প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি হাকালুকি হাওর

বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ হাওর হচ্ছে হাকালুকি হাওর। বর্ষা এবং শীত উভয় ঋতুই ঘুরে বেড়ানোর জন্য উপযোগী। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে অপূর্ব লীলাভূমি হাওরটি বছরের বিভিন্ন সময় ভিন্ন ভিন্ন রূপ ধারণ করে। বর্ষাকালে এই হাওড়টি একটি অথৈ সাগরে পরিণত হয়। সমুদ্রের মতো বিশাল ঢেউ, চারদিকে পানি আর পানি। আবার শীতকালে সবুজের মাঝে অতিথি পাখিদের মিলনমেলা।

‘হাকালুকি’ নামের উৎপত্তি সম্পর্কে লোকমুখে বিভিন্ন কাহিনী প্রচলিত রয়েছে। জনশ্রুতি মতে, বহু বছর আগে ত্রিপুরার মহারাজা ওমর মানিক্যের সেনাবাহিনীর ভয়ে বড়লেখার কুকি দলপতি হাঙ্গর সিং জঙ্গলপূর্ণ ও কর্দমাক্ত এক বিস্তীর্ণ এলাকায় এমনভাবে লুকিয়ে যায় যে, কালক্রমে ঐ এলাকার নাম হয় ‘হাঙ্গর লুকি’, ধীরে ধীরে তা ‘হাকালুকি’তে রূপান্তরিত হয়। অন্য আরেকটি জনশ্রুতি অনুযায়ী, প্রায় দুই হাজার বছর আগে প্রচণ্ড এক ভূমিকম্পে ‘আকা’ নামে এক রাজা ও তার রাজত্ব মাটির নিচে সম্পূর্ণ তলিয়ে যায়। কালক্রমে এই তলিয়ে যাওয়া নিম্নভূমির নাম হয় ‘আকালুকি’। যা থেকে হাকালুকি শব্দের প্রচলন। আরো প্রচলিত যে, এক সময় বড়লেখা থানার পশ্চিমাংশে ‘হেংকেল’ নামে একটি উপজাতি বাস করতো। হেংকেলদের বসবাস এলাকার নাম ছিল ‘হেংকেলুকি’। পরবর্তীতে এই ‘হেংকেলুকি’ হাকালুকি নাম ধারণ করে। এও প্রচলিত যে, হাকালুকি হাওরের কাছাকাছি একসময় বাস করতো কুকি, নাগা উপজাতিরা। তাদের নিজস্ব উপজাতীয় ভাষায় এই হাওরের নামকরণ করা হয় ‘হাকালুকি’, যার অর্থ 'লুকানো সম্পদ'। অন্যদিকে সাগর শব্দটি থেকে ‘হাওর’ শব্দের উৎপত্তি বলে ধরে নেয়া হয়।

পাঁচটি উপজেলা ও ১১টি ইউনিয়ন নিয়ে বিস্তৃত হাকালুকি হাওরটি সিলেট ও সীমান্তবর্তী মৌলভীবাজার জেলায় অবস্থিত। হাওরের ৪০ শতাংশ বড়লেখা, ৩০ শতাংশ কুলাউড়া, ১৫ শতাংশ ফেঞ্চুগঞ্জ, ১০ শতাংশ গোলাপগঞ্জ এবং ৫ শতাংশ বিয়ানীবাজার উপজেলার অন্তর্গত। হাওরটির আয়তন ২০ হাজার ৪০০ হেক্টর বা ১৮১.১৫ বর্গ কিমি। ২৪০টি বিল নিয়ে গঠিত দেশের বৃহত্তম এই হাওর এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ মিঠা পানির জলাভূমি।

হাকালুকি হাওরের স্থায়ী জলাশয়গুলোতে বিভিন্ন জাতের উদ্ভিদ জন্মে। সাধারণত দুধরণের গাছ জন্মে: শেকড়ধারী আর ভাসমান। হাকালুকি হাওরে ৫২৬ প্রজাতির উদ্ভিদ, ৪১৭ প্রজাতির পাখি, এর মধ্যে ১১২ প্রজাতির অতিথি পাখি ও ৩০৫ প্রজাতির দেশীয় পাখি। এছাড়া ১৪১ প্রজাতির অন্যান্য বন্যপ্রাণী, ১০৭ প্রজাতির মাছ, তন্মধ্যে ৩২ প্রজাতি বিভিন্ন পর্যায়ে বিপন্নপ্রায়। এছাড়াও রয়েছে নানা ধরনের কীট-পতঙ্গ, জলজ ও স্থলজ ক্ষুদ্র অণুজীব। ইকো-ট্যুরিজমের জন্য অত্যন্ত সম্ভাবনাময় হাকালুকি হাওরসহ সাতটি প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা। উপরোক্ত প্রাকৃতিক উপাদান ছাড়াও রয়েছে স্থানীয় পেশাজীবী মানুষের ইতিহাস, সামাজিক আচার, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ। ১৫০ প্রজাতির মিঠা পানির মাছ, ১২০প্রজাতির জলজ উদ্ভিদ, বিলুপ্ত প্রায় ২০ প্রজাতির সরীসৃপ। এখানে প্রতি বছর শীতকালে প্রায় ২০০ বিরল প্রজাতির অতিথি পাখির সমাগম ঘটে। হাকালুকি হাওর টেকসই উন্নয়ন, জীববৈচিত্র সংরক্ষণ, ইকোটুরিজ্যম শিল্প বিকাশের এক অসাধারণ আধার।

