৯০ হাজার ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার অভিযোগ যাচাই চলছে: ফারুক ই আজম

৯০ হাজার ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার অভিযোগ তদন্তের জন্য ডাটা এন্ট্রির কাজ চলছে বলে জানিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক ই আজম বীর প্রতীক।

মঙ্গলবার (২৬ মার্চ) মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উপলক্ষে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে বাসসের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তিনি এ কথা বলেন।

তিনি বলেন, ‘এ পর্যন্ত ৯০ হাজার ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে অভিযোগ পেয়েছি। এর মধ্যে ৪০ হাজার ডাটা এন্ট্রি হয়ে গেছে। ৫০ হাজার ডাটা এন্ট্রির কাজ চলমান রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় এখন সেগুলো যাছাই-বাছাই করছে।’

উপদেষ্টা বলেন, ‘স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রেক্ষাপট, যুদ্ধে যাবার স্বপ্ন, বিজয় অর্জন নিয়ে। শুনেছেন মেজর জিয়ার কণ্ঠে স্বাধীনতার ঘোষণা। সেই স্বপ্ন এবং বর্তমানের বাস্তবতা দেখলে কষ্ট পাই।

বর্তমানে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে ফেরিওয়ালাদের রাজনৈতিক বাণিজ্য, মুক্তিযোদ্ধাদের সামাজিক মর্যাদা ক্ষুণ্ন, রাজনৈতিক বিবেচনায় ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সৃষ্টিসহ সামগ্রিকভাবে মুক্তিযুদ্ধকে দলীয় রাজনীতির রঙে রঙিন করা হয়েছে। এখনো বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন হয়। দারিদ্র্য, নারী অধিকার, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবার মতো মৌলিক বিষয় নিয়ে সংগ্রাম করতে হয়।’

তিনি বলেন, ‘রণাঙ্গনে যুদ্ধ করেছি বিবেকের তাড়নায়। সেদিন ২২ বছরের এই যুবক যুদ্ধে গিয়েছিল পাকিস্তানি শাসকের শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের আগুন জ্বালিয়ে। স্বপ্ন ছিল স্বাধিকারের।
স্বপ্ন ছিল রাজনৈতিক স্বাধীনতার, অর্থনৈতিক স্বাধীনতার। বাঙালির সামাজিক মর্যাদার। কোনো রাজনৈতিক দলের কর্মী ছিলাম না। মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান হিসেবে বেঁচে থাকার সংগ্রামে এসএসসি পাসের পর বাড়ি থেকে বের হয়ে গিয়েছিলাম কাজের সন্ধানে অচিন এলাকা খুলনায়।’

মুক্তিযোদ্ধাদের শ্রেণিবিন্যাস ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে উপদেষ্টা বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধকে রাজনীতিকরণ করা হয়েছে। রাজনৈতিক চেতনায় মুক্তিযোদ্ধাদের পরিচয় করানো হয়েছে। স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরও সেদিনের অপ্রাপ্তবয়স্ক শিশুরাও মুক্তিযুদ্ধের তালিকায় রাজনৈতিক বিবেচনায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও নাতি-নাতনি না হয়েও ভুয়া কাগজ তৈরি করে চাকরি ও শিক্ষাসহ বিভিন্ন সেক্টরে কোটা-সুবিধা নিয়েছে।’

এসব এখন তদন্তের অধীনে আসছে জানিয়ে তিনি বলেন, “স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরও আমাদের একটি প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার তালিকা তৈরি হয়নি। রাজনৈতিক সরকারের আমলে রাজনৈতিক বিবেচনায় বিভিন্ন তদবির ও দুর্নীতির মাধ্যমে হাজার হাজার ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা তালিকাভুক্ত হয়েছে। তারা ভাতাসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছে। দেখা যাচ্ছে, আবেদনে যেই মুক্তিযোদ্ধা যুদ্ধে অংশগ্রহণের ‘তথ্য প্রমাণ ও ডিক্লারেশন’ দিয়েছেন, ‘আমি অমুক সেক্টরে অমুক জায়গায় যুদ্ধ করেছি’ খোঁজ নিয়ে দেখা যাচ্ছে, সেই সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার বা অন্য মুক্তিযোদ্ধারা তাকে চেনেনই না, কখনো দেখেননি। এ রকম শত শত ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে অভিযোগ মন্ত্রণালয়ে জমা পড়েছে।”

তিনি বলেন, ‘এ পর্যন্ত ৯০ হাজার ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার বিরুদ্ধে বিভিন্ন জেলা থেকে অভিযোগ পেয়েছি। এর মধ্যে ৪০ হাজার ডাটা এন্ট্রি হয়ে গেছে। ৫০ হাজার ডাটা এন্ট্রির কাজ চলমান রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় এখন সেগুলো যাচাই-বাছাই করছে। ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের স্বেচ্ছায় নাম প্রত্যাহারের আহ্বান জানানো হবে। ইতোমধ্যে কয়েকজন নাম প্রত্যহারের আবেদন করেছেন। যারা নাম প্রত্যাহার করবেন, তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে না।’

অভিযোগ পাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র জমা দেওয়ার জন্য চিঠি ইস্যু করা হবে জানিয়ে উপদেষ্টা বলেন, ‘তাদের আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া হবে। তাদের কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করা হবে। শুনানি করে যাদের কাগজপত্র ঠিক আছে, তারা গেজেটভুক্ত থাকবে। আর যারা অভিযোগ প্রমাণ করতে পারবেন না, তাদের গেজেট বাতিল করে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। মুক্তিযোদ্ধা সংসদ গঠনের পর দ্রুত বিষয়টি নিষ্পত্তির উদ্যোগ নেওয়া হবে। আশা করছি সময় কিছুটা ক্ষেপণ হলেও প্রকৃত রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধার তালিকা প্রস্তুতে সফলতা আসবে।’

সরকার রণাঙ্গনের প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা ও সহযোগী মুক্তিযোদ্ধা চিহ্নিত করার কাজ শুরু করে করেছে জানিয়ে ফারুক ই আজম বলেন, “যেসব কৃষক-শ্রমিক, সশস্ত্র বাহিনী, পুলিশ, নৌ কমান্ডো, আনসার, ইপিআর সদস্য যুদ্ধ করেছেন, মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তাদের মর্যাদা কখনো সীমান্ত পাড়ি দেওয়া, কিংবা বিদেশে বসে আরাম-আয়েশে জনমত সৃষ্টির প্রচারণা চালানো, ফুটবল খেলোয়াড়, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে গান গাওয়া মুক্তিযোদ্ধার মর্যাদা এক হতে পারে না। তাই মন্ত্রণালয় মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ ছাড়া অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের ‘সহযোগী মুক্তিযোদ্ধা’ হিসেবে চিহ্নিত করার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েছে। এ ব্যাপারে উপদেষ্টা পরিষদে আলোচনা প্রজ্ঞাপন জারি করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।”

তিনি বলেন, ‘যারা রণাঙ্গনে ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসরদের বিরুদ্ধে সম্মুখযুদ্ধ করেছেন, তারা রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা। অপরদিকে যারা বিদেশে জনমত তৈরির প্রচার চালিয়েছেন, স্বাধীন বাংলা ফুটবল টিমের খেলোয়াড়, স্বাধীন বাংলা বেতারের শিল্পী, সাংবাদিক, চিকিৎসক, নার্স, চিকিৎসা সহকারীসহ যারা মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় রয়েছেন, তাদের সহযোগী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতির বিষয়টি বিবেচনা করা হচ্ছে।’

মুক্তিযুদ্ধের সেদিনের চেতনার সঙ্গে এখনকার চেতনা মেলানো যাবে না মন্তব্য করে উপদেষ্টা বলেন, ‘এখন সবাই সুবিধাভোগী এবং চেতনাকে নানাভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। ফলে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা ইমেজ সংকটে পড়েছে।’

তিনি বলেন, ‘গেজেট অনুযায়ী শহিদ মুক্তিযোদ্ধা ৬ হাজার ৭৫৭ জন। এর মধ্যে ভাতা গ্রহণ করছেন ৫ হাজার ৩৫৮ জনের পরিবার। অবশিষ্ট ১ হাজার ৩৯৯ জন ভাতা নেন না। তারা এ পর্যন্ত আবেদনও করেননি। এই শহিদ পরিবারগুলো কোথায়, কেন তারা ভাতা নিচ্ছে না রাষ্ট্র জানে না। রাষ্ট্রকে তাদের কাছে যাওয়া উচিত। তাদের খুঁজে বের করা উচিত। কারা এই শহিদ পরিবার।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমার মনে হয়, মুক্তিযুদ্ধে যারা অংশ নিয়েছেন, তাদের অধিকাংশই গ্রামের কৃষক, শ্রমিক জনগণ। তারা জানেন না কীভাবে সরকারের কাছে আবেদন করতে হয়। শহিদ পরিবারগুলো খুঁজে বের করার জন্য জেলা প্রশাসকদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আমাদের প্রচেষ্টা থাকবে মুক্তিযুদ্ধে শহিদ পরিবারগুলোকে খুঁজে বের করে রাষ্ট্রের প্রদত্ত সুযোগ-সুবিধার আওতায় আনা।’

উপদেষ্টা জানান, মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় কোনোরূপ রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ছাড়া নির্মোহভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমুন্নত রেখে মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণ ও সম্মানিত করতে পদক্ষেপ নিয়েছে। তা বাস্তবায়ন করা গেলে অর্ধশতাব্দীর বঞ্চনার ইতিহাসের পরিসমাপ্তি হবে।

এফপি

Share this news on:

সর্বশেষ

img
“তোমার কথা মনে পড়ছে” – প্রিয়ঙ্কার কাণ্ডে অস্বস্তিতে অভিষেক! Apr 01, 2025
img
ইভটিজিং ঠেকাতে গিয়ে রক্তাক্ত বাবা-চাচা, বাড়িঘরে হামলা Apr 01, 2025
img
ঈদে রাজনৈতিক সহিংসতার শিকার জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতা Apr 01, 2025
img
গাজায় ইসরায়েলি হামলায় নিহত আরও ৮০ ফিলিস্তিনি Apr 01, 2025
img
চাঁদা না দেয়ায় দুই ভাইকে কুপিয়ে হত্যা, ওসি বলছে চোর সন্দেহে গণধোলাই Apr 01, 2025
img
বাতিল হচ্ছে ‘বঙ্গবন্ধু জনপ্রশাসন পদক’, আতঙ্কে পদকপ্রাপ্তরা Apr 01, 2025
img
ঈদের নামাজ পড়তে পারেননি ইমরান খান Apr 01, 2025
img
বড় ধাক্কা খেল সালমানের ‘সিকান্দার’, প্রথম দিনে হতাশাজনক আয় Apr 01, 2025
img
বাংলাদেশের অস্ট্রেলিয়া সফরের সূচিতে পরিবর্তন Apr 01, 2025
img
ইতিহাসে প্রথমবার স্বর্ণের দাম ৩১০০ ডলার ছাড়ালো Apr 01, 2025