জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচন দিতে হবে: গোলাম পরওয়ার

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেছেন, জাতীয় নির্বাচন হওয়ার আগে সুষ্ঠু ও অবাধ স্থানীয় সরকার নির্বাচন আয়োজন করা জরুরি। তিনি আরও বলেন, যদি সরকার আন্তরিক হয়, তবে নির্বাচন কমিশনের পক্ষে সেই নির্বাচন আয়োজন করা সম্ভব। নির্বাচনী ব্যবস্থা সংস্কারের জন্য প্রয়োজনীয় সময়ের মধ্যে নির্বাচন তারিখ ঘোষণা করার আহ্বান জানান তিনি।

নির্বাচনে বিশৃঙ্খলা, হানাহানি, রক্তারক্তি রোধ করার জন্য ফ্যাসিবাদের মাস্টারমাইন্ড শেখ হাসিনাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইবুনালে মামলা করে যাদের বিচারের মুখোমুখি করা হচ্ছে নির্বাচনের আগে তাদের বিচার জাতি দেখতে চায়। বিচার, সংস্কার, স্থানীয় নির্বাচন ৩টা কাজ জাতীয় নির্বাচনের আগে করতে হবে।

শুক্রবার (২৮ ফেব্রুয়ারি) সকাল ৯টায় জেলা শহরের বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ খুশি রেলওয়ে মাঠে জেলা জামায়াতে ইসলামী আয়োজিত কর্মী সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।

অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, দীর্ঘ ১৬/১৭ বছর আমরা একটা কালো যুগ পার করেছি। যে যুগে মানুষের ভোটাধিকার ছিল না, গণতন্ত্র ছিল না। ইসলামী মূল্যবোধ ও আমাদের জাতিসত্ত্বার অস্তিত্ব মুছে ফেলার জন্য চক্রান্ত চলছিল। আইন আদালতে বিচারের নামে দলীয়করণ ও দুর্নীতি, অর্থনীতিতে লুটপাট, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, খুন, লুটপাট হয়েছে। নিরীহ আলেম ওলামা, দাড়িওয়ালা, টুপিওয়ালা ও ইসলামী ব্যক্তিত্বকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়েছিল। এটা ছিল ইতিহাসের একটা কালো যুগ।

তিনি বলেন, আমি বেদনার সঙ্গে স্মরণ না করে পারি না আমাদের তৎকালীন আমির মতিউর রহমান নিজামী, আলি আহসান মুজাহিদ, কামারুজ্জামান, আব্দুল কাদের মোল্লা, মীর কাশেম আলীদের মতো নেতৃত্বদেরকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে কারাগারে প্রেরণ করে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এছাড়া অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের মিথ্যা মামলায় কারাগারে পাঠিয়ে তাদেরকে তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। এটা ছিল আমাদের ইতিহাসের এক কালো যুগ।

গোলাম পরওয়ার বলেন, তিন টার্ম বাংলাদেশের মানুষ ভোট দিতে পারেনি। এই অত্যাচারী, কর্তৃত্ববাদী, ফ্যাসিবাদী শাসকের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের ১৮ কোটি মানুষ আন্দোলন করেছে ভোটাধিকারের জন্য। ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ এ বাংলাদেশের মানুষ ভোট দিতে পারে নাই। বাংলাদেশে আমরা ১৪, ১৮, ২৪ এর মতো ভোট আর হতে দেব না। গত ১৫ বছরের সকল রাজনৈতিক দলের আন্দোলনকে তারা দমন করেছে, হত্যা করে, গুলি করে, গ্রেপ্তার করে, কারাগারে আটকে রেখে। কিন্তু আমাদের সোনার ছেলেরা তাদের অধিকারের জন্য, বৈষম্যের বিরুদ্ধে, সরকারি চাকরিতে তাদের অধিকারের জন্যে যে আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। আধিপত্য বাদী দালাল শেখ হাসিনা সেই আন্দোলনকে নিন্দা ও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে তাদেরকে বলল ‘তোরা রাজাকার হয়ে গেছিস’।

তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারা বাংলাদেশের ছাত্ররা হাসিনার এই কটাক্ষের বিরুদ্ধে গর্জে উঠে বলল, চেয়ে নিলাম অধিকার, আমরা সবাই রাজাকার। তখন সারা বাংলাদেশে এক দফা আন্দোলন শুরু হলো। ১৮ কোটি মানুষ জেগে উঠলো। তখন আমরা জেল থেকে শুনলাম, আবু সাঈদ, মুগ্ধরা গুলির সামনে বুক পেতে ফ্যাসিবাদকে পরাজিত করেছে। বাংলাদেশ বিজয়ী হয়েছে। দুই হাজার ছাত্র জীবন দিয়েছেন, ৩০ হাজার ছাত্র-জনতা আহত হয়েছেন, পঙ্গু হয়েছেন। তারা এখনো হাসপাতালে কাতরাচ্ছেন।

