ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আজ

১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর ঢাকাকে রাজধানী করে পূর্ব বাংলা ও আসাম প্রদেশ সৃষ্টি করা হয়। বঙ্গভঙ্গের ফলে পূর্ব বাংলায় শিক্ষার ব্যাপক উন্নতি ঘটে। কিন্তু ১৯১১ সালের ১ নভেম্বর দিল্লির দরবারে ঘোষণার মাধ্যমে ১২ ডিসেম্বর বঙ্গভঙ্গ রদ করা হয়। অবিভক্ত বাংলায় ১৯টি ডিগ্রি কলেজ ছিল। তার মধ্যে পূর্ব বাংলায় ছিল ৯টি। তবে সেই সংখ্যা পর্যাপ্ত ছিল বলে মনে করেননি তখনকার পূর্ব বাংলার মানুষ।

বঙ্গভঙ্গের ফলে পূর্ববঙ্গে শিক্ষার যে জোয়ার এসেছিল, তাতে অচিরেই ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার চাহিদা ছিল। বঙ্গভঙ্গ রদের ফলে সে সম্ভাবনা শেষ হয়ে যায়। ১৯১২ সালের ২১ জানুয়ারি ভারতের ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ ঢাকা সফরে আসেন। এই সফরকালে ঢাকার কিছু নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বঙ্গভঙ্গ রদের কারণে তাদের ক্ষতির কথা জানান। এই ক্ষতি পূরণের লক্ষ্যে ঘোষণা দেন যে তিনি সরকারের কাছে ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের সুপারিশ করবেন।

নাথান কমিশনের সুপারিশ আলোকে ১৯২১ সালের ১ জুলাই কার্যক্রম শুরু হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের। এর ফলে পূর্ববাংলায় সেই কাঙ্ক্ষিত মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবী শ্রেণির সৃষ্টি হয়। যারা পরবর্তীকালে রাষ্ট্রগঠন ও স্বাধীনতা সংগ্রামসহ দেশের ক্রান্তিলগ্নে জাতিকে পথ দেখিয়েছেন। হাঁটি হাঁটি পা পা করে আজ ১ জুলাই (সোমবার) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১০৩ বছর পূর্ণ করে ১০৪তম বছরে পা রেখেছে।

জাতির ক্লান্তিকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ই দেখিয়েছিল আলোর দিশা। বাংলা ভাষাকে নিজের মাতৃভাষা হিসেবে রূপ দিয়ে ঝরিয়েছে রক্ত। দেশকে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর হাত থেকে রক্ষা করতে বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজারো শিক্ষার্থী প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিলেন। স্বাধীন পতাকা ও মানচিত্র এনে দেওয়া এবং স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ার ক্ষেত্রে অগ্রহণী ভূমিকা রেখেছিলেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরাই।

স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনসহ গুরুত্বপূর্ণ সকল আন্দোলনের সূতিকাগার ছিলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। অতীতে সোনালী ইতিহাসের ধারাবাহিকতা রক্ষা করে সামনের দিনগুলোতে আত্মমর্যাদাসম্পন্ন জাতি হিসেবে দেশকে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে নেতৃত্ব দিতে হবে এ প্রতিষ্ঠানকে।

বর্তমানে দেশের সর্ববৃহৎ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্বের বুকে দেশকে প্রতিনিধিত্বকারী বিশ্ববিদ্যালয়ও এটি। তবে ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতি, তীব্র আবাসন সংকটসহ নানা সমস্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কার্যক্রমে পিছিয়ে রয়েছে।

ওয়ার্ল্ড র‍্যাংকিংগুলোতে চোখ বুলালে দেখা যায়, কিউএস এশিয়া ইউনিভার্সিটি র‍্যাঙ্কিং ২০২৪-এর করা তালিকায় শীর্ষ ১০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় জায়গা পায়নি বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়। এই তালিকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ১৪০তম।

