যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গাড়ি ও গাড়ির যন্ত্রাংশ আমদানির ওপর ২৫ শতাংশ হারে শুল্ক আরোপের যে ঘোষণা দিয়েছেন, তা হতবাক করেছে বিশ্বের বৃহত্তম গাড়ি নির্মাতাদের। ট্রাম্পের এই পদক্ষেপ বিশ্বে গাড়ি নির্মাণ শিল্পজুড়ে ব্যাপক প্রভাব ফেলবে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বৃহস্পতিবার (২৭ মার্চ) জাপান, জার্মানি এবং যুক্তরাজ্যের গাড়ি নির্মাতাদের অনেক শেয়ার বিক্রি হয়ে যায়। আর বিক্রির চাপে শেয়ারদর কমে যাওয়ায় টয়োটা, বিএমডব্লিউ ও জাগুয়ার ল্যান্ড রোভারের মতো কোম্পানিগুলোর বাজার মূল্য একদিনেই কয়েক বিলিয়ন ডলার কমে যায়।
যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলোর মধ্যে জেনারেল মোটরস সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যার শেয়ারদর ৭ শতাংশের বেশি কমে গেছে। তবে ট্রাম্প-ঘনিষ্ঠ ইলন মাস্কের প্রতিষ্ঠান টেসলার ওপর এখন পর্যন্ত এর প্রভাব পড়েনি। টেসলার শেয়ারদর বৃহস্পতিবার দিন শেষে অপরিবর্তিত ছিল।
অবশ্য ইলন মাস্ক সতর্ক করে বলেছেন, তার কোম্পানিও এই শুল্কের প্রভাব থেকে পুরোপুরি মুক্ত থাকবে না। তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লিখেছেন, “টেসলাও এখানে অক্ষত নয়, এই খরচের প্রভাব কম নয়।”
কারস ডটকম-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের যুক্তরাষ্ট্রে নির্মিত গাড়ির তালিকায় শীর্ষে থাকা টেসলার মডেল ওয়াই গাড়ির প্রায় ৭০ শতাংশ যন্ত্রাংশ যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি হয়। এই তথ্য উল্লেখ করে গবেষক প্যাট্রিক মাস্টারসন বলেন, “কোনো গাড়িই শতভাগ আমেরিকান নয় এবং এই শুল্কের প্রভাব সব গাড়ি নির্মাতার ওপরেই পড়বে, টেসলাও এর ব্যতিক্রম নয়।”
ম্যাককুয়ারির তথ্য অনুযায়ী, এই শুল্ক প্রায় ৩০০ থেকে ৪০০ বিলিয়ন ডলারের আমদানিকে প্রভাবিত করতে পারে, যা যুক্তরাষ্ট্রের বার্ষিক আমদানির প্রায় ১০ শতাংশ। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে গাড়ির দাম ৪ হাজার থেকে ১২ হাজার ডলার পর্যন্ত বাড়তে পারে।
অনেক বড় গাড়ি কোম্পানির যুক্তরাষ্ট্রে কারখানা থাকলেও তারা বিদেশ থেকে গাড়ি বা যন্ত্রাংশ আমদানি করে। জাপানের টয়োটার যুক্তরাষ্ট্রে ১০টি উৎপাদন কারখানা রয়েছে এবং তাদের হাইল্যান্ডার এসইউভি আমেরিকান-নির্মিত তালিকায় উচ্চ স্থানে রয়েছে। কিন্তু তাদের প্রিয়াস মডেলের গাড়িটি জাপান থেকে আমদানি করা হয়। জেনারেল মোটরস কোরিয়া ও মেক্সিকো থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ যন্ত্রাংশ ও গাড়ি আনে, যেখানে ভক্সওয়াগেনও মেক্সিকোর ওপর নির্ভর করে, যদিও তারা যুক্তরাষ্ট্রে অ্যাটলাস এসইউভি তৈরি করে।
অক্সফোর্ড ইকোনমিক্সের মতে, কিছু কোম্পানি যুক্তরাষ্ট্রের কারখানায় উৎপাদন সরিয়ে নিতে পারে, তবে এতে দাম বাড়বে এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান বাণিজ্যিক অংশীদারদের উৎপাদন উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যাবে। ট্রাম্পের শুল্ক আরোপের প্রভাব বেশি পড়বে জার্মানি ও যুক্তরাজ্যের গাড়ি রপ্তানিকারকদের ওপর, যারা জাগুয়ার ল্যান্ড রোভার, মার্সিডিজ-বেঞ্জ ও অডির মতো প্রিমিয়াম ও বিলাসবহুল ব্র্যান্ডের গাড়ি যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করে।
ইতালি গাড়ি নির্মাতা ও রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান ফেরারি ইতোমধ্যে শুল্কের খরচ মেটাতে তাদের গাড়ির দাম ১০ শতাংশ বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে।
বিশ্লেষকদের মতে, ২৫ শতাংশ শুল্কের কারণে গাড়ি নির্মাতা কোম্পানিগুলো তাদের পণ্যের দাম বাড়াতে বা মুনাফা কমাতে বাধ্য হবে। কেউ কেউ যুক্তরাষ্ট্রের বাজার থেকে কিছু মডেল তুলে নিতে পারে, যা যুক্তরাষ্ট্রের গ্রাহকদের জন্য বিকল্প কমিয়ে দেবে বলে সতর্ক করেছেন অ্যান্ডারসন ইকোনমিক গ্রুপের প্রধান নির্বাহী প্যাট্রিক অ্যান্ডারসন। তার মতে, ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তের কারণে যুক্তরাষ্ট্রে বড় উৎপাদন কারখানা না থাকা কোম্পানি যেমন জাগুয়ার ল্যান্ড রোভার বা পোর্শের নিজ দেশে উৎপাদন কমতে পারে, যা চাকরির ওপর প্রভাব ফেলতে পারে।
ট্রাম্প দাবি করেছেন, এই শুল্ক স্থায়ী হবে এবং আমেরিকার উৎপাদন ভিত্তিকে শক্তিশালী করবে। হোয়াইট হাউস জানিয়েছে, গাড়ির শুল্ক ৩ এপ্রিল থেকে শুরু হবে, আর কিছু যন্ত্রাংশের শুল্ক এক মাস পর কার্যকর হবে। তবে মেক্সিকো ও কানাডা থেকে আসা যন্ত্রাংশ আপাতত শুল্কমুক্তই থাকবে।
জেপি মরগানের হিসাবে, নতুন শুল্কনীতির কারণে জেনারেল মোটরসের খরচ ১০.৫ বিলিয়ন ডলার এবং ফোর্ডের খরচ ২ বিলিয়ন ডলার বাড়তে পারে। পুরো শিল্পে এই অতিরিক্ত খরচ ৮০ বিলিয়ন ডলার ছাড়াতে পারে।
অটোস ড্রাইভ আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জেনিফার সাফাভিয়ান বলেন, এই শুল্কের ফলে দাম বাড়বে, বিক্রি কমবে এবং শিল্পে উৎপাদন কমে যাবে। তিনি বলেন, “কোম্পানিগুলো এখনও এর প্রভাব বোঝার চেষ্টা করছে, তবে এতে আমেরিকার গাড়ি শিল্পে প্রভাব পড়বে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।”
আরএ/টিএ