তিনি বলেন, হাসিনা ভেবেছিল সে আজীবন ক্ষমতায় থাকবে। সে ২০৪১ সালের জন্য স্বপ্ন দেখেছিল। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছার সঙ্গে হাসিনার ইচ্ছে মিলেনি। হাসিনা ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে তার বোন শেখ রেহেনাকে নিয়ে হেলিকপ্টারে ভারতে পালিয়ে যায়। শেখ হাসিনা যেই জায়গার মাল সেই জায়গায় চলে গেলেন। যেখানকার মাল সেখানেই ফেরত। ওইখানে গিয়েও সে বসে নাই। সে ওখানে বসে ষড়যন্ত্রের জাল বুনতেছে। অডিও ও ভিডিও বক্তব্য দিচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, যে বাংলার হাজার হাজার মানুষ রক্ত দিয়ে নতুন বাংলাদেশে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলার সুযোগ দিলেন তাদের সেই রক্তের ঋণ রক্তের দায় আমাদের শোধ করতে হবে। তারা একটি নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিল। যে বাংলাদেশের মানুষ বৈষম্য শিকার হবে না। বিচারে তারা সুবিচার পাবে। ভাত, কাপড়, শিক্ষা, স্বাস্থ্য নিয়ে তাদের কোনো অসুবিধা হবে না, বৈষম্যহীন অর্থনীতি হবে। আমরা তাদের সেই নতুন বাংলাদেশ উপহার দেব। নতুন বাংলাদেশ গড়ে তোলার মাধ্যমেই আমরা তাদের ইচ্ছা পূরণ করতে পারব।

তিনি আরও বলেন, স্বপ্নের বাংলাদেশ গঠনের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস একটি যৌক্তিক সময়ের মধ্যে প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষ করে জাতীয় নির্বাচনের জন্য তিনি প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। জামায়াতে ইসলামী অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে বলেছে সরকারের প্রত্যেকটি জায়গায় সংস্কার করে নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করতে হবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে সেই অভিযাত্রা শুরু হয়েছে। কিন্তু এই সাড়ে ছয় ও সাত মাসে দুঃখজনক হলেও আমরা লক্ষ করছি একের পর এক নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য, নানান ফন্দি-ফিকির করে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে চক্রান্ত করে এই সরকারকে বারবার থামিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।

আধিপত্য বাদী শক্তির কোলে বসে পালিয়ে যাওয়া পতিত ফ্যাসিস্ট স্বৈরাচার ওখানে বসে ষড়যন্ত্র করে বাংলাদেশে অরাজকতা অস্থিরতা তৈরি করে নির্বাচন না দিয়ে একটি হট্টগোল করার চেষ্টা করছে। কিন্তু দুঃখের সঙ্গে আমরা লক্ষ্য করছি দেশের ভেতরে যারা ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনে আমরা এক সঙ্গে ছিলাম, রক্ত দিয়েছি, জেল খেটেছি তাদের মধ্যেও যেন ফ্যাসিবাদের প্রেতাত্মারা বাসা বেঁধেছে। এখনো প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে কিন্তু ফ্যাসিবাদের প্রেতাত্মারা কিন্তু ঘাপটি মেরে বসে আছে। কথা ছিল জুলাই অভ্যুত্থানের চেতনাকে ধারণ করে আমরা একটি নির্বাচনের দিকে যাব। জনগণ যাকে ক্ষমতা দেবে তারাই দেশ শাসন করবে। কিন্তু বিভিন্নভাবে এই সরকারকে বাধা দেওয়া হচ্ছে।

তিনি বলেন, মানুষ এখন মুখে মুখে বলছে জামায়াতে ইসলামের হাতেই মানুষ এখন দায়িত্ব দিতে চায়। এজন্য কিছু দলের মাথা খারাপ হয়ে গেছে। ঠিক আওয়ামী লীগ যেভাবে আমাদের বিরুদ্ধে কথা বলতো, ঠিক একই স্টাইলে তারা এখন আমাদের বিরুদ্ধে কথা বলছে। আমরা বলেছি স্থানীয় সরকার নির্বাচনটা আগে দেন। স্থানীয় সরকার নির্বাচন দিতে হবে আগে। কারণ সিটি কর্পোরেশনে কোনো প্রতিনিধি নেই, পৌরসভাতে নেই, উপজেলাতে নেই। গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন, স্থানীয় অবকাঠামো উন্নয়ন অগ্রগতি ব্যহত হয়ে আছে, জন দুর্ভোগ বাড়ছে।

রাজবাড়ী জেলা জামায়াতে ইসলামীর আমির ও কেন্দ্রীয় মজলিশে শূরা সদস্য অ্যাডভোকেট মো. নূরুল ইসলামের সভাপতিত্বে বিশেষ অতিথি হিসেবে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ও সাবেক সংসদ সদস্য এ এইচ এম হামিদুর রহমান আজাদ বক্তব্য রাখেন।
রাজবাড়ী জেলা জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি আলিমুজ্জামানের সঞ্চালনায় অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন, ফরিদপুর অঞ্চলের সদস্য দেলোয়ার হোসেন, ফরিদপুর অঞ্চলের টিম সদস্য ও কেন্দ্রীয় শূরা সদস্য অধ্যাপক আব্দুত তাওয়াব, ফরিদপুর অঞ্চলের টিম সদস্য শামসুল ইসলাম আল বরাটী, ফরিদপুর জেলা জামায়াতে ইসলামীর আমির মাওলানা মো. বদরউদ্দিন, জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় শূরা সদস্য মো. জামাল উদ্দিন, বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মো. আক্তারুজ্জামানসহ জেলা জামায়াতের নেতারা বক্তব্য রাখেন।

Share this news on:

সর্বশেষ