অর্থের বিনিময়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নে নাগরিকত্বের সুযোগ শেষ

গোল্ডেন পাসপোর্ট বা অর্থের বিনিময়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের কোনো দেশে নাগরিক হওয়ার শেষ সুযোগটি সম্প্রতি বন্ধ করে দিয়েছেন ইউরোপের সর্বোচ্চ আদালত। কিন্তু এভাবে অর্থ উপার্জনের বিকল্প কিছু সুযোগ দেশগুলোর সামনে এখনেও রয়ে গেছে।
 
২৯ এপ্রিল ইউরোপীয় বিচার আদালকের (ইসিজে) ঘোষিত রায় শুরুতে বিশ্বাসই হয়নি ম্যানুয়েল ডেলিয়ার। এমন রায় পাওয়ার জন্য আরো বছরের পর বছর লড়তে রাজি ছিলেন তিনি। ডেলিয়া বলেন, “আমি চিৎকার করে উঠলাম। খারাপ খবরের অপেক্ষাতেই ছিলাম।”

মাল্টার নাগরিক সংগঠন রিপাবলিকার নির্বাহী কর্মকর্তা ডেলিয়া বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য সে দেশের নাগরিকত্ব কর্মসূচির বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে প্রচার চালিয়ে আসছিলেন। ‘গোল্ডেন পাসপোর্ট' নামে পরিচিত অর্থের বিনিময়ে নাগরিকত্বের সুযোগ দেওয়া ইউরোপীয় ইউনিয়নের সবশেষ দেশ ছিল মাল্টা। তার আগে বুলগেরিয়া ও সাইপ্রাস তাদের এমন স্কিম বা কর্মসূচি বন্ধ ঘোষণা করেছিল।
 
ডেলিয়া বলেন,তার বন্ধু ও সহকর্মী মাল্টার দুর্নীতি বিরোধী সাংবাদিক ডাফনে কারুয়ানা গালিজিয়ার হত্যার ঘটনা এই ধরনের কর্মসূচির বিপদের বিষয়টি প্রথম তুলে ধরে।

গোল্ডেন পাসপোর্ট: অর্থই যেখানে মূল বিবেচ্য
 
২০২২ সালে ইউরোপীয় কমিশন মাল্টার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়। বলা হয় মাল্টা দেশটির আবাসন খাতে বিনিয়োগের বিনিময়ে নাগরিকত্ব দিচ্ছে, যা ইইউ এর নাগরিকত্ব নিয়মের বরখেলাপ। কেননা, নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্য শুধু আর্থিক প্রতিশ্রুতি নয়, ব্যক্তির সঙ্গে ঐ দেশের ‘প্রকৃত সংযোগও' থাকতে হবে।

ডেলিয়া আদালতের ভিন্ন রায়ের আশঙ্কা করছিলেন, কারণ, গত অক্টোবরে প্রকাশিত একটি মতামতে ইসিজের অ্যাডভোকেট জেনারেল মাল্টার সরকারের অবস্থানকে সমর্থন জানিয়েছিলেন। ইসিজে আগে বিভিন্ন সময়ে অ্যাডভোকেট জেনারেলের মতামত অনুসরণ করলেও এবার তেমনটি হয়নি।

আদালত মাল্টার নাগরিকত্ব নীতিকে শুধু বাণিজ্যিক লেনদেন আকারেই দেখেছে। রায়ে বলা হয়েছে, “এই ধরনের চর্চার কারণে সদস্য দেশগুলো ও তার নাগরকিদের মধ্যে প্রয়োজনীয় বন্ধন ও আস্থা তৈরি কিংবা সদস্য দেশগুলোর পরাষ্পরিক বিশ্বাস স্থাপন সম্ভব হয় না।”
মাল্টার পাসপোর্টের ক্রেতা কারা?

ডেলিয়া বলেন, “আদালতের রায়ে প্রমাণ হয়েছে, যা এতদিন ধরে আমরা বলার চেষ্টা করেছি৷ এই কর্মসূচিটি অর্থ উপার্জনের মাধ্যম, যা ন্যয়সঙ্গত নয়।”তিনি বলেন, “আপনি নাগরিকত্বের দাম ধরতে পারেন না৷ এটি অর্থের চেয়েও মূল্যবান।”

গোল্ডেন পাসপোর্ট পাওয়ার ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ শর্তগুলো কতটা যাচাই করে তা নিয়ে শুরু থেকে প্রশ্ন তুলেছেন ডেলিয়া ও অন্য পর্যবেক্ষকেরা। কেননা, অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে শর্ত অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময় মাল্টায় অবস্থান না করেই অনেকে নাগরিত্ব পেয়েছেন।

ডাফনে কারুয়ানা গালিজিয়া ফাউন্ডেশনের তথ্যে দেখা যায়, প্রতি ১০টি গোল্ডেন ভিসার মধ্যে ৯টি ভিসাই পেয়েছেন চীনা বিনিয়োগকারীরা। কিন্তু জনমিতি জরিপ অনুযায়ী, এই সংখ্যা দেশটিতে বসবাসকারী চীনা নাগরিকের চেয়ে বেশি। সংগঠনটি মনে করছে গোল্ডেন ভিসা পাওয়া অর্ধেক সংখ্যকই বস্তুত মাল্টায় বসবাস করেন না।

এক দুয়ার বন্ধ হলেও খোলা অন্যগুলো
আদালতের রায়ের পর মাল্টার প্রধানমন্ত্রী রবার্ট আবেলা কর্মসূচিটির পক্ষে অবস্থান জানিয়ে এক বিবৃতি দিয়েছেন৷ জানিয়েছেন, মাল্টা গোল্ডেন পাসপোর্টের মাধ্যমে ১৬০ কোটি ডলার আয় করেছে৷ রায়ের সাথে সঙ্গতি রেখে এই ব্যবস্থা চালু রাখার ইঙ্গিতও দেন তিনি।

