মিল্কভিটা, আড়ংসহ সব কোম্পানির দুধেই ক্ষতিকর এন্টিবায়োটিক!  

 

মিল্কভিটা, আড়ংসহ বাজারে প্রচলিত বিভিন্ন ব্র্যান্ডের সাতটি প্যাকেটজাত (পাস্তুরিত) দুধের নমুণা পরীক্ষা করে সেগুলোতে মানুষের চিকিৎসায় ব্যবহৃত শক্তিশালী অ্যান্টিবায়োটিকের উপস্থিতি পাওয়া গেছে।

সেসঙ্গে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ঘি, ফলের জুস, মরিচ ও হলুদের গুঁড়া, পাম অয়েল, সরিষার তেল ও সয়াবিন তেলের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে; যার অধিকাংশকই মানহীন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োমেডিক্যাল রিসার্চ সেন্টার ও ফার্মেসি অনুষদের গবেষকদের পরীক্ষায় এই ফলাফল উঠে এসেছে।

জানা গেছে, বিএসটিআইয়ের মানদণ্ড অনুযায়ী এসব খাদ্যপণ্য একাধিক ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করা হয়েছে।

মঙ্গলবার সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি অনুষদের মোকাররম ভবনের পাশে বিজ্ঞান গ্রন্থাগারে অবস্থিত ফার্মেসি লেকচার থিয়েটারে সংবাদ সম্মেলনে করে পরীক্ষার ফলাফল তুলে ধরা হয়।

এতে বক্তব্য রাখেন সেন্টারের পরিচালক ও ওষুধপ্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক আ ব ম ফারুক। এসময় উপস্থিত ছিলেন ফার্মাসিউটিক্যাল কেমিস্ট্রি বিভাগের অধ্যাপক ড. ফিরোজ আহমেদ ও অধ্যাপক রায়হান সরকার ।

পাস্তুরিত দুধে অ্যান্টিবায়োটিকের উপস্থিতি অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয় মন্তব্য করে অধ্যাপক আ ব ম ফারুক বলেন, পরীক্ষায় পাস্তুরিত দুধের সাতটি নমুনার সবগুলোতেই লেভোফ্লক্সাসিন ও সিপ্রোফ্লক্সাসিন এবং ছয়টি টি নমুনায় এজিথ্রোমাইসিনের উপস্থিতি পাওয়া গেছে।

এছাড়া পাস্তুরিত ও অপাস্তুরিত দুধের চারটি নমুনাতে ডিটারজেন্ট এবং অপাস্তুরিত দুধে একটি নমুণাতে ফরমালিন পাওয়া গেছে বলে জানান তিনি।

তিনি বলেন, আমরা যে ফলাফল দিয়েছি তা নমুণার ফলাফল। তার মানে এই নয় ওইসব কোম্পানির সব পণ্যই এরকম।

এছাড়া টোটাল ব্যাকটেরিয়া কাউন্টে পাস্তুরিত দুধের সাতটি নমুনার কোনোটাই মানোত্তীর্ণ হতে পারেনি। এর মান প্রতি মিলিলিটারে সর্বোচ্চ ৩০ সিএফইউ থাকার কথা থাকলেও সব নমুণাতে ৪৯-২৩৫ সিএফইউ পাওয়া গেছে।

বিএসটিআইয়ের মানদণ্ড অনুযায়ী দুধে ফ্যাট ইন মিল্ক সাড়ে ৩ শতাংশের বেশি থাকার কথা থাকলেও পাস্তুরিত দুধের সাতটি নমুণার ছয়টিতেই এর কম (৩.২-৩.৪ শতাংশ) পাওয়া গেছে।

কলিফর্ম কাউন্টে পাস্তুরিত দুধের ২টি মানোত্তীর্ণ হতে ব্যর্থ হয়েছে এবং স্টেফাইলোকক্কাস স্পেসিজ জীবাণুর উপস্থিতি থাকার কথা না থাকলেও পাস্তুরিত দুধের ৫টিতে এটি পাওয়া গেছে।

পাস্তুরিত দুধের ব্র্যান্ডগুলো হলো- মিল্কভিটা, আড়ং, ফার্ম ফ্রেশ, প্রাণ, ইগলু, ইগলু চকোলেট এবং ইগলু ম্যাংগো। অপাস্তুরিত (খোলা) দুধের তিনটি নমুনা রাজধানীর পলাশী, গাবতলী ও মোহাম্মদপুর বাজার থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে।

দুধে অ্যান্টিবায়োটিকে উপস্থিতি মানবদেহে কী প্রভাব ফেলবে জানতে চাইলে আবম ফারুক বলেন, বিভিন্ন সময় আমরা বলে থাকি অ্যান্টিবায়োটিক এখন আর কাজ করছে না বা অ্যান্টিবায়োটিক অকার্যকর হয়ে যাচ্ছে। তো কাজ করছে না এসব কারণে। কারণ শরীরের মধ্যে অলরেডি অ্যান্টিবায়োটিক ঢুকে আছে- এই কারণে অ্যান্টিবায়োটিককে যখন আমরা ওষুধ হিসেবে খাই তখন আর কাজ করে না।

তিনি আরও বলেন, ফরমালিন তো স্বাভাবিকভাবেই মানব শরীরের জন্য ক্ষতিকর। তবে আগের তুলনায় এখন ফরমালিন দেওয়ার প্রবণতা অনেক কমেছে।

