‘এখন পয়লা বৈশাখটা বাঙালি হওয়ার দিনে পরিণত হয়েছে’

নববর্ষ মানেই বাঙালির নস্ট্যালজিয়া আর ঐতিহ্যের আবহ। তবে সময়ের সঙ্গে বদলেছে উৎসবের রূপ ও অনুভব। অতীতের স্মৃতি ও এবারের বৈশাখের প্রস্তুতি নিয়ে মত প্রকাশ করেছেন কাঞ্চন মল্লিক।

আমি যেহেতু কালীঘাট নিবাসী। তাই পয়লা বৈশাখ বলতেই মনে পড়ে, মা কালী বাড়ি চত্বরে উপচে পড়া ভিড়। ভোলা হালদারের দোকান। আর ওই হালখাতায় শালু কাপড় মোড়ানো খাতার মধ্যে তিনটে কাঁচা পয়সার সিঁদুরে ছাপ দেওয়া হত। একটা স্বস্তিক চিহ্ন আঁকা হত। আর দোয়াতের কালিতে লেখা হত- ওম গণেশায় নমঃ। এখানে একটা মজার বিষয় ছিল। যাঁর হাতের লেখা ভালো, তার উপর দায়িত্ব পড়ত এটা লেখার। এবং আমরা তখন এক টাকা কিংবা দু’ টাকা করে পেতাম এই তিনটে ছাপ, একটা করে স্বস্তিক চিহ্ন আর ওই মন্ত্রটা লেখার জন্য। সেটা করতাম নববর্ষের আগের রাতে। বছরের পয়লা দিন উপলক্ষে মা কালী বাড়িতেও প্রচণ্ড ভিড় হত। পুজো দেওয়া থেকে শুরু করে দোকান থেকে এত পুজো যেত, কালীঘাট চত্বরে পয়লা বৈশাখের উন্মাদনা বরাবরই আলাদা। আজও সেটা বহাল রয়েছে। দর্শনার্থীদের জন্য সব বন্ধুদের দোকানে মিষ্টির ডালা তৈরি করতাম আগের রাত থেকেই। ‘হারান মাঝি’ বলে যে দোকানটা রয়েছে, ওখানকার গরম তোতাপুরি খেয়েই শুরু হত আমাদের নববর্ষ উদযাপন। আরেকটা হচ্ছে চ্যাপটা রসগোল্লা। যা কিনা মায়ের শীতল ভোগে যায় ওই দোকান থেকে। ওই মিষ্টিটাও গরম গরম খাওয়ার ব্যাপার থাকত। আর রাতে বাড়িতে মুরগি কিংবা পাঁঠার ঝোল দিয়ে খাওয়া-দাওয়া। মা রান্না করতেন। আগের দিন সন্ধে থেকেই আমাদের বড় ব্যস্ততা শুরু হয়ে যেত। কারণ রাত পোহালেই তো পয়লা বৈশাখ। অতঃপর সকাল সকাল সব জায়গায় হালখাতা। প্রচুর ভিড় থাকত, তাই আমাদের হাতও চালাতে যত দ্রুত সম্ভব। ছোটবেলায় সব বন্ধুরা মিলে এই কর্মযজ্ঞে শামিল হওয়ার আনন্দটাই ছিল আলাদা।

