তিন বিঘা জমি কাল হলো ৯০ বছরের বৃদ্ধা মায়ের, খোলা আকাশের নিচে ঠাঁই

আট সন্তানের মা সুফিয়া বেগম। সন্তানদের অতি আদর যত্নে বড় করেছেন। মুখে হাসি ফোটাতে বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করেননি তিনি। শেষ বয়সে সেই ৮ সন্তানের কাছে চেয়েছিলেন একটু আশ্রয় ও দু’বেলা খাবার। সেই মা আশ্রয় তো পেলেনই না, খাবারও দেন না তার সন্তানরা। বৃদ্ধা ‘মা’ এখন সন্তানদের বোঝা।

তিন বিঘা জমি মেয়েদের নামে লিখে দেওয়ায় কাল হলো তার। স্বামীর ৪০ বিঘা সম্পত্তি থাকার পরও তার কপালে জুটছে না জীবনের শেষ প্রান্তে শান্তিতে ঘুমানোর জায়গা আর দু’বেলা ঠিকমতো খাবার। সেই ৯০ বছর বয়সের বৃদ্ধা মাকে রাতে অন্ধকারে রেখে আসা হলো খোলা আকাশের নিচে।


বলছি বৃদ্ধা সুফিয়া বেগমের অসহায়ত্বের কথা। নওগাঁর বদলগাছী উপজেলার মথুরা ইউপির জগৎনগর গ্রামের মৃত মহাতাব হোসেনের স্ত্রী তিনি। বয়সের ভারে ঠিকমতো কথা বলতে পারেন না। করতে পারেন না চলাফেরাও। তিন ছেলে ও ৫ মেয়ের জননী তিনি।

জানা গেছে, বড় ছেলে মোতাহার হোসেন স্থানীয় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক, অপর দুই ছেলে মশিউর রহমান ও আতোয়ার রহমান কৃষি কাজ করেন। আর মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেছে। ৮ বছর আগে স্বামী মারা যায়। স্বামীর রেখে যাওয়া ৪০ বিঘা সম্পত্তির ভাগ বাটোয়ার নিয়ে ছেলে মেয়ের মাঝে বাঁধে বিরোধ। এরপর আর কেউ মায়ের ভরণ পোষণের দায়িত্ব নিতে চায় না। তাইতো সম্পত্তির জন্য বৃদ্ধা মায়ের স্থান হলো খোলা আকাশের নিচে। ফেলে গেল তার আপন সন্তান।

বৃহস্পতিবার (৩ এপ্রিল) রাত সাড়ে ৭টার দিকে জগৎনগর গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। বিষয়টি এলাকায় জানাজানি হলে সন্ধ্যার পর বৃদ্ধা সুফিয়া বেগমকে এক নজর দেখতে গ্রামবাসীর ঢল নামে।

স্থানীয় গ্রামবাসীরা জানান, জগৎনগর গ্রামে ছেলেদের বাড়ির সামনে একটি ফাঁকা মাঠে সুফিয়া বেগম রেখে যান তার মেয়ে ও জামাই। খোলা আকাশের নিচে একটি বালিশের নিচে মাথা দিয়ে শুয়ে আছেন। কথা বলার চেষ্টা করলে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকছেন। কিছু বলার চেষ্টা করেও বলতে পারে না। বৃদ্ধা সুফিয়া বেগমের কষ্ট দেখে রাতে মশার হাত রক্ষার জন্য গ্রামবাসী মশারি টাঙিয়ে দেন। মশার কামড় থেকে রক্ষায় কেউ আবার কয়েল জ্বালিয়ে দেন।

তবে ঘটনার এক ঘণ্টা পর থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে এলে ছেলে মশিউর রহমান তার মা সুফিয়া বেগমকে খোলা মাঠ থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে তার বাড়িতে জায়গা দেন।
গ্রামবাসীরা বলেন, সুফিয়া বেগমের স্বামীর ৪০ বিঘার প্রায় সব জমিই ছেলেরা দখলে রাখে। এছাড়া কিছু জমি ছেলেরা আগেই তার বাবার কাছ থেকে লিখে নেয়। বিষয়টি জানতে পেরে বৃদ্ধা সুফিয়া বেগম তার নামে থাকা তিন বিঘা জমি পাঁচ মেয়েদেরকে লিখে দেন। এরপর ছেলেদের কাছে শত্রু হয়ে যায় জন্মদাতা ‘মা’। তারপর থেকেই মায়ের খোঁজ নেয় না ছেলেরা।

এমতাবস্তায় ৫ মেয়ে পর্যায়ক্রমে মাকে দেখভাল করতেন। গত কয়েক মাস থেকে একই গ্রামের ছোট মেয়ে আঙ্গুর বেগম ও জামাই ফিরোজ হোসেনের বাড়িতে নিয়ে দেখভাল শুরু করেন। কিন্তু আঙ্গুর বেগমের ভাই ও অন্য বোনরা মায়ের কোনো খোঁজ-খবর নেন না। এমনকি ভরণপোষণের কোনো ব্যবস্থা করেননি। অভাব অনটনের সংসারে তাই ভাই ও অন্য বোনদের ওপর ক্ষোভে আঙ্গুর বেগম ও জামাই ফিরোজ হোসেন বৃদ্ধা সুফিয়া বেগমকে খোলা আকাশের নিচে রেখে যান।

জামাই ফিরোজ হোসেন বলেন, শাশুড়ি আমার কাছেই ছিল। কোনো ছেলেরা তার খোঁজ খবর নেয় না। অসুস্থ হওয়ার খবর শোনার পরও ছেলেরা মাকে দেখতে আসেননি। ছেলেদের বাড়িতে রাখতে গেলেও তার মাকে নিতে অস্বীকার করেন। তাই ক্ষোভ ও রাগ করে আঙ্গুর বেগম তার ভাইদের বাড়ির সামনে তার মাকে ফাঁকা মাঠে ফেলে আসে।

মথুরাপুর ইউপির প্যানেল চেয়ারম্যান আহসান হাবিব লিটন জানান, অসুস্থ হওয়ার খবর শোনার পরও ছেলেরা তাদের মাকে দেখতে যাননি। ছেলেদের বাড়িতে বৃহস্পতিবার বিকেলে রাখতে এলে মাকে নিতে অস্বীকার করেন। তাই ক্ষোভ ও রাগ করে আঙ্গুর বেগম ছেলেদের বাড়ির সামনে তার মাকে ফাঁকা মাঠে রেখে যান।

অপর প্রশ্নে তিনি আরও বলেন, তাদের সঙ্গে কথা বলা হয়েছে। যদি তাদের মাকে না ভরণপোষণ করেন তাহলে আইনি ব্যবস্থা নিতে সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে।
বদলগাছী থানার উপ-পরিদর্শক নিহার চন্দ্র বলেন, তার ছেলেদের সঙ্গে কথা বলেছি। তার ছেলে মশিউরের কাছে আছে বৃদ্ধা মা সুফিয়া বেগম। মায়ের ভরণ পোষণের দায়িত্ব না নিলে ছেলে-মেয়েদের বিরুদ্ধে ভরণ পোষণ আইনে মামলা করা হবে।

পরবর্তীতে এ ধরণের ঘটনা ঘটলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিলেন বদলগাছী উপজেলা নির্বাহী অফিসার ইসরাত জাহান ছনি।

এসএন 

Share this news on:

সর্বশেষ

img

ডা. কে এম বাবর

গোপালগঞ্জের তিনটি আসন তারেক রহমানকে উপহার দিতে চাই Nov 24, 2025
img
মানুষ ইসলামের পক্ষে ভোট দিতে ব্যাকুল হয়ে আছে: চরমোনাই পীর Nov 24, 2025
img
বাংলাদেশ জাতীয় দলের ২২ কর্মী পিস্তলসহ আটক Nov 24, 2025
img
দুর্নীতি চাওয়া না চাওয়ার মধ্যে ফাঁক রয়েছে : দুদক চেয়ারম্যান Nov 24, 2025
img
দেশের সব সংস্কার আইনের মাধ্যমেই হয়েছে: আইন উপদেষ্টা Nov 24, 2025
img
ব্রিসবেনে দ্বিতীয় টেস্টেও অনিশ্চিত প্যাট কামিন্সের দলে ফেরা Nov 24, 2025
img
১০ বছর প্রেমের পর বিয়ে করছেন ২ কোরিয়ান তারকা Nov 24, 2025
img
পররাষ্ট্র উপদেষ্টার সঙ্গে কমনওয়েলথ মহাসচিব শার্লি বচওয়ের সাক্ষাৎ Nov 24, 2025
img
নির্বাচন ও গণভোট একসঙ্গে করায় খরচ বাড়বে : অর্থ উপদেষ্টা Nov 24, 2025
img
আগামী ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে তাপমাত্রা আরো কমবে Nov 24, 2025
img
মরক্কোর প্রধান প্রটোকল কর্মকর্তার সঙ্গে বাংলাদেশি দূতের সাক্ষাৎ Nov 24, 2025
img
জানুয়ারিতে শুরু হচ্ছে ঢাকা চলচ্চিত্র উৎসব Nov 24, 2025
img
পায়ে চোট নিয়ে আবারও শুটিংয়ে ফিরলেন শ্রদ্ধা কাপুর Nov 24, 2025
img
ফুটবল ইতিহাসে যৌথভাবে সর্বোচ্চ অ্যাসিস্টের মালিক হলেন মেসি Nov 24, 2025
img
রাজধানীতে ট্রাফিক আইন লঙ্ঘনে ডিএমপির ১০৪৫ মামলা Nov 24, 2025
img
নির্বাচনে সশস্ত্র বাহিনীর ভূমিকা হবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ: নৌবাহিনী প্রধান Nov 24, 2025
img
ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচনে ভোট দিতে ১৭ হাজার ৯০০ প্রবাসীর নিবন্ধন Nov 24, 2025
img
ভিয়েতনামে বৃষ্টি ও ভূমিধসে প্রাণ গেল অন্তত ৯০ জনের, নিখোঁজ ১২ Nov 24, 2025
img
কঠিন সময় পেরোতে হনুমান চালীসাই ভরসা রিয়া চক্রবর্তীর Nov 24, 2025
img
ইউরোপের সবচেয়ে ক্ষমতাধর সেনাবাহিনী গড়তে চায় জার্মানি Nov 24, 2025