‘তুই সাংবাদিক তো কি হইছিস, তোকে সেন্ডেল খুলে পিটাবো'

গাইবান্ধা-১ (সুন্দরগঞ্জ) আসনের প্রয়াত আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি মঞ্জুরুল ইসলাম লিটনের শ্যালিকা ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি সৈয়দা খুরশিদ জাহান স্মৃতির বোন ফাতেমা আক্তার মিলি। সুন্দরগঞ্জ উপজেলার সর্বানন্দ ইউনিয়নের সাহাবাজ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে কর্মরত তিনি। তার বিরুদ্ধে অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ তুলে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন, সংগ্রাম করে আসছেন স্থানীয় এলাকাবাসী।

স্থানীয়দের অভিযোগ, ২০১৪ সালে তার ভগ্নিপতি মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় গাইবান্ধা-১ (সুন্দরগঞ্জ) আসন থেকে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এমপি হওয়ার পর ম্যানেজিং কমিটির সদস্যদের জিম্মি করে প্রধান শিক্ষক হিসেবে তার শ্যালিকা ফাতেমা আক্তারকে প্রধান শিক্ষককের চেয়ারে বসান। এরপর থেকেই বেপরোয়া হয়ে ওঠেন এই নারী প্রধান শিক্ষক। সেই সঙ্গে বিদ্যালয়ে একক আধিপত্য বিস্তার শুরু করেন। স্বামীর বড় ভাইকে সভাপতি বানিয়ে নিয়োগের নামে কোটি টাকা পকেটস্থ করার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

বিতর্কিত প্রধান শিক্ষক ফাতেমা আক্তার মিলি ওই প্রতিষ্ঠানে ২০১৫ সালে যোগদান করেন। ১১ জন শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগে আর্থিক বানিজ্য ও ৯ বছর ধরে টিউশন ফি আত্মসাৎ করে আসছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এছাড়াও উৎকোচ হাতে না পেলে বেতন-ভাতায় সাক্ষর না করাসহ অবসরে যাওয়া কর্মচাকরীর কাছে টাকা দাবি করার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

এছাড়া বিদ্যালয়টির একজন নৈশপ্রহরী আব্দুর রহমান জীবিত থাকা অবস্থায় জাতীয় পরিচয় পত্রে বয়সের ভুল ধরে বেতন বন্ধ করে দেন এবং সংশোধনির পরও (২০২১ সালে মারা যান তিনি) বিনা কারণে বেতন এবং মৃত্যু পরবর্তীকালীন সরকারি বিধি অনুযায়ী ভাতা উত্তোলনে সহযোগিতা না করার অভিযোগ রয়েছে প্রধান শিক্ষক ফাতেমা আক্তার মিলির বিরুদ্ধে। এসব বিষয়ে বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ দাখিল করেছেন ওই প্রতিষ্ঠানের ভুক্তভোগী শিক্ষক-কর্মচারি ও ভুক্তভোগী।

জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের পতনের পর লাপাত্তা ছিলেন এই নারী প্রধান শিক্ষক। দীর্ঘদিন ধরে বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত থেকে ১৬ ডিসেম্বর, ২১ শে ফেব্রুয়ারি কোন জাতীয় দিবসেই তিনি পতাকা উত্তোলন করেননি বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।

গণমাধ্যম কর্মী আসার খবর পেয়ে ২৬ মার্চ বুধবার (২৬ মার্চ) সকালে স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে হাজির হন তিনি। সেখানে দেশ রুপান্তর পত্রিকার সুন্দরগঞ্জ প্রতিনিধি মামুনুর রশীদসহ কয়েকজন গণমাধ্যম কর্মী উপস্থিত হয়ে প্রধান শিক্ষক ফাতেমা আক্তার মিলির কাছে বিভিন্ন অনিয়মের বিষয়ে জানতে চাইলে তাদের ওপর চড়াও হন তিনি। এসময় প্রধান শিক্ষক ফাতেমা আক্তার মিলি সাংবাদিককে জুতা পেটা করাসহ বিভিন্ন অশালীন ভাষায় গালিগালাজ করতে থাকেন।

এসময় ভিডিওতে তাকে আরও বলতে শোনা যায়, 'তুই সাংবাদিক এখানে কেন? তোকে পায়ের সেন্ডেল দিয়ে পেটাব। তোকে আরও অপমান করব।

ভুক্তভোগী সাংবাদিক মামুনুর রশীদ জানান, নিয়োগ বানিজ্যসহ বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে এই প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে। বিভিন্ন দপ্তরে দেওয়া বিদ্যালয়টির শিক্ষক ও ভুক্তভোগী এলাকাবাসীর দেওয়া অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য নিতে গেলে সাংবাদিকদের ওপর চড়াও হন তিনি। এক পর্যায়ে গালিগালাজসহ পায়ের স্যান্ডেল খুলে মারাপিট করার হুমকিও দেন তিনি। আমি এ ঘটনায় স্থানীয় থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করবো।

অভিযোগ আছে, প্রধান শিক্ষক ফাতেমা আক্তার মিলি তার ভগ্নিপতি আলোচিত আওয়ামী লীগের এমপি মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন মারা যাওয়ার আগে সহকারী শিক্ষক থেকে প্রধান শিক্ষক পদে নিয়োগ করান। এরপর থেকে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারসহ নানাভাবে শিক্ষক কর্মচারীর উপর একচেটিয়া শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। তার বিরুদ্ধে কথা বললে হামলা-মামলাসহ নানা হয়রানির শিকার হতে হয়। এমপি লিটনের মৃত্যু হলে ফাতেমা তার বোন উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি সৈয়দা খুরশিদ জাহান স্মৃতির দাপটে একক সিদ্ধান্তে চালাতে থাকেন বিদ্যালয়।

শুধু তাই নয়, নানা সময়ে শিক্ষক-কর্মচারীদের সঙ্গে অশোভন আচরণ করতেন তিনি। তার এমন আচরণ আর কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য থেকে বাদ যায়নি স্থানীয় বাসিন্দা ও অবিভাবকেরাও। বিগত দিনে প্রধান শিক্ষকের এমন আচরণ, অনিয়ম- দুনীতিসহ নানা অভিযোগে বিক্ষোভ মিছিল ও মানববন্ধনও করেন এলাকাবাসী। কিন্তু তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা না নেয়ায় এখনো বেপরোয়া আওয়ামী লীগের আশির্বাদপুষ্ট এই প্রধান শিক্ষক ফাতেমা। এলাকাবাসীর প্রশ্ন, ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের পতন হলেও এই দুর্নীতিবাজ প্রধান শিক্ষকের খুটির জোর কোথায়?

এ বিষয়ে স্থানীয় অবিভাবক বাবলু মন্ডল বলেন, একজন সাংবাদিকের সঙ্গে এত নোংরা ভাষায় কথা বলাটা দুঃখজনক। আমি সামনে থেকে যা দেখেছি, তাতে মনে হয়েছে, উনি কোনভাবেই শিক্ষক হওয়ার যোগ্য না।

নুরুজ্জামান নামে আরেক অবিভাবক বলেন, এই প্রধান শিক্ষকের প্রতিষ্ঠানে আমার বাবা নৈশপ্রহরী হিসেবে কর্মরত ছিলেন। চাকরি শেষের দিকে এলে এনআইডি কার্ডে বয়সের ভুল ধরে বেতন বন্ধ করে দেন। এছাড়া বাবা জীবিত থাকা অবস্থায় তাকে মৃত দেখিয়ে নিয়োগ দেওয়া হয়। আমার বাবা আব্দুর রহমান মারা গেছেন আজ চার বছর হলো, অথচ এখনো তিনি বেতন উত্তোলনে কোনো ব্যবস্থাই নেননি। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও উপজেলা মাধ্যমিক কর্মকর্তার কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েও সুরাহা হয়নি।