হাকালুকি হাওরের বিশাল জলরাশির মূল প্রবাহ হলো জুরী এবং পানাই নদী। এই জলরাশি হাওরের উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত কুশিয়ারা নদী দিয়ে প্রবাহিত হয়। বর্ষাকালে হাওর সংলগ্ন এলাকা প্লাবিত হয়ে বিশাল রূপ ধারণ করে। এই সময় পানির গভীরতা হয় ২-৬ মিটার।

হাকালুকি হাওরে প্রায় ২৩৮টি বিল রয়েছে। প্রায় সারাবছরই বিলগুলিতে পানি থাকে। উল্লেখযোগ্য বিলসমূহ হলো- চাতলা বিল, চৌকিয়া বিল, ডুলা বিল, পিংলার কোণা বিল, ফুটি বিল, তুরাল বিল, তেকুনি বিল, পাওল বিল, জুয়ালা বিল, কাইয়ারকোণা বিল, বালিজুড়ি বিল, কুকুরডুবি বিল, কাটুয়া বিল, বিরাই বিল, রাহিয়া বিল, চিনাউরা বিল, দুধাল বিল, মায়াজুরি বিল, বারজালা বিল, পারজালা বিল, মুছনা বিল, লাম্বা বিল, দিয়া বিল, ইত্যাদি।

হাওর উপকূলবর্তী এলাকার লোকজন, ফসল উঠে গেলে বছরের শুষ্ক মৌসুমের নির্দিষ্ট কয়েক মাস তাদের গৃহপালিত গবাদি পশু পাঠিয়ে দেন হাওরে বসবাসরত একশ্রেণীর মানুষের কাছে, যারা এগুলোর তত্ত্বাবধান করে। এই কাজের বিনিময়ে এরা দুধ পায়। মেয়াদ শেষে প্রকৃত মালিক এসে গরু-বাছুর ফেরত নেয়। এই পুরো ব্যবস্থাকে হাওর এলাকায় ‘বাথান’ বলা হয়। বাথানের মালিকেরা এসকল গবাদি পশুর দুধ বিক্রি করে প্রচুর উপার্জন করে থাকেন। ঐতিহ্যগতভাবে হাকালুকি অঞ্চল দুধ ও দধির জন্য বিখ্যাত।

ভ্রমণের সময়: নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি হচ্ছে হাকালুকি হাওর দেখার উপযুক্ত সময়। এসময় শীত থাকায় হাওরের চারপাশ অতিথি পাখিতে মুখরিত থাকে। এছাড়া জুন থেকে আগস্ট মাসেও ভালো। কারণ বর্ষায় হাওর পানিতে পূর্ণ থাকে।



কিভাবে যাবেন: ঢাকার ফকিরাপুরল, গাবতলি, মহাখালি এবং আব্দুল্লাহপুর বাস টামির্নাল থেকে সিলেটগামী গ্রীন লাইন, এনা, সৌদিয়া পরিবহনের যে কোন গাড়িতে করে মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া আসতে হবে। সে জন্য ভাড়া পরবে (এসি) ৭০০-৯০০, নন এসি (৩৫০-৪০০)।

ছাড়াও কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন হতে উপবন, জয়ন্তিকা, পারাবত অথবা কালনী এক্সপ্রেস ট্রেনে করে কুলাউড়া যাওয়া যাবে। তারপর কুলাউড়া থেকে অটোরিকশা বা রিক্সা ভাড়া করে সরাসরি হাওরে। ভাড়া লাগবে ৬০-১০০ টাকা।

এছাড়া কমলাপুর বা বিমানবন্দর রেল স্টেশন হতে রাতে সিলেটের উদ্দেশ্যে যাত্রা করা উপবন এক্সপ্রেসে করে সিলেটের ঠিক আগের স্টেশন মাইজগাও এ নামতে হবে। মাইজগাও থেকে অটোরিকশায় করে ফেঞ্চুগঞ্জ বাজারে আসতে হবে। ফেঞ্চুগঞ্জ বাজারে নৌকাঘাটে দিনপ্রতি তিন থেকে চার হাজার টাকায় নৌকা ভাড়া করে কুশিয়ারা নদী পাড় হয়ে হাকালুকি হাওড়ে মনের আনন্দে ঘুরে বেড়াতে পারবেন।

কোথায় থাকবেন: হাওরে বিল ইজারাদারদের কুটিরগুলোতে বিল মালিকের অনুমতি নিয়ে ২-৪ জন অনায়াসে থাকা যায়। তবে বিল এলাকায় জোছনা রাতের তাবু ফেলে ক্যাম্পিং করার মুহূর্তগুলো সারা জীবন মনে থাকবে।

এছাড়াও সিলেট বা মৌলভীবাজারে বিভিন্ন মানের আবাসিক হোটেল রয়েছে, সেখানে গিয়ে যাত্রিযাপন করতে পারবেন।

কোথায় খাবেন: হাকালুকি হাওর ভ্রমণের সময় নৌকার মাঝির সাথে কথা বলে প্রয়োজনীয় বাজার কিনে নিয়ে মাঝিই রান্না করে খাওয়াবে।
তা ছাড়া নৌকায় ওঠার সময় বিস্কুট, চা, পাউরুটিসহ হালকা খাবার নিয়ে নিতে পারেন।

ভ্রমণের সঙ্গে নিন: ক্যাম্পিং করার জন্য তাবু রেইনকোট বড় ব্যাকপ্যাক শীতের সময় গেলে শীতের পোশাক। জুতা গামছা বাইনো কুলার ক্যামেরা প্রয়োজনীয় ব্যাটারি টর্চ লাইট ইত্যাদি।

 

টাইমস/এএইচ/এইচইউ

Share this news on:

সর্বশেষ

img
ভারত কখনোই কোনো দেশ দখল করেনি : আরএসএস প্রধান Sep 15, 2025
img
ট্রেড লাইসেন্স নবায়ন ও গ্রহণে কিউআর কোড বাধ্যতামূলক করা হবে: গভর্নর Sep 15, 2025
img
নারী ফিফা রেফারি হওয়ার দৌড়ে খো খো অধিনায়ক Sep 15, 2025
img

এমি অ্যাওয়ার্ডস ২০২৫

এমির মঞ্চে এবার বাজিমাত করলো যারা Sep 15, 2025
img
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে খেলবেন উইলিয়ামসন Sep 15, 2025
img
আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের আরও ৪ নেতাকর্মী গ্রেপ্তার Sep 15, 2025
img
বাংলাদেশে আরও সহযোগিতা বাড়াতে চায় আইএমএফ Sep 15, 2025
img
ডুয়া লিপার গায়ে পাকিস্তানের জার্সি! Sep 15, 2025
img
বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণের দাবিতে আন্দোলন Sep 15, 2025
img
আমোরিমের অধীনে ইউনাইটেড ‘আরো খারাপ হয়েছে’: রুনি Sep 15, 2025
img
দেশে অবৈধ অস্ত্র প্রবেশ ঠেকাতে জরুরি বার্তা বিজিবির Sep 15, 2025
img
জাতীয় পার্টি ও ১৪ দলের কার্যক্রম নিষিদ্ধের দাবি জামায়াতের Sep 15, 2025
img
পাকিস্তানের বিপক্ষে প্রথমবার ছক্কা হজম করলেন বুমরাহ Sep 15, 2025
img
সেবায় নৈতিকতা-মানবিক মূল্যবোধকে প্রাধান্য দেওয়ার আহ্বান বিএমইউ ভিসির Sep 15, 2025
img
গাজা সিটিতে জাতিসংঘের ১০টি ভবন ধ্বংস করেছে ইসরাইল Sep 15, 2025
img
রামেকে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে প্রাণ গেল ১ জনের, ২৪ ঘণ্টায় হাসপাতালে ভর্তি ১৩ Sep 15, 2025
img
ফিফার কাছে রেফারিদের বিরুদ্ধে নালিশ করবে রিয়াল মাদ্রিদ Sep 15, 2025
img
সারা দেশে শুরু হলো একাদশ শ্রেণির ক্লাস Sep 15, 2025
img

জুলাই গণঅভ্যুত্থান

আহত ও শহীদ পরিবারের আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সহযোগিতা করা হবে: আসিফ মাহমুদ Sep 15, 2025
img
পুলিশে ফের বড় রদবদল Sep 15, 2025