মা হতে না চাওয়াও স্বাভাবিক! আমি অনেকটা সময় কাটিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছি

ছোটবেলা থেকে নববর্ষ মানেই স্কুলের অনুষ্ঠান। ‘এসো হে বৈশাখ’ গানের সঙ্গে লাল পাড় শাড়ি পরে নাচ আর লোডশেডিং-এ গরমে সেদ্ধ হতে হতে ২৫শে বৈশাখের অনুষ্ঠানের জন‍্য মহড়া দেওয়া। প্রধানত এটাই আমার নববর্ষের স্মৃতি। কারণ, স্কুল পাশ করে যাওয়ার পর আর কোনও দিন ঘটা করে এই উপলক্ষে অনুষ্ঠান করিনি। আর স্বীকার করতে চরম অস্বস্তি হলেও, ইংরেজি নতুন বছরের দাপটে কিছুটা হলেও যেন ম্লান আমাদের পয়লা বৈশাখ। সেটা অনুভব করতে করতেই বেশ লজ্জিত হয়ে গত কয়েক বছর ধরে একটু বেশি উৎসাহ নিয়ে নববর্ষ পালন করতে শুরু করেছি।

উৎসব, আনন্দ, উদ্‌যাপন— এই সবে আমি ঘোর বিশ্বাসী। তাই নববর্ষে নতুন জামা পরা, কাছের মানুষদের উপহার দেওয়া, ইত‍্যাদি সবটাই করি আজকাল। এই বছরটা একটু অন‍্য রকম, উদ্‌যাপন অনেকটা ম্লান, সেই কথায় পরে আসছি।

ব‍্যক্তিগত ভাবে এই বছরে নতুন একটি অধ‍্যায়ের শুরু। একজন ‘ব্র্যান্ড নিউ’ সদস‍্য ভুমিষ্ঠ হবেন এবং যোগ দেবেন আমাদের সংসারে। আমার কাছে এখনও বিষয়টা খুব ‘সুররিয়্যাল’। এই রকম ঘটনা জীবনে এই প্রথম বার ঘটছে। তাই অনেকটা অজানা জড়িয়ে আছে এই অভিজ্ঞতার সঙ্গে। আমরা কথায় কথায় শুনি যে, মাতৃত্ব একটি চিরন্তন, শাশ্বত অনুভূতি এবং এর কোনও তুলনা হয় না। তবে বাস্তবে একটু গভীরে গেলে দেখা যায়, ‘প্রত্যেক মা নিজের মতো করে অনন্য’। নিশ্চয়ই কিছু সর্বজনীন প্রবৃত্তি থাকে। তবে মাতৃত্বের অনুভূতি, সংজ্ঞা, দৃষ্টান্ত আসলে অনেক রকমের হয়।

মাতৃত্ব অবশ‍্যই একটা ‘চয়েস’ হওয়া উচিত, এই মতে আমি চিরকাল বিশ্বাসী। আমি নিজের কথা বলতে পারি, জীবনের অনেকটা কাটিয়ে এসে তবেই এই সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছি। নিজেকে মানসিক ভাবে পরিণত মনে হয়েছে, প্রস্তুত মনে হয়েছে। যদি তা না মনে হত, তা হলে বিরত থাকতাম।

কিন্তু সমাজে চিরকালই দেখেছি, মাতৃত্ব ব‍্যাপারটাকে যে পরিমাণ গৌরবান্বিত করা হয়, মা না হওয়ার সিদ্ধান্তকে সেই ভাবেই হেয় করা হয়। এতটাই পুরষতান্ত্রিক পরিকাঠামো আমাদের আজও বেঁধে রেখেছে যে, মেয়েরা তাদের শরীর নিয়ে কী করবে, তাদের জীবন নিয়ে কোন পথে এগোবে— সবটাই সেই পুরুষতন্ত্রের নিয়ম মেনে চলতে হবে, এমনই ধারণা। মা হতে না চাওয়া মহিলা মানেই তিনি আত্নকেন্দ্রিক এবং স্বার্থপর— এমন একটি পূর্বানুমান আজও সমাজে প্রচলিত। আবার এক বার মা হলে, তাঁর ঠিক কেমন মা হওয়া উচিত, কোনটা সঠিক কোনটা বেঠিক, ভাল মা, মন্দ মা— এইসব কূটকচালিরও শেষ থাকে না।

