শহরের কংক্রিটের দেয়ালের ফাঁকে আটকে থাকা শিশুদের শৈশব যেন হারিয়ে যাচ্ছে নিঃসঙ্গতায়। খেলার মাঠের অভাব ও ব্যস্ত পারিবারিক জীবন শিশুকে গড়ে তুলছে একা, নিঃসঙ্গ ও আবেগশূন্য মানুষ হিসেবে। সমাজ বিজ্ঞানীরা বলছেন, শিশুদের জন্য প্রয়োজনীয় খেলার মাঠ নিশ্চিত করার পাশাপাশি প্রয়োজন রাষ্ট্রীয়ভাবে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
শৈশব মানেই বন্ধুদের সঙ্গে দৌড়ঝাঁপ, হৈচৈ, রঙিন দিন-রাত। দল বেঁধে মাঠে হারে রে রে করে দৌড়, বাঁধন হারা দূরন্ত শৈশব। কিন্তু কালের পরিক্রমায় এসবই এখন স্মৃতি। কংক্রিটের দেয়ালে বন্দি শিশুদের শৈশব যেন হারিয়ে যাচ্ছে নিঃসঙ্গতায়।
সম্পর্কের সীমানাও যেন এখন আঁটসাঁট। তাইতো ঘরের কোণে বসে মোবাইলে কার্টুনের রঙিন দুনিয়ায় হারিয়ে যাওয়া শহরের শিশুদের নেই কোনো বন্ধুত্ব, নেই খেলায় মেতে ওঠার আনন্দ। শহরের এই শিশুদের কাছে একমাত্র বিকেলের ছাদ কিংবা বাসার গ্যারেজই যেন একান্ত নিজের রাজ্য।
খেলার মাঠের অভাব ও ব্যস্ত পারিবারিক জীবন শিশুকে গড়ে তুলছে একা, নিঃসঙ্গ ও আবেগশূন্য মানুষ হিসেবে, যার অনেকটাই ব্যতিক্রম গ্রামের শিশুদের ক্ষেত্রে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, শিশুর সুস্বাস্থ্যের জন্য দিনে অন্তত এক ঘণ্টা শারীরিক সক্রিয়তা জরুরি, যা শহরের শিশুদের ক্ষেত্রে নেই বললেই চলে। ফলে তারা হয়ে পরছে অতিরিক্ত প্রযুক্তিনির্ভর, যা তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের উপর ফেলছে মারাত্মক প্রভাব।
তবে ব্যতিক্রম গ্রামের শিশুদের বেলায়। নদীর পানিতে ডুবসাঁতার, বন্ধুদের সঙ্গে খুঁনসুটি গল্পে শৈশব এখানে মুক্ত পাখির মতো। যেন বইয়ের বাইরে শেখার আছে এক বিশাল জগৎ। এই শিশুদের ছেলেবেলা রঙিন হয় প্রকৃতির অফুরন্ত রঙে, দিন কাটে একান্ত পারিবারিক আবহে।
গবেষণা বলছে, শহরের শিশুরা ঘরের বাইরে খেলার সুযোগ পায় দিনে গড়ে ১ থেকে ২ ঘণ্টা। যেখানে গ্রামের শিশুরা পায় ৪ থেকে ৫ ঘণ্টা। এছাড়াও ২০২২ সালে প্রকাশিত এক গবেষণা অনুসারে, দেশের স্কুলগামী কিশোর-কিশোরীদের ৭৩.৫ শতাংশের মাঝেই রয়েছে মানসিক চাপজনিত লক্ষণ, যার মধ্যে গ্রামীণ কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে চাপ দেখা যায় সবচেয়ে কম যা প্রায় ৩২ শতাংশ।
দীর্ঘদিন একাকিত্ব নিয়ে শৈশব পার করছে যেসব শিশু, তাদের মানসিক বিকাশে পরছে নেতিবাচক প্রভাব। ধীরে ধীরে এই শিশুরা হয়ে পরে অন্তর্মুখী, কমে সামাজিক দক্ষতা। মনোবিদরা বলছেন, প্রযুক্তিনির্ভর হওয়ায় বিষণ্নতা ও উদ্বেগের শিকার হতে পারে তারা।
এ বিষয়ে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালের শিশু-কিশোর মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. জেবুন নাহার বলেন, ‘বিভিন্ন পরিবেশ ও সামাজিক পরিস্থিতিতে যোগাযোগের দক্ষতা গ্রামের বাচ্চাদের তুলনায় শহরের বাচ্চাদের কম। ইন্টারনেট, গেমিং বা পর্নোগ্রাফিতে আসক্তির বিষয়টা শহরের বাচ্চাদের মধ্যে বেশি।’
সমাজ বিশ্লেষক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান বলেন, গ্রামের বাচ্চাদের মধ্যে হয়ত ১০ শতাংশ সমস্যা হতে পারে। কিন্তু শহরের বাচ্চাদের মধ্যে ৮০ বা ৯০ শতাংশ সমস্যা হতে পারে বলে মনে হচ্ছে। নিরাপত্তার সমস্যাটা দূর করতে পারলে এবং কিছু দৃশ্যমান পদক্ষেপ যেমন খেলাধূলার মাঠ ও পরিবারের সঙ্গে বাচ্চাদের সময় কাটাতে দিলে ভালো কিছু হতে পারে।
প্রযুক্তির নেতিবাচক প্রভাবে গ্রামের শিশুদের রঙিন শৈশবও ধীরে ধীরে হচ্ছে ধূসর। সেজন্যে শহর কিংবা গ্রাম সবখানেই প্রয়োজন শিশুর বাড়তি যত্ন ও সুরক্ষা, যাতে প্রতিটি শিশুই তার শৈশবকে মনে রাখতে পারে রঙিন জলছবির মতো। না হয় আক্ষেপে (অপূর্ণতার) শৈশবের দ্বায়ভার বর্তাবে আমাদের সবার উপর।
আরএম/এসএন