আজ বিশ্ব হিমোফিলিয়া দিবস

আজ বৃহস্পতিবার ১৭ এপ্রিল ২০২৫ বিশ্ব হিমোফিলিয়া দিবস। হিমোফিলিয়া একটি রক্তক্ষরণজনিত জন্মগত রোগ, যা বংশানুক্রমে ছেলেদের হয়ে থাকে। স্বাভাবিকভাবে শরীরের কোনো জায়গায় আঘাত পেলে বা সামান্য কেটে গেলে ওই স্থান থেকে রক্তক্ষরণ হতে থাকে, যা স্বতঃস্ফূর্তভাবে বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু হিমোফিলিয়া রোগীর ক্ষেত্রে সহজে রক্তক্ষরণ বন্ধ হয় না অথবা বিলম্বিত হয়।

১৯৮৯ সাল থেকে প্রতিবছর বিশ্বজুড়ে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। সারা বিশ্বে এই দিবসটি পালনের উদ্দেশ্য হলো রক্ত সংক্রান্ত রোগ হিমোফিলিয়া সম্পর্কে সবাইকে সচেতন করা।

এছাড়াও ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন অফ হিমোফিলিয়ার প্রতিষ্ঠাতা ফ্রাঙ্ক শ্নাবেলকে স্মরণ করার জন্য তাঁর জন্মদিন উপলক্ষে এই দিনটি পালিত হয়। তাই হিমোফিলিয়া কী-কেন এই বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে হবে।

হিমোফিলিয়া শব্দটি এসেছে দুটি গ্রিক শব্দ হাইমা এবং ফিলিয়া হতে। হাইমা অর্থ রক্ত এবং ফিলিয়া অর্থ আকর্ষণ। দেহের কোনো অংশে রক্তপাত শুরু হলে সাধারণত সেখানে রক্ত জমাট বাঁধতে থাকে। মেডিকেলের ভাষায় এই প্রক্রিয়াকে ক্লটিং বলে।

ক্লটিং প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রক্ত জমাট বেঁধে ধীরে ধীরে রক্তক্ষরণ বন্ধ হয়ে যায়। আমাদের দেহে কোথাও কোনো ক্ষত তৈরি হলে সেই ক্ষতস্থান সময়ের সাথে সাথে শুকিয়ে যাওয়াকেই ক্লটিং বলে। যে পদার্থ রক্তক্ষরণে বাঁধা দেয় তাকে ক্লট বলে। কিন্তু কোনো কারণে ক্ষতস্থানে এই ক্লট তৈরি না হলে সেখান থেকে একাধারে রক্তক্ষরণ হতে থাকে।

একজন হিমোফিলিয়া আক্রান্ত রোগীর দেহে এই ক্লট সৃষ্টির প্রক্রিয়াটি স্বাভাবিক নয়।

ব্যাপারটি আসলে এমন নয় যে, রোগীর দেহ থেকে অঝোরে এবং খুব দ্রুত রক্তক্ষরণ হতে থাকবে। মূলত একজন হিমোফিলিয়াক (যারা হিমোফিলিয়ায় আক্রান্ত) ব্যক্তির দেহ থেকে দীর্ঘ সময় ধরে রক্তক্ষরণ হতে থাকে।

আরেকটি বিষয় পরিষ্কার করা দরকার। অনেকে হয়তো এখন মনে করছেন যে, এই রোগ হলে হাত, পা, হাঁটু ইত্যাদির কোথাও কেটে গেলেই তা থেকে অনবরত রক্ত ঝরতে থাকবে। ব্যাপারটি ঠিক তা নয়। দেহের বাইরের কোনো ছোটখাটো আঘাত এখানে খুব একটা চিন্তার বিষয় নয়। আসল চিন্তার বিষয় হলো ইন্টারনাল ব্লিডিং বা দেহের অভ্যন্তরীণ কোনো অংশে রক্তক্ষরণ। এই ধরণের রক্তক্ষরণকে হ্যামোরেজ বলে। এটি মূলত দেখা যায় দেহের ভিতরে কোনো সন্ধি যেমন হাঁটু ও গোড়ালিতে। এছাড়া দেহের অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন টিস্যু ও পেশীর মিলনস্থলেও রক্তক্ষরণ হতে পারে। দেহের ভিতরে এমন রক্তক্ষরণ অনেক যন্ত্রণাদায়ক হয় এবং আক্রান্ত অংশ বেশ ফুলতে শুরু করে।

মানবদেহে একটি X ও অন্যটি Y ক্রোমোজম থাকলে সে হয় ছেলে (46,XY) আর যদি দুটিই X ক্রোমোজম থাকে তাহলে সে হয় মেয়ে (46,XX)। X ক্রোমোজমে F8 ও F9 নামক জিন থাকে, যা F-VIII ও F-IX নামক ক্লোটিং প্রোটিন তৈরি করে। এই ক্লোটিং প্রোটিন রক্তের সাদা অংশে পরিমাণমতো থাকে। ফলে আপনাআপনি রক্তক্ষরণ বন্ধ হয়। যাদের রক্তে এই ক্লোটিং প্রোটিন কম থাকে, তাদের রক্ত পড়া বন্ধ হয় না অথবা বিলম্বিত হয়। তারাই হিমোফিলিয়ার রোগী।

