মস্কোর আগ্রাসনে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের পদধ্বনি? ইউক্রেনের পর আরও একটি ইউরোপীয় দেশকে নিশানা করবেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন? সেই আশঙ্কা যে ষোলো আনা তা এ বার স্পষ্ট করলেন মার্কিন শক্তিজোট নেটোর সেক্রেটারি জেনারেল মার্ক রুট। পাশাপাশি, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) নাগরিকদের ৭২ ঘণ্টার প্রয়োজনীয় সামগ্রী মজুত করার কথা বলায় গোটা মহাদেশ জুড়ে নতুন করে ছড়িয়েছে যুদ্ধের আতঙ্ক।
সম্প্রতি তিন বছরের বেশি সময় ধরে চলা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে পোল্যান্ডের রাজধানী ওয়ার’শতে মুখ খোলেন নেটোর সেক্রেটারি জেনারেল রুট। তিনি বলেন, ‘‘২০৩০ সালের মধ্যে ইউরোপ আক্রমণ করবে মস্কো।’’ পুতিনের পরবর্তী নিশানা পোল্যান্ড হতে পারে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন তিনি। ইউক্রেন সীমান্ত লাগোয়া দেশটি নেটোর পাশাপাশি ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। ফলে রুটের ওই মন্তব্যে ২৭ রাষ্ট্রের জোট ইইউতে রীতিমতো হইচই পড়ে গিয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে চলতি বছরের ২৬ মার্চ সম্ভাব্য বিশ্বযুদ্ধের কথা মাথায় রেখে ৪৫ কোটি নাগরিককে সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দেন ইইউর প্রস্তুতি ও সঙ্কট ব্যবস্থাপনা কমিশনার (প্রিপেয়ার্ডনেস অ্যান্ড ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট কমিশনার) হাদজ়া লাহবিব। আমজনতাকে তিন দিনের যাবতীয় প্রয়োজনীয় সামগ্রী সংগ্রহ করতে রাখতে বলেছেন তিনি। সেই তালিকায় রয়েছে খাবার, জল এবং ওষুধের মতো অতি গুরুত্বপূর্ণ পণ্য।
সংবাদ সংস্থা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, লাহবিব ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাসিন্দাদের হাতের কাছে একটি ছুরিও রাখতে বলেছেন। তাঁর কথায়, ‘‘ইউক্রেনে রুশ আক্রমণের ঝাঁজ বৃদ্ধি পাওয়ায় পরিস্থিতি জটিল হচ্ছে। ইউরোপ যে বড়সড় হুমকির মুখে দাঁড়িয়ে আছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।’’ তবে তাঁর দেওয়া সতর্কবার্তা নিয়ে ইইউভুক্ত দেশগুলির বাসিন্দারা প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন।
বিষয়টি নিয়ে সমাজমাধ্যমে লাহবিবকে ট্রোল করেছে ইইউর আমজনতা। তাঁদের কারও কারও প্রশ্ন, ‘‘প্রয়োজনীয় সামগ্রীর মধ্যে কি আগ্নেয়াস্ত্র পড়বে? এক এক জনের কতগুলি করে বুলেট রাখা উচিত?’’ উল্লেখ্য, ৭২ ঘণ্টার জন্য খাবার, জল বা ওষুধের মতো অত্যাবশ্যক পণ্য ৪৫ কোটি জনতা হঠাৎ করে মজুত করতে গেলে যে বিশৃঙ্খলা তৈরি হবে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। সেগুলির কালোবাজারি হওয়ার ব্যাপক আশঙ্কা নিয়ে পাল্টা লাহবিবকে খোঁচা দিয়েছেন সমাজমাধ্যম ব্যবহারকারীরা।