মা যতদিন বেঁচে ছিলেন, প্রতিবার নববর্ষে একটা নতুন রুমাল কিংবা গেঞ্জি হলেও উপহার দিতেন। সেটা মিস করি। যদিও সেই দায়িত্বটা এখন অবশ্য আমার বউ শ্রীময়ী (চট্টরাজ মল্লিক) পালন করে। একটা লুঙ্গি হোক বা জামা, নতুন পোশাক কিনে আনে। এবারও তাই করেছে। শ্রীময়ী যা কেনে সেটাই পরে ফেলি চোখ বন্ধ করে। তাছাড়া এখন কাজের চাপে আমাদের আলাদা করে আগের মতো পয়লা বৈশাখ উদযাপনের উন্মাদনাও থাকে না। এবার ‘রক্তবীজ ২’-এর শুটিং রয়েছে। চেষ্টা করব, কাজ সেরে পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানোর। যেহেতু সকালে শুটিং, তাই ইচ্ছে রয়েছে সবাই মিলে কবজি-কনুই ডুবিয়ে নৈশভোজ সারার। উপরন্তু এবার আমার মেয়ের প্রথম পয়লা বৈশাখ। তাই আমাদের বাড়িতে বিরাট ব্যাপার। আমার শাশুড়ি মা ইতিমধ্যেই তাঁর নাতনির জন্যে ধুতি-পাঞ্জাবি কিনে ফেলেছেন। নববর্ষ উপলক্ষে মেয়ের জন্য সোনার গয়না কিনেছি। আমার স্ত্রীয়ের অবশ্য এতে অভিযোগ রয়েছে। বলছে- এই বয়সে মেয়ে গয়না পরবে! কারণ শ্রীময়ীর জন্য গয়না কেনা হয়নি আমার। আর আমি বরাবর খাদ্যরসিক। বিশেষ করে ‘মাটন-রসিক’। পয়লা বৈশাখ হোক বা অন্য কোনও উৎসব-অনুষ্ঠান, পাঁঠার মাংস ছাড়া আমার আবার জমে না। শ্রীময়ী দারুণ মাটন রান্না করে। আগে মা ছাড়া অন্য কারও হাতে রান্না মুখে রুচত না, এখন ওঁর হাতের পাঁঠার ঝোল ছাড়া ভালো লাগে না।

কালের পরিবর্তনের সঙ্গে এখনকার উদযাপনের কলেবর বদলেছে। অনেকটা আলাদাই বটে! এখন সোশাল মিডিয়ার কৃপায় পয়লা বৈশাখটা বাঙালি হওয়ার দিনে পরিণত হয়েছে। আমরা বাঙালি, আমি বাঙালি… এমন গোছের হাবভাব দেখি। এখন কথার মাঝখানে এত বেশি ইংরেজি ব্যবহার হয়। ওই খানিক ভ্রাতৃত্বের পয়লা বৈশাখ যাপনের থেকে ‘Hi Bro’-তে এসে ঠেকেছে ব্যাপারটা। অনেকে হয়তো বাংলা সালটাও বলতে পারবেন না! এই ১৪৩২-এর নববর্ষে আমরা যদি দিনভর বাংলায় কথা বলি, কিংবা একটু চেষ্টা করি, তাহলে বোঝহয় মন্দ হয় না বিষয়টা।

আরএম/এসএন 

Share this news on:

সর্বশেষ

img
গুরুতর অসুস্থ অভিনেতা জাভেদ, হাসপাতালে ভর্তি Apr 16, 2025
img
টাইম ম্যাগাজিনের ১০০ প্রভাবশালীর তালিকায় ড. ইউনূস Apr 16, 2025
img
মিরপুরে ফুটপাত দখলমুক্ত করতে টানা ৩ দিন অভিযান করবে ডিএনসিসি Apr 16, 2025
img
১০২০ কোটি টাকার বন্ড কেলেঙ্কারি: সালমান এফ রহমানসহ ৩০ জনের বিরুদ্ধে দুদকের মামলা Apr 16, 2025
img
দিনভর অবরোধ ভোগান্তি, পৌনে ৯ ঘণ্টা পর অবশেষে যানচলাচল শুরু Apr 16, 2025
img
ভরিতে ৩০৩৩ টাকা বেড়ে সোনার দাম ১ লাখ ৬৫ হাজার ছাড়াল Apr 16, 2025
img
সুপ্রিম কোর্টে বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন দুটি টয়লেট চালু Apr 16, 2025
img
হাসনাতের স্ট্যাটাসকে ঘিরে বিতর্ক, প্রতিক্রিয়ায় এনসিপি নেতা মুশফিক Apr 16, 2025
img
ট্রাম্পের প্রতিনিধির সঙ্গে যে কথা হলো জামায়াত আমিরের Apr 16, 2025
img
উন্মুক্ত স্থানে বর্জ্য পোড়ালেই ব্যবস্থা : পরিবেশ উপদেষ্টা Apr 16, 2025