এর আগে যুক্তরাজ্যভিত্তিক শিক্ষা সাময়িকী ‘টাইমস হায়ার এডুকেশন’ বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের যে র‌্যাঙ্কিং করেছিল, সেই তালিকায় শীর্ষ ৮০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম ছিল না। এই ৮০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ভারতের ২৪টি ও পাকিস্তানের ৮টি বিশ্ববিদ্যালয় জায়গা করে নিয়েছিল।

৩০ এপ্রিল প্রকাশিত এশিয়ার ৭৩৯টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে করা যুক্তরাজ্যভিত্তিক শিক্ষা সাময়িকী ‘টাইমস হায়ার এডুকেশন’এর সেরা ৩০০ এর মধ্যেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জায়গা হয়নি। যেখানে সেরা ৩০০ তালিকায় ভারতের ৪০টি, পাকিস্তানের ১২টি, মালয়েশিয়ার ১১টি বিশ্ববিদ্যালয় স্থান পেয়েছিলো।

এ ছাড়া গত সেপ্টেম্বরে স্পেনের মাদ্রিদভিত্তিক শিক্ষা ও গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ওয়েবমেট্রিকসের করা র‌্যাঙ্কিংয়ে শীর্ষ এক হাজার প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় ছিল না। ৩১ হাজার বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে করা এ র‌্যাঙ্কিংয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ছিল যৌথভাবে ১ হাজার ৫১তম।

তবে আন্তর্জাতিকভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের র‍্যাংকিং পিছিয়ে থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে শিক্ষার্থী ও সারাদেশের মানুষের প্রবল আশা ও আকাঙ্ক্ষা রয়েছে৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভালো করুক এবং দেশ ও দেশের বাইরে সুনাম অর্জন করুক এই পত্যাশা রাখেন তারা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হাসান তারিক বলেন, মাতৃভাষার দাবি প্রতিষ্ঠা, দেশ স্বাধীন করাসহ দেশের সকল আন্দোলনের সূতিকাগার হওয়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দেশের সকল মানুষের কাছে গর্বের বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে সমাদৃত। যদিও শিক্ষা-গবেষণায় ঢাবি খানিকটা পিছিয়ে তবুও এটা দেশ সেরাই রয়েছে ৷ আমি চাই ঢাবি জ্ঞান-বিজ্ঞানে আরও উৎকর্ষ সাধন করুন। দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও বাংলাদেশের সুনাম অর্জনে ঢাবি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখুক। ওয়ার্ল্ড র‍্যাংকিং এ ঢাবির অবস্থান হোক চোখে পড়ার মতো।

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. সীতেশ চন্দ্র বাছার বলেন, ‘দক্ষ মানবসম্পদ তৈরিতে উচ্চশিক্ষা’ এই উপজীব্যকে সামনে রেখেই আমরা কাজ করে যাচ্ছি। বর্তমানে সকল বিভাগের একাডেমিক কারিকুলামকে এমনভাবে সাজানো হয়েছে যে এর ফলে একজন শিক্ষার্থী গতানুগতিক শিক্ষার পাশাপাশি কর্মক্ষেত্রে ‘স্কিলড মেনপাওয়ার’ হিসেবে গড়ে উঠে৷ সেজন্য আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাকে আরও সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই।

তিনি বলেন, বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণায় আমাদের অনেক অপ্রতুলতা থাকা সত্বেও শিক্ষক-কর্মকর্তাদের বন্ধনটাকে দৃঢ় করে ‘ইন্ডাস্ট্রিয়াল-একাডেমিক কোলাবোরেশান’ বৃদ্ধি করতে চাই এবং ইনোভেশনকে আরও বৃদ্ধি করতে চাই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যেতে ‘ওয়াল্ড র‍্যাংকিং’ কে মাথায় রেখে যা করা প্রয়োজন সেগুলো করতে আমরা বদ্ধপরিকর। এতসব সীমাবদ্ধতাকে কাটিয়ে আমরা যদি বিশ্ববিদ্যালয়কে আরও বিশ্বমানের করতে পারি তাহলে আমরা যে স্বপ্ন দেখছি তা বাস্তবায়ন হবে।

১০৪তম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিবসে 'তরুণ প্রজনোর দক্ষতা উন্নয়নে উচ্চশিক্ষা' প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে দিনব্যাপী বর্ণাঢ্য কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে।

