চাল নিয়ে চালবাজি চলছেই

প্রতি মৌসুমেই বাম্পার ফলন, বাজারে সরবরাহ পর্যাপ্ত। এরপরও যুক্তি ছাড়াই হুটহাট বেড়ে যায় চালের দাম। এমন চিত্র বিগত প্রায় এক যুগ ধরেই। মাত্রই মাস তিনেক আগে ছাত্র-জনতার ব্যাপক বিক্ষোভের মুখে সরকার পতন হলো। এর কারণ হিসেবে যতোই রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন খাতে সৃষ্ট বৈষম্যকে দায়ী করা হোক না কেন, বাজার নিয়ন্ত্রণে বিগত সরকারের ব্যর্থতাকেও কোনোভাবেই ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর তার রাষ্ট্র সংস্কারের বিস্তৃত এজেন্ডার মধ্যে অন্যতম একটি ছিল বাজার নিয়ন্ত্রণ এবং নিত্যপণ্যকে জনগণের ক্রয়ক্ষমতার নাগালে নিয়ে আসা। সে অনুযায়ী বিভিন্ন পদক্ষেপও নিয়েছে এ সরকার, যার মধ্যে বাজার তদারকি কার্যক্রম জোরদার করার পাশাপাশি খুলে দেওয়া হয়েছে আমদানির দরজাও। সবশেষ চালের আমদানি শুল্ক সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে এনবিআর। এতকিছুর পরও অবস্থা তথৈবচ। কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণে আসছে না চালের দাম। সবশেষ এক মাসে বেড়েছে সর্বোচ্চ ৮ শতাংশ পর্যন্ত। সরকারের এতোসব কঠোর নীতির মাঝেই চালবাজিতে মেতে আছে ‘সিন্ডিকেট’।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সরবরাহে কোনোরকম সংকট না থাকলেও সরকারের সব নিয়মনীতিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে কৃত্রিম সংকট তৈরি করছে উৎপাদন এলাকার মিলার ও মজুতদাররা। ঢাকার বাদামতলী, মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেট ও কারওয়ান বাজারের কয়েকজন বড় ব্যবসায়ীও জড়িত এই চক্রে। সংঘবদ্ধ এ চালবাজিতে অন্যতম ক্রীড়ানক আবার বড় বড় সব করপোরেট প্রতিষ্ঠান। বর্তমান সরকার সংশ্লিষ্ট অনেকের আবার দাবি, চালের বাজারের নিয়ন্ত্রণহীন সিন্ডিকেটের পেছনে থাকতে পারে বিগত সরকারের ষড়যন্ত্র।

মোটকথা, চালের বাজারে সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম সুস্পষ্ট। দাম বৃদ্ধির পেছনে ভিন্ন যেকোনো কারণ স্রেফ অযুহাত। সমাধানও তাই হয়তো একটাই, যেকোনভাবে হোক বাজারের সিন্ডিকেট চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনা।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, দেশে চালের বার্ষিক চাহিদা ৩ কোটি ৭০ লাখ থেকে ৩ কোটি ৯০ লাখ টন। ২০২১-২২ অর্থবছরে ৩ কোটি ৮৯ লাখ ৩৬ হাজার টন এবং ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৩ কোটি ৯০ লাখ ৩৫ হাজার টন চাল উৎপাদন হয়েছে। তবে সবশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে উৎপাদন হয়েছে ৪ কোটি ২০ লাখ টন। সে হিসাবে চাহিদার চেয়ে উৎপাদন বেশি হয়েছে ৩০ লাখ টনের মতো। এতে চাল উদ্বৃত্ত থাকার কথা। যদিও কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, সাম্প্রতিক বন্যায় ৮ লাখ ৩৯ হাজার টন চালের উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, বছরের শুরু থেকেই এবার চড়া ছিল চালের বাজার। গত জুলাই-আগস্টে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় তা আরও বেড়ে যায়। এরপর আর স্বস্তি ফেরেনি বাজারে। গত সপ্তাহে আরেক দফা বেড়েছে দাম। বাজারে সবচেয়ে বেশি চাহিদা মাঝারি আকারের বিআর-২৮ ও পাইজাম জাতের চালের। এ ধরনের চালের ভোক্তা সাধারণত নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণি। গত শুক্রবার ঢাকার বাজারে খুচরা পর্যায়ে এ দুই জাতের চালের কেজি বিক্রি হয়েছে ৫৮-৬৪ টাকায়। এছাড়া মোটা চালের (গুটি স্বর্ণা ও চায়না ইরি) কেজি ৫২-৫৫ টাকা ও চিকন চাল (মিনিকেট) বিক্রি হয়েছে কেজি ৭০-৮০ টাকা দরে। অথচ, মাস তিনেক আগেও মোটা চালের কেজি ৪৮-৫০, মাঝারি চাল ৫৪-৫৮ এবং চিকন চাল ৬৮-৭০ টাকায় বিক্রি হয়েছিল।

