যুক্তরাষ্ট্রের ক্রয়াদেশ স্থগিত হওয়া শুরু,রপ্তানিকারকদের উদ্বেগ

ঢাকার সাভারের এসেন্সর ফুটওয়্যার অ্যান্ড লেদার প্রোডাক্টস নামের প্রতিষ্ঠান চলতি সপ্তাহে তিন লাখ মার্কিন ডলারের চামড়ার ব্যাগ যুক্তরাষ্ট্রে পাঠাতে জাহাজীকরণের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। কিন্তু গতকাল রোববার সকালে ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা বার্তা পাঠিয়ে পণ্য জাহাজীকরণ না করার নির্দেশনা দেন।

বিষয়টি নিশ্চিত করে এসেন্সর ফুটওয়্যার অ্যান্ড লেদার প্রোডাক্টসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) কে এম মুশফিকুর রহমান গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা চলতি সপ্তাহের শেষ দিকে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের পাল্টা ট্যারিফ নিয়ে আলোচনা করবেন।

তাঁরা আসলে বাড়তি শুল্কের লোকসান মেটাতে মূল্যছাড় চাইছেন। মুশফিকুর রহমান জানান, তাঁরা প্রতি মাসে গড়ে ১০ লাখ মার্কিন ডলারের চামড়া পণ্য রপ্তানি করেন। তাঁদের মোট রপ্তানির ৯০ শতাংশের গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র।

এসেন্সর ফুটওয়্যার অ্যান্ড লেদার প্রোডাক্টসের মতো আরও কিছু রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যে মার্কিন ক্রেতাদের কাছ থেকে চলমান ক্রয়াদেশের পণ্য সাময়িক সময়ের জন্য স্থগিত রাখার নির্দেশনা পেয়েছে। কোনো কোনো ক্রেতা প্রতিষ্ঠান মূল্যছাড় চেয়েছে বলেও জানা গেছে।

তৈরি পোশাক ও চামড়া খাতের কয়েকজন রপ্তানিকারক প্রথম আলোকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্রয়াদেশ স্থগিত কিংবা মূল্যছাড় দাবির সংখ্যাটি এখনো তুলনামূলক কম। সাপ্তাহিক ছুটি শেষে রোববার থেকে ক্রেতারা প্রতিক্রিয়া জানাতে শুরু করেছেন। তা আজ সোমবার থেকে বাড়তে পারে। চলতি সপ্তাহেই প্রকৃত পরিস্থিতি বোঝা যাবে।

দ্বিতীয় মেয়াদে মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়া ডোনাল্ড ট্রাম্প আগেই শুল্ক আরোপের হুমকি দিয়ে রেখেছিলেন। হোয়াইট হাউসের গোলাপবাগানে গত বুধবার (২ এপ্রিল) সেখানকার সময় বিকেল চারটায় (বাংলাদেশের রাত দুইটা) নতুন শুল্কনীতি ঘোষণা করেন ট্রাম্প। তিনি বিশ্বের সব আমদানিকারক দেশের ওপর গড়ে ন্যূনতম ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেন। তবে বেশ কিছু দেশের পণ্য আমদানিতে বাড়তি শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। ট্রাম্পের পাল্টা শুল্ক আরোপের এই ঘটনায় দুনিয়াজুড়ে কয়েক দিন ধরে তোলপাড় চলছে।

ডোনাল্ড ট্রাম্প বাংলাদেশি পণ্যে ৩৭ শতাংশ পাল্টা শুল্ক আরোপ করেন। বাংলাদেশের প্রতিযোগী দেশ ভারত ও পাকিস্তানে এই শুল্ক কম বসেছে, যথাক্রমে ২৬ ও ২৯ শতাংশ। তবে আরেক প্রতিযোগী ভিয়েতনামে ৪৬ শতাংশ পাল্টা শুল্ক বসিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। চীনে পাল্টা শুল্কসহ মোট শুল্কহার দাঁড়িয়েছে ৫৪ শতাংশ।

শুল্কহার নির্ধারণে মার্কিন প্রশাসন একটি সূত্র প্রয়োগ করেছে। সেটি হচ্ছে নির্দিষ্ট দেশের বাণিজ্য–ঘাটতিকে যুক্তরাষ্ট্রের আমদানির পরিমাণ দিয়ে ভাগ করে যা পাওয়া যায়, তার শতাংশ ধরে শুল্ক হিসাব করা হয়েছে। তাতে যে ফল পাওয়া গেছে, তার অর্ধেক শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। এই সূত্র অনুযায়ী বাংলাদেশের ক্ষেত্রে শুল্ক হার দাঁড়ায় ৭৪ শতাংশ। তবে তার অর্ধেক বা ৩৭ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে বাংলাদেশের পণ্যে।

মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধির দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে ৮৩৬ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে। এর বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ২২১ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করেছে বাংলাদেশ। এই হিসাবে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য–ঘাটতির পরিমাণ ৬১৫ কোটি ডলার।

পোশাকের ক্রয়াদেশ স্থগিত হচ্ছে

বাংলাদেশের মোট রপ্তানি আয়ের ৮০ শতাংশ বা তার চেয়েও বেশি আসে তৈরি পোশাক খাত থেকে। আর সেই পোশাক রপ্তানির একক বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্র। সর্বশেষ ২০২৩–২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হওয়া তৈরি পোশাকের ১৮ শতাংশের গন্তব্য ছিল যুক্তরাষ্ট্র। ফলে ট্রাম্পের পাল্টা শুল্ক আরোপের পর থেকেই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন দেশের পোশাক রপ্তানিকারকেরা। তাঁরা এখন ভীষণ উদ্বেগের মধ্যে আছেন।

উইকিটেক্স–বিডি নামে একটি বায়িং হাউসের তিন লাখ ডলারের ক্রয়াদেশ গতকাল স্থগিত করেছে যুক্তরাষ্ট্রের একটি ক্রেতা প্রতিষ্ঠান। যদিও সে ক্রয়াদেশের পণ্য উৎপাদনের জন্য ইতিমধ্যে কাপড়ও আমদানি করে ফেলেছে বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠানটি। এ ছাড়া দেড় লাখ ডলারের আরেকটি ক্রয়াদেশ স্থগিত হয়েছে এই প্রতিষ্ঠানের।

বিষয়টি নিশ্চিত করে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) এ কে এম সাইফুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার মার্কিন ক্রেতা প্রতিষ্ঠান বলছে পণ্যের মূল ক্রেতার কাছে থেকে বাড়তি দাম আদায়ের কোনো সুযোগ নেই। সে কারণে আমাদের দাম কমাতে বলছে।’

বাংলাদেশ গার্মেন্টস বায়িং হাউস অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিবিএ) নেতারা জানান, একটি বায়িং হাউস প্রতি মাসে ১২ লাখ ডলারের তৈরি পোশাক যুক্তরাষ্ট্রের একটি ক্রেতা প্রতিষ্ঠানে রপ্তানি করে। ১৭ লাইনের একটি কারখানায় এসব পোশাক উৎপাদন হতো। পাল্টা শুল্ক আরোপের পর সেই মার্কিন ক্রেতা প্রতিষ্ঠান যেসব পণ্য জাহাজীকরণ হয়েছে, সেসব পণ্যে মূল্যছাড় দাবি করেছে। শুধু তা–ই নয়, আগামী জুনের ক্রয়াদেশও স্থগিত করেছে। জুলাই থেকে পণ্য পাঠাতে হবে না তা জানিয়ে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ওই ক্রেতা প্রতিষ্ঠান।

বাংলাদেশের শীর্ষ ১০ তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকের একটি হলো প্যাসিফিক জিনস গ্রুপ। গত ২০২৩–২৪ অর্থবছরে তারা ৪০ কোটি ৫০ লাখ ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করে। তার মধ্যে ৪ কোটি ৯০ লাখ ডলারের ডেনিম পণ্যের গন্তব্য ছিল যুক্তরাষ্ট্র।

প্যাসিফিক জিনস গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মোহাম্মদ তানভীর গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে সাপ্তাহিক ছুটির কারণে দুই দিন ক্রেতা প্রতিনিধিদের কোনো প্রতিক্রিয়া পাইনি। কাল (আজ) খুললে হয়তো ক্রেতারা প্রতিক্রিয়া দেখানো শুরু করবেন।

এদিকে গতকাল রাতে রাজধানীর একটি হোটেলে ট্রাম্পের পাল্টা শুল্ক নিয়ে তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর প্রশাসক মো. আনোয়ার হোসেন তৈরি পোশাকসহ অন্য খাতের ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। এতে রপ্তানিকারকেরা আশঙ্কা প্রকাশ করেন, এই সংকটের সমাধান না হলে পণ্য রপ্তানিতে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

ক্রেতারা কী ধরনের প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন, জানতে চাইলে বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি রুবানা হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘রপ্তানিকারকদের কাছ থেকে আমরা জানতে পারছি, যুক্তরাষ্ট্রের বড় ক্রেতা প্রতিষ্ঠান ওয়ালমার্ট ও গ্যাপ বাংলাদেশের সরবরাহকারীদের ৩৭ শতাংশ শুল্ক বহন করতে বলছে। ক্রয়াদেশ স্থগিত করার নির্দেশনাও আসছে।’

এফপি/টিএ 

Share this news on:

সর্বশেষ