দিনটিকে ঘিরে রঙিন আলোয় আলোকিত এবং নানা রঙে সাজবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। আয়োজিত হবে আলোচনা সভা ও বণ্যাঢ্য শোভাযাত্রা। এদিন সকাল ১০টায় ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র সম্মুখস্থ পায়রা চত্বরে বিশ্ববিদ্যালয় দিবসের বিভিন্ন কর্মসূচির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল।

কর্মসূচি সমূহ:
কর্মসূচি অনুযায়ী সেদিন সকাল সাড়ে ৯টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল হল ও হোস্টেল থেকে শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা ও কর্মচারীবৃন্দ শোভাযাত্রা সহকারে স্মৃতি চিরন্তন চত্বরে সমবেত হবেন। স্মৃতি চিরন্তন চত্বর থেকে সকাল ৯টা ৪৫ মিনিটে উপাচার্যের নেতৃত্বে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা সহকারে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অ্যালামনাই, কর্মকর্তা ও কর্মচারীবৃন্দ ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের সম্মুখস্থ পায়রা চত্বরে গমন করবেন।

সকাল ১০টায় পায়রা চত্ত্বরে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে জাতীয় পতাকা, বিশ্ববিদ্যালয় ও হলসমূহের পতাকা উত্তোলন, পায়রা, বেলুন ও ফেস্টুন উড়ানো, কেক কাটা এবং সংগীত বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে বিশ্ববিদ্যালয়ের থিম সং ও উদ্বোধনী সংগীত পরিবেশিত হবে।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পর সকাল সাড়ে ১০টায় ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র মিলনায়তনে বিশ্ববিদ্যালয় দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় 'তরুণ প্রজন্যের দক্ষতা উন্নয়নে উচ্চশিক্ষা' নিয়ে এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী, এমপি।

উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামালের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠেয় আলোচনা সভায় বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন গ্রো-ভাইস চ্যান্সেলর (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ সামাদ, প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. সীতেশ চন্দ্র বাছার এবং কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক মমতাজ উদ্দিন আহমেদ।

এসময় বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ও সিন্ডিকেট সদস্যবৃন্দ, বিভিন্ন অনুষদের ডিন, বিভিন্ন হলের প্রাধ্যক্ষ, বিভিন্ন বিভাগের চেয়ারম্যানসহ শিক্ষক-শিক্ষার্থী, অ্যালামনাই ও কর্মকর্তা- কর্মচারীরআ আলোচনা সভায় অংশগ্রহণ করবেন।

আলোচনা সভার শুরুতে দিবসটি উপলক্ষ্যে প্রকাশিত 'স্মরণিকা' ও 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ইতিহাস ও ঐতিহ্য' শীর্ষক গ্রন্থের ২য় খণ্ডের মোড়ক উন্মোচন করবেন
প্রধান অতিথিসহ অতিথিরা।

যান চলাচলে বিধিনিষেধ :
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিবস উদ্যাপন উপলক্ষ্যে ঐদিন সকাল সাড়ে ৯টা থেকে সাড়ে ১০টা পর্যন্ত নীলক্ষেত ও ফুলার রোড থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশ পথ যানবাহন চলাচলের জন্য বন্ধ থাকবে। এসময় বিকল্প রাস্তা ব্যবহারের জন্য সকলকে অনুরোধ জানানো হয়েছে।
আলোকসজ্জা

দিবসটি উপলক্ষে উপাচার্য ভবন, কার্জন হল, কলাভবন ও ছাত্র-শিক্ষককেন্দ্রসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও সড়কে আলোকসজ্জা করা হয়েছে। এছাড়া, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন প্রবেশপথে তোরণ নির্মাণ এবং রোড ডিভাইডার ও আইল্যান্ডগুলোতে সাজসজ্জা করা হয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিবস উপলক্ষে এদিন সব ক্লাস সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত বন্ধ থাকবে। তবে পরীক্ষা যথারীতি অনুষ্ঠিত হবে।

Share this news on: