মূল্যস্ফীতি কমাতে কঠোর মুদ্রানীতি চলবে, ঋণে চাপ অব্যাহত

সার্বিকভাবে দেশের অর্থনীতিতে এখনো মূল্যস্ফীতিকে প্রধান উদ্বেগের বিষয় হিসাবে দেখছে বাংলাদেশ ব্যাংক। মূল্যস্ফীতির হার স্বস্তির পর্যায়ে না আসা পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজারে টাকার প্রবাহ কমানো ও ঋণের চড়া সুদহারের নীতি অব্যাহত রাখবে।

কঠোর মুদ্রানীতি এবং শক্তিশালী কৃষি ও শিল্প উৎপাদন মূল্যস্ফীতির চাপ কমাতে সহায়ক হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছে ব্যাংক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি।

এদিকে লুটপাটের প্রভাবে ব্যাংক খাতে অ-কার্যকর বা খেলাপি ঋণ বিরামহীনভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমানত কমে গেছে। ব্যাংকগুলোর ঋণ বৃদ্ধির ধীরগতি এবং তহবিল সংকটের কারণে ঋণ বিতরণের সক্ষমতা কমে গেছে। সেভাবে ঋণ আদায় না হওয়ায় আয় কমে গেছে। সব মিলে ব্যাংকগুলোর প্রভিশন ঘাটতি ও মূলধন পর্যাপ্ততার ঘাটতি বাড়ছে।

এ বিষয়গুলো ব্যাংক খাতকে ক্রমবর্ধমান চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি ঠেলে দিচ্ছে। দেশের সার্বিক অর্থনীতির হালনাগাদ তথ্য-উপাত্ত নিয়ে সোমবার প্রকাশিত বাংলাদেশ ব্যাংকের ত্রৈমাসিক প্রতিবেদন থেকে অর্থনীতি ও ব্যাংক খাতের এমন চিত্র পাওয়া গেছে।

প্রতিবেদনে এমন নেতিবাচক পরিস্থিতির মধ্যেও বেশ কিছু আশার বাণী শুনানো হয়েছে। ব্যাংক খাতে আমানত প্রবাহ বাড়তে শুরু করেছে। লুটপাটের কারণে দুর্বল হয়ে পড়া কয়েকটি ব্যাংক ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করায় ব্যাংকের প্রতি গ্রাহকদের আস্থা ফিরতে শুরু করেছে। কৃষি ও শিল্প খাতের ইতিবাচক প্রভাবের মাধ্যমে অর্থনীতি ধীরে ধীরে আগের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা থেকে পনুরুদ্ধার পাবে বলে আশা করা হচ্ছে।

সরকারের প্রাতিষ্ঠানিক ও অর্থনৈতিক খাতে ব্যাপক সংস্কার বাস্তবায়নের ফলে সামষ্টিক অর্থনীতিতে টেকসই স্থিতিশীলতা অর্জন করবে এবং আর্থিক খাতে শাসনব্যবস্থা জোরদার করবে।

এছাড়া শক্তিশালী রপ্তানি প্রবৃদ্ধি এবং উল্লেখযোগ্য রেমিট্যান্স প্রবাহ অব্যাহত থাকবে বলে আশা প্রকাশ করা হয়। যা অর্থপ্রবাহের ভারসাম্যের আরও উন্নতিতে অবদান রাখবে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, লুটপাটের কারণে ঋণের টাকা আদায় না হওয়ায় গত ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণ তীব্রভাবে বেড়ে ২০ দশমিক ২ শতাংশে অর্থাৎ সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। যা আগের গত সেপ্টেম্বরে ছিল ১৭ শতাংশ। এক বছর আগে এ হার ছিল ৯ শতাংশ। ব্যাংক খাতের কিছু নির্দিষ্ট সূচকের উন্নতি সত্তে¡ও ব্যাংকিং খাত গত সেপ্টেম্বরের পর থেকে ক্রমবর্ধমান চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে থাকে।