রবার্ট আবেলা বলেন, “মাল্টা সরকার সবসময়ের মতোই আদালতের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানায়। এই মুহূর্তে রায়ে আইনি প্রভাব বিস্তারিতভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা হবে, যাতে নাগরিকত্ব নিয়ন্ত্রণের কাঠামোটি রায়ের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হয়।”

অর্থের বিনিময়ে পাসপোর্টের সুযোগ বন্ধ হলেও পাসপোর্টমুক্ত শেঙ্গেন অঞ্চলে প্রবেশের আরো পথ খোলা রয়ে গেছে। পাসপোর্ট কর্মসূচীতে থাকা অনেক সুবিধাই মেলে ‘গোল্ডেন ভিসাতে'৷ আবাসনে বা অন্য খাতে বিনিয়োগের মাধ্যমে দেশগুলোতে বসবাসের জন্য এই ধরনের ভিসা সুবিধা রয়েছে।

মাল্টার পাসপোর্ট কর্মসূচিতে সহায়তা করে হেনলি অ্যান্ড পার্টনার্স। ৩১টি দেশে বিনিয়োগের মাধ্যমে বসবাসের অনুমতি পাওয়ার সেবা দেয় তারা। এর অর্ধেকই ইউরোপীয় ইউনিয়নের।

বৈশ্বিক দুর্নীতি বিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালে নীতি বিষয়ক কর্মকর্তা আনা টেরন বলেন, ‘‘এর মাধ্যমে আপনি এখনও ইউরোপীয় ইউনিয়নের অনেক স্বাধীনতা প্রাপ্তির সুযোগ পাবেন।”

রায়ের প্রেক্ষিতে ইউরোপীয় কমিশনের মুখপাত্র মার্কুস লেমার্ট গোল্ডেন ভিসা কর্মসূচিগুলো নিয়ে ‘গুরুতর উদ্বেগ' প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, “এই ধরনের কর্মসূচিগুলো ইউনিয়নের জন্য নিরাপত্তা, অর্থ পাচার, কর ফাঁকি ও দুর্নীতির সামগ্রিক ঝুঁকি তৈরি করছে৷ সদস্য দেশগুলোর এমন কর্মসূচির ক্ষেত্রে যাতে ঝুঁকি মোকাবিলা ও ব্যবস্থা নেয়ার যথাযথ পদক্ষেপ থাকে তা ইইউ অর্থ পাচার আইনের মাধ্যমে নিশ্চিত করতে হবে।”

২০২২ সালে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের একটি রেজ্যুলেশনে বিনিয়োগের বিনিময়ে বসবাসের সুবিধা স্কিমের ক্ষেত্রে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়ার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এক্ষেত্রে ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়টি সদস্য রাষ্ট্রগুলোর উপরই ছেড়ে দেয়া হয়েছে।

পরিবর্তনের সূচনা
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের টেরন আশা করছেন গোল্ডেন পাসপোর্ট বন্ধের বিষয়ে সিদ্ধান্তকে সামনে এগিয়ে নেয়া হবে। আদালত যেই যুক্তিতে এটি বন্ধ করেছে, তা গোল্ডেন ভিসাতেও প্রযোজ্য হতে পারে বলে মনে করেন তিনি।

ইইউ দেশগুলোর মধ্যকার সংহতি ও নিরাপত্তার জন্য ‘দুর্নীতিবাজ এবং অস্বচ্ছ উপায়ে সম্পদশালী হওয়াদের' দূরে রাখা প্রয়োজন বলে মত দেন তিনি।

অন্যদিকে মাল্টার ডেলিয়া মনে করেন নাগরিকত্বের বিষয়টি হওয়া উচিত ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের মধ্যকার একটি চুক্তির মাধ্যমে, যার মূলে থাকবে আইনের ভিত্তিতে একসঙ্গে বসবাস করার প্রতিশ্রুতি ও সংহতি। “আপনি যখনই এর মূল্য ধরছেন, তখনই এটিকে সস্তা বানিয়ে ফেলছেন”, বলেন তিনি।

এমআর/টিএ


Share this news on:

সর্বশেষ

img
এবার হিরো আলমের বিরুদ্ধে ধর্ষণ মামলা May 06, 2025
img
বানারীপাড়ায় তিন ডাকাত গ্রেফতার May 06, 2025
img
ফেনীতে আ. লীগ ও যুবলীগের দুই নেতা গ্রেফতার May 06, 2025
img
স্থায়ীভাবে পুরো গাজা দখলের দিকে এগোচ্ছে ইসরায়েল May 06, 2025
img
বাস দুর্ঘটনায় একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার্থী আহত, নিহত এক May 06, 2025
img
রাজনৈতিক পালাবদল: ৮ মাসে বন্ধ ১১৩ কারখানা, বেকার ৯৬ হাজার শ্রমিক May 06, 2025
img
হামলার আশঙ্কায় শেহবাজ শরিফের মালয়েশিয়া সফর স্থগিত May 06, 2025
img
আ. লীগ আমলে দেয়া গণমাধ্যমের লাইসেন্স তদন্ত করা হবে: তথ্য উপদেষ্টা May 06, 2025
তিশা বা শুভকে দোষ দিবেন না! নেপথ্য কাহিনি শোনালেন অরণ্য May 06, 2025
img
শেখ মুজিব তার পরিবারের হাতে ক্ষমতা তুলে দিয়েছে: মাহফুজ আলম May 06, 2025