভিজাত এলাকায় এরকম একটি আধুনিক ভবন নির্মাণে নীতিমালা মানা হয়নি, অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা  নেই- এই বিষয়গুলো কীভাবে প্রশাসন থেকে আড়াল থাকে? এর দায়ভার কি কোনো ভাবে প্রশাসন এড়াতে পারবে?

না, প্রশাসন কোনো ভাবেই এই দায়ভার এড়াতে পারে না? তাই এখনই সময়, আমি, আমরা, প্রশাসন সবাইকেই একসঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে। এরকম ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ করতে হবে। এবং এটা আমাদের স্বার্থেই। অন্যথায়, আজ হয়ত এই হতভাগা লোকগুলোর জীবন গেছে। কাল তো হতে পারে আমি কিংবা তুমি?

 

 

লেখক: এনামুক হক, সাংবাদিক

Share this news on:

সর্বশেষ

img
সাতক্ষীরায় ১ দিনে পানিতে ডুবে কিশোরসহ প্রাণ হারাল ৪ Sep 16, 2025
img
চ্যাম্পিয়নস লিগ শুরুর আগে সুসংবাদ পেল রিয়াল মাদ্রিদ Sep 16, 2025
img
৩ জেলার ডিসিকে প্রত্যাহার Sep 16, 2025
img
৩ চাকার যানবাহনগুলো সঠিক গবেষণার মাধ্যমে সমাধানের তাগিদ Sep 16, 2025
img
খুলনায় আড়াই মণ হরিণের মাংসসহ আটক ১ Sep 16, 2025
img
ভালুকায় শ্রমিকলীগের ২ নেতা গ্রেপ্তার Sep 16, 2025
img
বিপিসির অভিযানে মানিকগঞ্জে ৩ ফিলিং স্টেশনের ৮টি ডিসপেন্সিং ইউনিট জব্দ Sep 16, 2025
img
কাপাসিয়ায় উপজেলা যুবদলের সদস্য সচিব লিয়ন বহিষ্কার Sep 16, 2025
img
জামালপুরে ডাকাতির প্রস্তুতিকালে আটক ৬ Sep 16, 2025
img
আরাকান আর্মি ইয়াবা ব্যবসায় জড়িত থাকায় চোরাচালান বেড়েছে : বিজিবি Sep 16, 2025
img
চাঁদপুরে সরকারি চাল মজুতের দায়ে বিএনপি নেতাকে জরিমানা Sep 16, 2025
উত্তাল ফরিদপুর! থানা ও উপজেলা পরিষদে হামলা, অফিসার্স ক্লাবে আগুন Sep 16, 2025
আমি তুষার বলছি - বাংলাদেশকে এখানেই আসতে হবে Sep 16, 2025
এই যে ভণ্ডামি, প্রতারণা কেন করছেন আপনারা? Sep 16, 2025
তরুণদের সক্রিয়তায় সব সমস্যার সমাধান সম্ভব: প্রধান উপদেষ্টা Sep 16, 2025
অর্থ পাচার রোধে যে কঠোর নীতিতে হাঁটছে সরকার Sep 16, 2025
img
নুরের ওপর হামলাকারীদের বিচারের দাবিতে রাজধানীতে মশাল মিছিল Sep 16, 2025
img

ডিআইজি রেজাউল করিম

যারা ফ্যাসিস্ট তাদের আমরা আইনের আওতায় আনব Sep 16, 2025
img
আর্থিক সুবিধা নেওয়ায় কর কর্মকর্তা মাসুদুর রহমানকে বরখাস্ত Sep 16, 2025
img
পেলেকে ছাড়িয়ে রেকর্ড দামে বিক্রি হলো মেসির রুকি কার্ড Sep 16, 2025