ছেলেদের দেহে যেহেতু একটামাত্র X ক্রোমোজম থাকে এবং এই একমাত্র X ক্রোমোজম যদি অসুস্থ/defect থাকে, তাহলে F-VIII/F-IX তৈরি হয় না। ফলে ছেলেরাই হিমোফিলিয়ার রোগী হয়। আর মেয়েদের দেহে যেহেতু দুটি X ক্রোমোজম থাকে, তাই একটি X অসুস্থ/defect হলেও অন্য X সুস্থ থাকায় পর্যাপ্ত F-VIII/F-IX তৈরি হয়। তাই সাধারণত মেয়েরা হিমোফিলিয়ার রোগী হয় না, রোগের বাহক হয়।

তবে ১. Lyonisation/inactivation of healthy X chromosome হলে, ২. বাবা রোগী ও মা বাহক হলে অথবা ৩. Turner syndrome (45,XO) হলে মেয়েরাও রোগী হতে পারে। তাই হিমোফিলিয়ার রোগীর সঙ্গে মামাতো, খালাতো প্রভৃতি বোনের বিয়ে হলে ছেলে ও মেয়ে উভয়েরই রোগী হওয়ার ঝুঁকি থাকে। তবে পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, প্রতি তিনজন হিমোফিলিয়ার রোগীর মধ্যে অন্তত একজন বংশানুক্রমে সঞ্চারিত না হয়ে নতুনভাবে আক্রান্ত হয়।

হিমোফিলিয়া এ এবং বি দুই ধরনের। হিমোফিলিয়া-এ-তে, ফ্যাকফোর-৮ মাত্রা কম বা অনুপস্থিত। হিমোফিলিয়া-বি ফ্যাকফোর-৯ এর ঘাটতি রয়েছে। বেশিরভাগ মানুষেরই হিমোফিলিয়া-এ আছে। এটি শরীরের ক্রোমোজোম সিস্টেমের অবনতির কারণেও হয়। আর চিকিৎসকদের ধারণা, বাংলাদেশে প্রায় ১০ হাজার মানুষ এ রোগে আক্রান্ত। আর বিশ্বব্যাপী প্রায় চার লাখ মানুষ হিমোফিলিয়া রোগে আক্রান্ত।

যদি কোনো সাধারণ আঘাত বা ক্ষত থেকে ক্রমাগত রক্তক্ষরণ বন্ধ না হয় তাহলে বুঝবেন এটি হিমোফিলিয়ার কারণে হয়েছে। এই রোগের ক্ষেত্রে রক্তে প্লেটলেট কাউন্ট, প্রোথ্রোমবিন, প্লেটলেটের অসুস্থতা ইত্যাদি কমে যেতে পারে। এছাড়াও ক্ষতস্থানে বিলম্বিত রক্তপাত হয়। আর অস্বাভাবিক রক্তক্ষরণ বা কেটে গেলে রক্তক্ষরণ বন্ধ না হওয়াটাই হিমোফিলিয়ার মূল লক্ষণ।

শিশু বয়সেই এই রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায়। কোনো কারণ ছাড়াই হঠাৎ করে রক্তক্ষরণ, শরীরের আঘাত লাগলে সেই জায়গাটি নীলচে হয়ে ফুলে যায় অর্থাৎ চামড়ার নিচে রক্তক্ষরণ; মাংসপেশিতে এবং অস্থিসন্ধিতে রক্তক্ষরণ; হাঁটু, কনুই ও অন্যান্য অস্থি সন্ধি ফুলে যাওয়া; শরীরের কোথাও কেটে গেলে দীর্ঘক্ষণ রক্ত ঝরা; দাঁত তোলার পর বা সুন্নতে খাতনা করার পর রক্তক্ষরণ বন্ধ না হওয়া, শিশু হামাগুড়ি দেওয়ার সময় হাঁটুতে কালচে দাগ হওয়া, নবজাতকের নাভি কাটার সময় দীর্ঘক্ষণ রক্তক্ষরণ হওয়া ইত্যাদি।

বাবা সুস্থ ও মা বাহক হয় তবে ছেলে সন্তানের রোগী হওয়ার সম্ভাবনা ৫০% আর মেয়ে সন্তানের বাহক হওয়ার সম্ভাবনা ৫০%। বাবা রোগী এবং মা সুস্থ হয় তবে সব ছেলে সন্তানই সুস্থ হবে এবং সব মেয়ে সন্তানই বাহক হবে। বাবা রোগী এবং মা বাহক হয় তবে ছেলে সন্তানের রোগী হওয়ার সম্ভাবনা ৫০%। আর মেয়ে সন্তানের রোগী হওয়ার সম্ভাবনা ২৫% ও বাহক হওয়ার সম্ভাবনা ২৫%। সুতরাং প্রত্যেক হিমোফিলিয়া পুরুষ রোগী বিয়ে করতে পারবে, তবে সন্তান নেওয়ার ক্ষেত্রে রক্তরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