টিসিবির হিসাব অনুযায়ী, গত এক মাসে সরু চালের দর প্রায় ৪ শতাংশ, মাঝারি চালের দর ৮ শতাংশ ও মোটা চালের দর ২ শতাংশ বেড়েছে। তবে, এক বছরের তুলনামূলক হিসাব সামনে আনলে এই দামবৃদ্ধির হার আরও বেশি। মাত্র এক বছরের ব্যবধানে গড়ে ১২ শতাংশ বেড়েছে সব ধরনের চালের দাম।

এদিকে সিন্ডিকেটের কারসাজির মাঝে আশঙ্কা জাগাচ্ছে সরকারি মজুত। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, বর্তমানে চালের মজুত রয়েছে ৯ লাখ ৬৮ হাজার টন। তবে সরকারের নিরাপত্তা মজুত হিসেবে সাধারণত ১১ লাখ টন চাল রাখার কথা বলা হয়ে থাকে। অর্থাৎ ১ লাখ ৩২ হাজার টন চালের ঘাটতি সৃষ্টি হয়েছে সরকারি খাদ্যভাণ্ডারে।

চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৩ লাখ ৫০ হাজার টন চাল আমদানির জন্য ২ হাজার ৯০৮ কোটি টাকা বাজেট বরাদ্দ রয়েছে। বাকি ৭ লাখ ৫০ হাজার টনের জন্য আরও ছয় হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ লাগবে।

এ অবস্থায় বাজারে চালের সরবরাহ বাড়াতে আমদানিতে উৎসাহ দিচ্ছে সরকার। আমদানিতে মোট করভার ৬২ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে দুই দফা কমিয়ে মাত্র ২ শতাংশ অগ্রিম কর রাখা হয়েছে। অর্থাৎ আমদানিতে ৬০ দশমিক ৫ শতাংশ শুল্ককর প্রত্যাহার করা হয়েছে। তাতে চালের আমদানি মূল্য কেজিতে প্রায় ৯ টাকা ৬০ পয়সা কমার কথা। শুল্ক প্রত্যাহার হলেও ব্যক্তি মালিকানাধীন ভাণ্ডারে মজুত চাল বেশি দামে বিক্রির জন্য আমদানি করছে না সিন্ডিকেট চক্রটি। বন্যার ছুতায় নিরুৎসাহিত করছে অন্যদেরও।

এরই মধ্যে দিনদিন দেশের শীর্ষস্থানীয় করপোরেট কোম্পানিগুলোর অতি মুনাফা লাভের প্রবণতা অস্থির করে তুলছে চালের বাজারকে। দিন যতোই যাচ্ছে দেশের শীর্ষস্থানীয় কোম্পানিগুলো বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে এ খাতে। আধুনিক বিপণন পদ্ধতিতে আকর্ষণীয় মোড়কে খুচরা বিক্রেতাদের কাছে চাল পৌঁছে দিচ্ছে এসব প্রতিষ্ঠান। আর খুচরা ব্যবসায়ীরা করপোরেটরদের ব্র্যান্ড ভ্যালুকে কাজে লাগিয়ে বেশি দামে চাল বিক্রি করছে। এর ফলে লাভবান হচ্ছে করপোরেট কোম্পানি ও খুচরা ব্যবসায়ীরা।