ইইউর প্রস্তুতি এবং সঙ্কট ব্যবস্থাপনা কমিশনার অবশ্য এ সব গায়ে মাখতে নারাজ। তাঁর যুক্তি, ‘‘বিশ্বযুদ্ধের আঘাত আচমকা গায়ে এসে পড়লে সেটা সামলাতে পারবে না ইউরোপ। তাই খারাপ থেকে খারাপতর পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত থাকার ৪৫ কোটি কারণ রয়েছে। আর সেটা শান্তিপ্রিয় আমজনতাকে বুঝতে হবে।’’
গত ২৫ মার্চ রুশ ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ক্ষতবিক্ষত হয় ইউক্রেনীয় শহর সুমি। তার পরই বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কা করে তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য করেন নেটোর সেক্রেটারি জেনারেল। তবে এ ব্যাপারে মস্কোকে পাল্টা হুঁশিয়ারি দিতে ছাড়েননি তিনি। প্রেসিডেন্ট পুতিন আরও একটি ইউরোপীয় দেশ আক্রমণ করলে তাঁকে ‘চরম মূল্য’ দিতে হবে, ওয়ার’শতে বলেছেন রুট।
নেটোর সেক্রেটারি জেনারেলের কথায়, ‘‘যদি কেউ মনে করে পোল্যান্ড বা অন্য কোনও মিত্র রাষ্ট্রের উপর হামলা চালিয়ে পার পেয়ে যাবে, তা হলে তিনি ভুল হিসাব করছেন। সে ক্ষেত্রে তাঁকে ভয়ঙ্কর জোটের পূর্ণ শক্তির মুখোমুখি হতে হবে। আর আমাদের প্রতিক্রিয়া হবে আরও ধ্বংসাত্মক।’’
এর পাশাপাশি সম্ভাব্য রুশ আক্রমণ ঠেকাতে সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধির দিকে নজর দিচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন-সহ পশ্চিম ইউরোপ। মার্কিন নির্ভরতা কমিয়ে শুধুমাত্র ইউরোপীয় নেটো তৈরির কথাও বলতে শুরু করেছে সেখানকার একাধিক দেশ। এর জন্য ইউক্রেনে যুদ্ধবিরতিতে ‘অনিচ্ছুক’ পুতিনের শরীরী ভাষাকেই দায়ী করছেন দুনিয়ার তাবড় প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞেরা।
এ বছরের জানুয়ারিতে দ্বিতীয় বারের জন্য শপথ নেওয়ার পর থেকেই পূর্ব ইউরোপে যুদ্ধ বন্ধ করার উপর জোর দিয়ে আসছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। গত মার্চে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জ়েলেনস্কির সঙ্গে ওয়াশিংটনের ওভাল অফিসে বৈঠক করেন তিনি। সেখানে তাঁকে যুদ্ধবিরতির জন্য চাপ দেন ট্রাম্প। কিন্তু তা মানতে অস্বীকার করায় প্রকাশ্যে তর্কাতর্কিতে জড়ান দুই রাষ্ট্রনেতা।
এর পর ইউক্রেনকে বাদ দিয়েই রাশিয়ার সঙ্গে সমঝোতা সূত্র বার করার রাস্তায় হাঁটেন ট্রাম্প। মস্কোর প্রতিনিধিদের সঙ্গে একাধিক বার সৌদি আরবে বৈঠক করেন ওয়াশিংটনের কর্তা-ব্যক্তিরা। ঠিক হয় বিষয়টি নিয়ে টেলিফোনে পুতিনের সঙ্গে কথা বলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। কিন্তু সেখানে তাঁকে ‘অপমান’ করার অভিযোগ ওঠে খোদ রুশ প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে।
যে সময়ে ট্রাম্প ফোনে কথা বলবেন বলে ঠিক হয়, তখন শিল্পপতিদের একটি অনুষ্ঠানে ছিলেন পুতিন। সূত্রের খবর, সেখানে ইউক্রেনে পুরোপুরি যুদ্ধবিরতিতে তাঁর আগ্রহ নেই বলে জানিয়ে দেন পুতিন।
মার্কিন প্রশাসনের অবশ্য দাবি, ইউক্রেনের শক্তিকেন্দ্রগুলিকে নিশানা করা থেকে বিরত থাকার আশ্বাস দিয়েছেন রুশ প্রেসিডেন্ট। পাশাপাশি, কৃষ্ণসাগরে আংশিক যুদ্ধবিরতির প্রতিশ্রুতি দেন তিনি। যদিও এক দিনের মাথাতেই ইউক্রেনের বন্দরে হামলা চালায় মস্কোর নৌসেনা। পুতিনের সাফ কথা, লড়াই শুরু হওয়ার প্রথম দিন থেকে জারি হওয়া যাবতীয় নিধেষাজ্ঞা অবিলম্বে প্রত্যাহার করুক আমেরিকা। তার পর যুদ্ধবিরতির বিষয়ে চিন্তা করা যাবে।
এই অবস্থায় আমেরিকার উপর পাল্টা চাপ তৈরি করতে ময়দানে নেমেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। ইউক্রেন থেকে সম্পূর্ণ ভাবে রুশ সৈন্য প্রত্যাহার হলে তবেই যুদ্ধবিরতি হওয়া উচিত বলে পাল্টা সুর চড়িয়েছে ২৭ রাষ্ট্রের ওই জোট। কিভে সামরিক এবং আর্থিক সহযোগিতা চালু রাখতে গত দু’মাসে অন্তত চার বার প্যারিসে বৈঠক করেছে ইইউর সমস্ত সদস্য দেশ।
অন্য দিকে ইউক্রেনে যুদ্ধবিরতির ব্যাপারে একরকম অনড় ট্রাম্প। তিনি মনে করেন মার্কিন সামরিক সাহায্য ছাড়া রাশিয়ার সামনে টিঁকতেই পারবে না ইউরোপীয় ইউনিয়ন। আর তাই নেটো ত্যাগের হুমকি পর্যন্ত দিয়েছেন তিনি। এ ব্যাপারে তাঁর মূল পরামর্শদাতা হলেন বিশ্বের অন্যতম ধনকুবের ইলন মাস্ক। অবিলম্বে ইউরোপ থেকে আমেরিকান সৈন্যদের ঘরে ফেরানোর উপর জোর দিয়েছেন ট্রাম্পের কিচেন ক্যাবিনেটের সদস্য এই শিল্পপতি।
বিশেষজ্ঞদের দাবি, ট্রাম্প শেষ পর্যন্ত নেটো থেকে সরে এলে পশ্চিম ইউরোপ যে দুর্বল হয়ে পড়বে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। সেই কথা মাথায় রেখে এখন থেকে বিরাট বাহিনী তৈরির পক্ষে সওয়াল করেছে জার্মানি। অন্য দিকে নাগরিকদের বাধ্যতামূলক সৈন্য প্রশিক্ষণের কর্মসূচি চালু করার ঘোষণা করেছে পোল্যান্ড।
বিশেষজ্ঞদের অনুমান, বর্তমানে আমেরিকার তিনটি লক্ষ্য রয়েছে। প্রথমত, ইউরোপের অংশ হিসাবে স্বীকৃত বিশ্বের বৃহত্তম দ্বীপ গ্রিনল্যান্ড কব্জা করতে চাইছেন ট্রাম্প। দ্বিতীয়ত, পশ্চিম এশিয়ার পয়লা নম্বর শত্রু ইরানকে শিক্ষা দিতে সেখানে ফৌজি অভিযানের নির্দেশ দিতে পারেন তিনি। তৃতীয়ত, ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় চিনের প্রভুত্ব শেষ করার দিকে নজর দিয়েছে ওয়াশিংটন।
উল্লেখ্য, ১৯৩৯ সালে শুরু হওয়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফ্ল্যাশপয়েন্ট ছিল পোল্যান্ড। ৮৬ বছর পর পূর্ব ইউরোপের সেই দেশটিকে ঘিরে ফের ঘনাচ্ছে যুদ্ধের কালো মেঘ। ওয়ার’শতে নেটোর সেনাছাউনি রয়েছে। সেখান থেকে মার্কিন সৈন্য দেশে ফিরে গেলে আক্রমণের নির্দেশ দেবেন পুতিন? নাকি ‘বন্ধু’ বেলারুশকে এর জন্য এগিয়ে দেবেন তিনি? নেটো ভাঙলে তুরস্কের সমর্থন পাবে মস্কো? তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কার মধ্যে তুঙ্গে উঠেছে এই সমস্ত জল্পনা।
এফপি/এসএন