সাধারণত শুধু পুরুষরাই এই রোগে আক্রান্ত হয় এবং নারীরা এই রোগের বাহক। বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে নারীরাও এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে। বাবা রোগী ও মা বাহক হলে মেয়েরাও রোগী হতে পারে। হিমোফিলিয়া রোগীর সঙ্গে আত্মীয় যেমন খালাতো, মামাতো বা ফুপাতো বোনের বিয়ে হলে দুজনেই রোগী হওয়ার ঝুঁকি থাকে।

মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ-গুরুতর হিমোফিলিয়ায় আক্রান্ত কিছু লোকের মাথায় সামান্য আঘাতের পরে মস্তিষ্কে রক্তপাত হতে পারে। যদিও এটি প্রায়শই ঘটে না, এটি সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সমস্যাগুলির মধ্যে একটি যা উঠতে পারে।

কিছু সতর্কতা চিহ্ন এবং উপসর্গ হলো
* চলমান মাথা ব্যাথা
* বারবার বমি হওয়া
* অলসতা বা তন্দ্রা
* দ্বৈত উপলব্ধি
* হঠাৎ দুর্বলতা
* হৃদরোগের আক্রমণ বা কম্পন

রক্তের ফ্যাক্টর দুটির পরীক্ষা। রক্তের জমাট বাঁধার ক্ষমতা পরীক্ষা। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যদের genetic testing, genetic counseling I prenatal test (amniocentesis) করে অনাগত সন্তান রোগী না বাহক তা নিশ্চিত হয়ে হিমোফিলিয়ার আক্রান্তের সংখ্যা কমানো যায়। দেশেই এসব পরীক্ষা করা হচ্ছে।

হিমোফিলিয়া রোগীকে পুরোপুরি সুস্থ করানোর কোনো চিকিৎসা এখনো আবিষ্কার হয়নি। তবে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা পদ্ধতির মাধ্যমে সম্ভব। সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে যেমন নিয়মমাফিক, সঠিক ব্যায়াম করে মোটামুটিভাবে স্বাভাবিক জীবনযাপন করা গেলেও চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল, যা অনেকের পক্ষেই সম্ভব হয় না। তাই সচেতনতার মাধ্যমে প্রতিরোধ করাই উত্তম।

এসএম/টিএ

Share this news on:

সর্বশেষ

img
তফসিল ঘোষণা গণতন্ত্রের নতুন অধ্যায়: মির্জা ফখরুল Dec 11, 2025
কমলা গাউনে ঝড় তুললেন ফারিন খান Dec 11, 2025
আশনা হাবিব ভাবনার অন্তর্দৃষ্টিপূর্ণ এবং সাহসী বক্তব্য Dec 11, 2025
বার্নাব্যুতে রিয়ালকে হারাল ম্যানসিটি Dec 11, 2025
বিশ্বকাপে মিসর–ইরান ম্যাচ আলোচনায় Dec 11, 2025
img
আমাদের একটাই উদ্দেশ্য- সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন: সিইসি Dec 11, 2025
যে কারণে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাদিক কায়েম Dec 11, 2025
সেনা সংকট চরমে: ইউক্রেনীয় বাহিনীতে পলাতক-অনুপস্থিত ৩ লাখ Dec 11, 2025
২০২৫ সাল হবে বিশ্ব ইতিহাসের দ্বিতীয় বা তৃতীয় উষ্ণতম বছর Dec 11, 2025
img
মেট্রোরেলের ভ্যাট প্রত্যাহার Dec 11, 2025
img
‘রাজাকারের বাচ্চা’ বলা শিক্ষককে ঢাবি শিক্ষার্থীদের ধাওয়া Dec 11, 2025
img
তফসিলে সন্তুষ্ট বিএনপি, এতে ভোটের অধিকার বাস্তবায়ন হবে: মির্জা ফখরুল Dec 11, 2025
img
নির্বাচনে প্রতি উপজেলায় কাজ করবেন ২ জন ম্যাজিস্ট্রেট Dec 11, 2025
img
সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেলেন অভিনেত্রী ওয়েন অ্যালটন Dec 11, 2025
img

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন

মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ সময় ২৯ ডিসেম্বর Dec 11, 2025
img
সবার সহযোগিতায় সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় পেয়েছি : প্রধান বিচারপতি Dec 11, 2025
img
জাতীয় স্মৃতিসৌধে ২ দিন সর্বসাধারণের প্রবেশ বন্ধ Dec 11, 2025
img
১২ ফেব্রুয়ারি জাতীয় নির্বাচন Dec 11, 2025
img
গৌরব খান্নার সঙ্গে প্রেম গুঞ্জনের জবাবে মুখ খুললেন অনুপমা’র নিধি Dec 11, 2025
img
ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করছেন সিইসি Dec 11, 2025