উৎপাদন অঞ্চলের মিলার ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে ধানের মৌসুমে সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ধান কিনে মজুত করছে বড় বড় করপোরেট কোম্পানিগুলো। আবার বাজারে ধানের কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে চালের দামও বাড়াচ্ছে তারাই। সরকারের নিয়মিত মনিটরিং ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের অভাবেই মূলত বেপরোয়া হয়ে উঠছেন করপোরেট ব্যবসায়ী ও মিলমালিকরা।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, গ্রামগঞ্জে মিল ও চাতাল মালিকদের ধান সংগ্রহকালে অর্থাৎ মৌসুমের শুরুতে চালের দাম বেড়ে যায়। বড় কোম্পানিগুলোর ধান সংগ্রহ কার্যক্রমের কারণেই মূলত সরকার চাহিদা অনুযায়ী ধান-চাল সংগ্রহ করতে পারে না। এর ফলে চালের দামও নিয়ন্ত্রণে আসে না। এই সংকট মোকাবিলায় বড় কোম্পানিগুলোর চাল বিপণন কার্যক্রমের জন্য সরকারিভাবে কার্যকর নীতিমালার দাবি সাধারণ ব্যবসায়ীদের।

বাজারে বর্তমানে স্কয়ার গ্রুপের ব্র্যান্ড চাষী, এসিআই গ্রুপের পিওর, টিকে গ্রুপের পুষ্টি, প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের প্রাণ, ইস্পাহানি গ্রুপের পার্বণ, বাংলাদেশ এডিবল অয়েল গ্রুপের রূপচাঁদা, আকিজ গ্রুপের অ্যাসেন্সিয়াল, সিটি গ্রুপের তীর, মেঘনা গ্রুপের ফ্রেশ, র‍্যাংগস গ্রুপের নবান্নসহ বিভিন্ন কোম্পানির চাল বিপণন হচ্ছে। ধান থেকে চাল রূপান্তর ও বিপণন খাতে দেশের এসব বড় শিল্প গ্রুপ বড় ধরনের বিনিয়োগের মাধ্যমে চালের বাজারে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করছে। এ খাতে বিনিয়োগে আগ্রহী হয়ে উঠছে দেশের আরও কয়েকটি বড় শিল্প গ্রুপ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উত্তরবঙ্গভিত্তিক চালের চাতাল ও মিল পর্যায়ে প্রভাব বিস্তার করে চালের দাম পর্যন্ত নির্ধারণ করছে এই করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো। এ কারণে ছোট মিলাররাও ব্র্যান্ডের চালের দামের অনুপাতে তাদের চালও বাড়তি দামে বাজারে ছাড়ছে।

গত ১০-১২ বছর ধরে দেশের বড় করপোরেট কোম্পানিগুলো চালের দাম নিয়ে কারসাজি করছে অভিযোগ পাইকারি ব্যবসায়ীদের। তারা বলছেন, করপোরেট কোম্পানিগুলোর চাল বিপণন কার্যক্রমের কারণেই মূলত চালের বাজার অস্থির হয়ে আছে। তাদের অতি মজুদদারি নীতির কারণে বাজারে ধানের কৃত্রিম সংকট লেগেই রয়েছে। করপোরেট কোম্পানিগুলোর আধিপত্য বিস্তারের পর ছোট মিলাররা বাকিতে ধান কিনতে না পারায় চালের সরবরাহ এসব কোম্পানির হাতেই চলে যাচ্ছে।

কয়েকজন ব্যবসায়ীর দাবি, করপোরেটরদের মতো সামনের সারির কয়েকজন মিল মালিকও আসন্ন রমজানকে সামনে রেখে যে পরিমাণ চালের মজুদ করেছে তা দিয়ে দুই মাস সারাদেশের মানুষের চালের চাহিদা পূরণ হতে পারে।