আমি বলব, এইসব বস্তাপচা ধারণাগুলো ছুড়ে ফেলে দিয়ে, সবাইকে মুক্তির নিঃশ্বাস ফেলতে দিন। মা হওয়ার মতো, মা না হওয়ার সিদ্ধান্তকেও সম্মান করুন। শুধু সম্মান কেন, উদ্‌যাপন করুন।

মাতৃত্ব সব সময়েই জৈবিক হতে হবে, এমন নয়। শরীরে সন্তানধারণ না করেও মা হয়ে ওঠা সম্ভব। আমার মনে হয়, আসলে ‘মা’ ব‍্যাপারটা ব‍্যক্তিমানুষের ঊর্ধ্বে গিয়ে একটি অনুভূতি। অনেক মানুষকে দেখে বা চিনে এমনিই মনে হয় তাঁদের মধ‍্যে একটা মা-মা ব‍্যাপার আছে। অর্থাৎ মায়া আছে, আবার শাসনও আছে। আশ্রয় আছে, আবার প্রশ্রয়ও আছে।

শুধু মাতৃত্ব নয়। মহিলাদের যে কোনও ভাল লাগা, খারাপ লাগা নিয়েই সমাজের মতামত রয়েছে। এক দিন সকালে উঠে মহিলারা যদি মনে করেন, আমি আমার চেহারা, গায়ের রং, সব নিয়ে খুশি, সেই দিন কিন্তু বহু ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে। সমাজবিদ্‌ গেইল ডাইনেরও এমন একটি উক্তি রয়েছে। এর মধ্যেই এক দিন নিজের ত্বক দেখে ভাবছিলাম, রুক্ষ হয়ে গিয়েছে। তখন গেইলের এই উক্তি আবার মনে পড়ে গেল। সত্যিই তো সৌন্দর্যের মাপকাঠি, সংজ্ঞা— এগুলো সমাজমাধ্যমই যেন ঠিক করে দিচ্ছে। সমাজমাধ্যমের ‘ফিল্টার’ শিখিয়ে দিচ্ছে 'সুন্দর'-এর আসল সংজ্ঞা। কিন্তু এমন কেন হচ্ছে, এই প্রশ্ন বার বার মনে আসে।

আবার নববর্ষের প্রসঙ্গে ফেরা যাক। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে এই বছরটা শেষ হচ্ছে খুব বিশ্রী ভাবে। চাকরি হারিয়েছেন যে হাজার হাজার মানুষ, তাদের কথা একটু বেশি করেই মনে হচ্ছে। তাঁদের কাছে কি নতুন বছর আনন্দের হতে পারে? অনিশ্চয়তা, অসহায়তায় ডুবে রয়েছেন তাঁরা। মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত। সেখানে কি নতুনের উদ্‌যাপন কখনও সম্ভব? এই সব চিন্তা মনের মধ‍্যে বার বার ভিড় করছে।

অনেকটা রাগ, অনেকটা হতাশা নিয়েও তো আমাদের বেঁচে থাকতে হচ্ছে। দুর্নীতিগ্রস্ত একটি সিস্টেমে আমরা কোনও মতে দিন কাটাচ্ছি। শুধু আমাদের রাজ‍্য কেন, দেশে বা পৃথিবীতে যে দিকেই তাকাচ্ছি— দেখছি মিথ‍্যাচার, অবিচার। দেখছি স্বৈরাচারী, নারীবিদ্বেষী, সাম্প্রদায়িক ক্ষমতার জয়জয়কার। কী ভাবে তার মোকাবিলা করব? এই প্রশ্ন নিজের কাছে থেকেই যায়। আগামী প্রজন্মকে আনছি যে পৃথিবীতে বা যে সমাজে, তাকে কী ভাবে আরেকটু সুন্দর, আরেকটু সুস্থ করে তুলব?

এসএন 

Share this news on:

সর্বশেষ