এই সময়ে খেলাপি ঋণ ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ব্যাংক ঋণের প্রবৃদ্ধিতেও মন্দা দেখা গেছে। ইতিবাচক দিক হলো, ব্যাংকিং খাতের ওপর জনসাধারণের আস্থা ফিরে আসতে শুরু করেছে। কারণ ব্যাংকের বাইরে থাকা অর্থ ব্যাংক আমানত হিসাবে আবার ফিরতে শুরু করেছে। ফলে ব্যাংকের তারল্য বেড়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, গবেষণায় দেখা গেছে, খেলাপি ঋণের পরিস্থিতি অবনতির মূল কারণ ছিল বিদ্যমান ঋণের পুনর্গঠন না করা ও ঋণের কিস্তি পরিশোধ না করা। এছাড়া মেয়াদি ঋণ খেলাপি করার মেয়াদ ছয় মাস থেকে কমিয়ে তিন মাস করার কারণে খেলাপি ঋণ বেশি মাত্রায় বেড়েছে। গত বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর থেকে এই বিধান কার্যকর হয়েছে।

খেলাপি ঋণ বাড়ায় ব্যাংকগুলোর ব্যালেন্স শিটের ওপর যথেষ্ট চাপ সৃষ্টি হয়েছে। নতুন ঋণ দেওয়ার ক্ষমতা সীমিত করেছে এবং পদ্ধতিগত দুর্বলতাগুলোকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক প্রশাসনকে শক্তিশালী করার, আর্থিক শৃঙ্খলা উন্নত এবং ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা বৃদ্ধির লক্ষ্যে একাধিক কাঠামোগত ও নীতিগত সংস্কার চালু করেছে। আগামীতে এর সুফল পাওয়া যাবে বলে প্রতিবেদনে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়।

এতে বলা হয়, দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরে আসায় বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কৃষি, শিল্প ও পরিষেবা খাতে প্রবৃদ্ধি স্থিতিশীলতার দিকে যাচ্ছে। চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে প্রকৃত জিডিপি ৪ দশমিক ৪৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে, যা প্রথম প্রান্তিকে ছিল ১ দশমিক ৯৬ শতাংশ। অর্থাৎ সর্বনিম্ন পর্যায়ে।

কৃষি ও শিল্প খাত থেকে প্রত্যাশিত ইতিবাচক প্রভাব আগামী প্রান্তিকে অর্থনৈতিক কর্মক্ষমতা আরও জোরদার করার সম্ভাবনা রয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

খাদ্যের দাম বৃদ্ধির কারণে মূলত খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। এ কারণে সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার বেড়েছে। খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার এখনো উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে আশার কথা খাদ্য মূল্যস্ফীতির হারও এখন কমতে শুরু করেছে। এ হার কমাতে কঠোর মুদ্রানীতি অনুসরণ করা হচ্ছে।

মূল্যস্ফীতির হার সহনীয় পর্যায়ে নেমে না আসা পর্যন্ত কঠোর মুদ্রানীতি বহাল রাখা হবে। অর্থাৎ বাজারে টাকার প্রবাহ কমানো ও ঋণের সুদের হার বাড়ানোর নীতি অব্যাহত রাখা হবে।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, টাকার প্রবাহ কমানোর ফলে ব্যাংকগুলোতে তারল্য সংকট রয়েছে। ফলে ব্যাংকগুলোর ঋণ বিতরণের সক্ষমতা কমছে। এতে বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা চাহিদা অনুযায়ী ঋণ পাচ্ছে না। যে কারণে বেসরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি এখনো ২ শতাংশের ঘরেই রয়ে গেছে।