যাত্রাবাড়ীর ভাই ভাই চালের আড়ত মালিক মিলন বলেন, বাজারে বড় বড় কোম্পানিগুলোর চালের সরবরাহ বেশি। তাদের চালের মানও ভালো। তাই একচেটিয়া ব্যবসা করছে করপোরেট কোম্পানিগুলো। যেভাবে চালের বাজার বড় কোম্পানিগুলোর দখলে যাচ্ছে তাতে চালের দাম আর কমবে বলে মনে হয় না।

এসব ব্যাপারে খাদ্য সচিব মাসুদুল হাসান বলেন, চালের যে সংকট নেই, তা পুরোপুরি সত্য। কারণ, আমি নিজে কারওয়ান বাজারে গিয়ে দেখেছি, প্রতিটি আড়ত চালে ভরা। অন্য জেলাগুলোতেও নিশ্চয়ই পর্যাপ্ত চাল রয়েছে। দাম বৃদ্ধি পাওয়ার কোনো যুক্তি দেখছি না।

তিনি আরও বলেন, কিছু ব্যবসায়ী সরকারকে চাপে ফেলার জন্য সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করছে। এ ক্ষেত্রে আমরা আইনের সর্বোচ্চ প্রয়োগ করব। সিন্ডিকেটকে ছাড় দেওয়া হবে না।

Share this news on:

সর্বশেষ

img
জামায়াত চাঁদাবাজির কথা স্বীকার করে না : রুমিন ফারহানা Sep 18, 2025
img
অনুমতি ছাড়া করণ জোহরের ‘ছবি-কণ্ঠস্বর’ ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা Sep 18, 2025
img
সংবিধান বদলাতে না দিলে দেশে আবার গণ-অভ্যুত্থান ঘটবে : সারোয়ার তুষার Sep 18, 2025
img
১৭ দিন ভারতের স্কুলে স্কুলে চলবে মোদির জীবনীভিত্তিক চলচ্চিত্র Sep 18, 2025
img
যারা বাঁশ দিয়েছ এবং নিয়েছ সবাইকে শুভেচ্ছা : কুদ্দুস বয়াতি Sep 18, 2025
img
বিশ্ব বাঁশ দিবস আজ Sep 18, 2025
img
১৭ বিয়ে করা বন কর্মকর্তাকে হেফাজতে নিলো পুলিশ Sep 18, 2025
img
মাসিক ৩ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্সে কমবে ঋণ নির্ভরতা Sep 18, 2025
img

অপেক্ষাকাল কমছে

সরকারি কর্মচারীদের অবসরে বাড়ছে সুবিধা Sep 18, 2025
img
ডিএসইতে প্রথম ঘণ্টায় লেনদেন ১৫০ কোটি টাকা Sep 18, 2025
img
বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে ইইউ প্রতিনিধি দলের সন্তোষ প্রকাশ Sep 18, 2025
img
সম্মেলনের আগে স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারের অনুরোধ ফজলুর রহমানের Sep 18, 2025
img
‘বিশেষ সাংবিধানিক আদেশ জারির মাধ্যমে গণঅভ্যুত্থানকে পাকাপোক্ত করতে হবে’ Sep 18, 2025
img
পাইক্রফটকে ‘ভারতের প্রিয় ম্যাচ রেফারি’ বললেন রমিজ রাজা Sep 18, 2025
img
পাকিস্তান সফরে যাচ্ছেন স্বরাষ্ট্র সচিব নাসিমুল গনি Sep 18, 2025
img
সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলো নিষিদ্ধ হয়ে যাক : ঐশী Sep 18, 2025
img
প্রতিটি ভোটারের আস্থা নিশ্চিত করা আমাদের অন্যতম দায়িত্ব : তারেক রহমান Sep 18, 2025
img
দ্বিতীয় দিনের মতো ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিচ্ছেন নাহিদ Sep 18, 2025
img
বাংলাদেশে সবচাইতে আগে জরুরি জাতীয় নির্বাচন : জিল্লুর রহমান Sep 18, 2025
img
মেটা উন্মুক্ত করলো নতুন ডিসপ্লে স্মার্ট গ্লাস Sep 18, 2025