তিনি আরও বলেন, উনি শিক্ষক হয়ে সাংবাদিকদের তুই তোকারি করে কথা বলার সাহস পান কিভাবে? সাংবাদিক স্কুল থেকে বের না হলে পায়ের স্যান্ডেল খুলে লাঞ্ছিত করার হুমকি দেয় কার দাপটে। আওয়ামী লীগের কর্মী হয়ে এখনো প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। আমি মনে করি সাংবাদিকদের সঙ্গে যে আচরণ উনি করেছেন তাতে তার বিচার হওয়া উচিত।

এ ব্যাপার জানতে অভিযুক্ত প্রধান শিক্ষক ফাতেমা আক্তার মিলির সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন রিসিভ না করে কেটে দেন। তাই তার মন্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।
এ বিষয়ে সুন্দরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রাজ কুমার বিশ্বাস বলেন, গণমাধ্যম কর্মীর সাথে এমন আচরণ একেবারে।

এফপি

Share this news on:

সর্বশেষ

img
কাতারের সঙ্গে নিরাপত্তা চুক্তি করার ঘোষণা যুক্তরাষ্ট্রের Sep 16, 2025
img
বিচারপতির উপস্থিতিতে ৬ মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীসহ ৯ জনের ভার্চুয়ালি হাজিরা Sep 16, 2025
img
এনবিআরে বড় রদবদল, দপ্তর বদলালো ১৮২ সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তার Sep 16, 2025
img

নুরাল পাগলার মাজারে হামলা

আদালতে স্বীকারোক্তি দিল ৮ আসামি Sep 16, 2025
img
ক্রীড়া কর্মসূচি প্রকল্পে বরাদ্দের টাকা বেহাত, দুদকের অভিযান Sep 16, 2025
img
দুই কোটি রুপি ও স্বর্ণসহ সরকারি কর্মকর্তা গ্রেপ্তার Sep 16, 2025
img
২৬৬ কোটি টাকার ফাঁকিতে চাকরিচ্যুত ২ কর কর্মকর্তা Sep 16, 2025
img
কোনো ধর্মকে আলাদা করে দেখা যাবে না : প্রধান উপদেষ্টা Sep 16, 2025
img
মালদ্বীপে প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য ভ্রাম্যমাণ কনস্যুলার সেবা চালু করল হাইকমিশন Sep 16, 2025
img
দুর্যোগের আগে সবার কাছে সতর্কবার্তা পৌঁছাতে কাজ করছে সরকার: উপদেষ্টা Sep 16, 2025
img
বাংলাদেশকে টপকে জাহাজ ভাঙা শিল্পের শীর্ষে উঠতে চায় ভারত Sep 16, 2025
img

জোহরান মামদানি

‘পেনশন তহবিলের টাকা ইসরায়েলি বন্ডে বিনিয়োগ করা উচিত নয়’ Sep 16, 2025
img
ভাঙ্গায় সড়ক ও রেলপথে যান চলাচল স্বাভাবিক Sep 16, 2025
img
মবের মুল্লুক নামে আরো একটি কুখ্যাত বাগধারার কবলে পড়েছে দেশ: গোলাম মাওলা রনি Sep 16, 2025
img
নিউইয়র্ক টাইমসের বিরুদ্ধে বিশাল অঙ্কের ক্ষতিপূরণ মামলা করলেন ট্রাম্প Sep 16, 2025
img
ব্যক্তি বিবেচনায় এলএনজি কেনা হচ্ছে না, পিটার হাসের কোম্পানি প্রসঙ্গে অর্থ উপদেষ্টা Sep 16, 2025
img
নতুন বাংলাদেশ গড়তে চাই, যেখানে সবাই সমান অধিকার পাবে: প্রধান উপদেষ্টা Sep 16, 2025
img
আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ছাড়া ওজোনস্তর রক্ষা সম্ভব নয় : পরিবেশ উপদেষ্টা Sep 16, 2025
img
হ্যান্ডশেক বিতর্কে আইসিসির দ্বারস্থ পিসিবি, প্রতিক্রিয়া জানাল ভারত Sep 16, 2025
img
এনসিপির মতো নেপালের ছাত্ররা দল করতে যায়নি : রুমিন ফারহানা Sep 16, 2025