এদিকে ঋণের সুদের হার বাড়ানোর কারণে ঋণ নেওয়ার খরচ বেড়ে গেছে। ফলে ব্যবসা খরচ বেড়েছে। এতে উদ্যোক্তারা ঋণ নিচ্ছেন কম। ফলে বেসরকারি খাতের বিকাশ কম হচ্ছে। কর্মসংস্থানের গতি সংকুচিত হয়ে পড়েছে। ব্যবসা খরচ বাড়ার কারণে পণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে। যা পরোক্ষভাবে মূল্যস্ফীতির ওপর চাপ সৃষ্টি করছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রবাসীদের রেমিট্যান্স প্রবাহের ক্রমাগত বৃদ্ধি এবং আশাব্যঞ্জক রপ্তানি আয় বৈদেশিক খাতের স্থিতিশীলতা বৃদ্ধিতে অবদান রেখেছে। চলতি হিসাবের ভারসাম্য এবং আর্থিক হিসাবের ভারসাম্য উভয় ক্ষেত্রেই উলে­খযোগ্য উন্নতি দেখা গেছে।

চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে সামগ্রিক রাজস্ব ভারসাম্য ৩৩ হাজার ৯০০ কোটি টাকার ঘাটতি হয়েছে। যা একটি রেকর্ড। সরকারের সামগ্রিক ব্যয় রাজস্ব সংগ্রহের চেয়ে বেশি বলে ঋণ গ্রহণ করে ঘাটতি মেটাতে হয়েছে। সরকার রাজস্ব সংগ্রহ বৃদ্ধিতে নানামুখী প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

এফপি/এস এন 


Share this news on:

সর্বশেষ

img
হাবিবুর রহমানসহ ৫ জনের বিরুদ্ধে তৃতীয় দিনের সাক্ষ্যগ্রহণ আজ Nov 03, 2025
img
৫২তে পা রাখলেন অভিনেত্রী মৌসুমী মৌসুমী,ফেরা হয়নি দেশে Nov 03, 2025
img
জেনে নিন আজ দেশে কত দামে বিক্রি হচ্ছে স্বর্ণ Nov 03, 2025
img
আজ দুপুর ১২টায় সংবাদ সম্মেলন ডাকলেন প্রধান উপদেষ্টা Nov 03, 2025
img
রাজধানীতে পুলিশের বিশেষ অভিযানে গ্রেপ্তার ১৪ Nov 03, 2025
img
গোপনে মাস্ককে ২০০ কোটি ডলারের প্রতিরক্ষা প্রকল্প দিলেন ট্রাম্প Nov 03, 2025
img
আফগানিস্তানে ফের ভূমিকম্প Nov 03, 2025
হাসিনাকে আশ্রয় দিয়ে জুলাই গণ/হত্যাকে সমর্থন করছে ভারত: এনসিপি Nov 03, 2025
অবশেষে শাপলা কলিতেই রাজি এনসিপি Nov 03, 2025
বিএনপিকে নিয়ে যে মন্তব্য করলেন মাসুদ কামাল Nov 03, 2025
ড. মোহাম্মদ ইউনুস কে আদেশ জারি করতে হবে: হাসনাত। Nov 03, 2025
কেন সালমান শাহর মৃত্যুর তিন দিন পর আসেন ডন ? Nov 03, 2025
মায়ের আশীর্বাদ ছাড়া এই জায়গায় আসতে পারতাম না: কাজল Nov 03, 2025
এবার ১৯ বছরের ছোট, হীরা ব্যবসায়ীর প্রেমে মজলেন মালাইকা Nov 03, 2025
img
প্রবাসীদের ভোটাধিকার দেওয়ায় ইসিকে তারেক রহমানের ধন্যবাদ Nov 03, 2025
img
ট্রাম্পের সামরিক পদক্ষেপের জবাব দিলো নাইজেরিয়া Nov 03, 2025
img
যখন সাংবাদিকদের চুপ করানো হয়, তখন সবার কণ্ঠ থেমে যায় : জাতিসংঘ মহাসচিব Nov 03, 2025
img
শীতের আগমন নিয়ে আবহাওয়া অফিসের পূর্বাভাস Nov 03, 2025
img
আজ শোকাবহ জেলহত্যা দিবস Nov 03, 2025
img
১০০ টাকা ঘুষ নেওয়ার অভিযোগে ৩৯ বছর আদালতে হাজিরা! Nov 03, 2025