ঘিয়ের মধ্যে তিলের তেল

বাজারে প্রচলিত ৮টি ঘিয়ের নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা চালানো হয়। এগুলো হলো- আড়ং, বাঘাবাড়ি, প্রাণ, মিল্কভিটা, মিল্কম্যান, সমির এবং টিনে বিক্রি হওয়া নামবিহীন দুটি নমুনা। বিএসটিআই স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী ঘিতে জলীয় উপাদান সর্বোচ্চ ০.৫ শতাংশ থাকার কথা থাকলেও সব নমুণাতেই ০.৭৫-১.১৭ শতাংশ পাওয়া গেছে।

আয়োডিন ভ্যালুতে সবগুলো নমুনাই মানোত্তীর্ণ হতে ব্যর্থ হয়েছে। এই উপাদান প্রতি ১০০ গ্রাম ঘিতে ২৬-৩৫ গ্রাম থাকার কথা থাকলেও ৮টি নমুনার সবগুলোই ৩৫ দশমিক ১২ থেকে ৫০ দশমিক ০২ গ্রাম পাওয়া গেছে।

এছাড়া ঘিতে তিলের তেলের কোনো উপস্থিতি নিষিদ্ধ থাকলেও এসব পণ্যের সবগুলোতেই এর উপস্থিতি ছিল। এই বিবেচনায় পরীক্ষায় ৮টি নমুনার সবগুলোই মানোত্তীর্ণ হতে ব্যর্থ হয়েছে।

ফলের জুসে ক্ষতিকারক সাইক্লামেট

ফলের জুসের ১১টি ব্র্যান্ডের নমুনা সংগ্রহ করে বিএসটিআইয়ের শর্তপূরণ করে কিনা তা পরীক্ষা করা হয়। সবগুলোতেই ক্ষতিকর কৃত্রিম মিষ্টিকারক সাইক্লামেট ব্যবহার করা হয়েছে।

যেসব পণ্যের নমুনা সংগ্রহ করা হয় সেগুলো হলো- স্টার শিপ ম্যাংগো ফ্রুট ড্রিংক, সেজান ম্যাংগো ড্রিংক, প্রাণ ফ্রুটো, অরেনজি, প্রাণ জুনিয়র ম্যাংগো ফ্রুট ড্রিংক, লিটল ফ্রুটিকা ম্যাংগো ফ্রুট ড্রিংক, সানড্রপ, চাবা রেড এপল, সানভাইটাল নেকটার ডি ম্যাংগো, লোটে সুইডেন্ড এপল ড্রিংক এবং ট্রপিকানা টুইস্টার।

শুকনা মরিচ, হলুদ গুঁড়া

বাজারে প্রচলিত আটটি শুকনা মরিচের গুঁড়া মশলা সংগ্রহ করে পরীক্ষা চালানো হয়। সেগুলো হলো- আরকো, বিডি, ড্যানিশ, ফ্রেশ, প্রাণ, রাঁধুনি এবং প্লাস্টিক ব্যাগে খোলা অবস্থায় বিক্রি হওয়া নামহীন ২টি।

বিএসটিআই স্টান্ডার্ড অনুযায়ী শুকনা গুঁড়া মরিচে এসিড ইনসল্যুবল এ্যাশ ১ দশমিক ২৫ শতাংশ থাকার কথা থাকলেও আটটি ব্রান্ডের সবগুলো নমুণায় ১ দশমিক ৩১ থেকে ১ দশমিক ৪৯ শতাংশ পাওয়া গেছে।

হলুদের নমুনায়ও বিএসটিআই স্টান্ডার্ড মানা হয়নি। ৮টি নমুণার ৬টিতে জলীয় উপাদান বেশি পাওয়া গেছে। আর মেটানিল ইয়েলো নামের টেক্সটাইল কালারের উপস্থিতি গ্রহণযোগ্য না হলেও বেশ কয়েকটিতে এর উপস্থিতি পাওয়া গেছে।

পাম অয়েল

বাজারে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় বলে প্রতীয়মান এমন ১০টি নমুনা ওপর পরীক্ষা চালানো হয়। সেগুলা হলো- মিজান এবং টিনে খোলা বিক্রি হওয়া ৯টি নমুনা। বিএসটিআই স্টান্ডার্ড অনুযায়ী, পাম অয়েলে স্যাপনিফিকেশন ভ্যালু, ইনসল্যুবল ইমপিউরিটিজ, পারক্সাইড ভ্যালু ও জলীয় উপাদান সবগুলো নমুনাতেই স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি পাওয়া গেছে। এই বিবেচনায় ১০টির সব নমুনাই মানোত্তীর্ণ হতে ব্যর্থ হয়েছে।

সরিষার তেল

সরিষার তেলের ৮টি বিভিন্ন নামের নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা চালানো হয়। সেগুলো হলো- রূপচাঁদা, রাঁধুনি, তীর, ফ্রেশ, পুষ্টি, সুরেশ, ড্যানিশ এবং বসুধা।

বিএসটিআই স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী সরিষার তেলের স্যাপনিফিকেশন ভ্যালু যত থাকার কথা তার থেকে বেশি রয়েছে ৮টি নমুনার ৩টিতে। পারক্সাইড ভ্যালু ১০ থাকার কথা থাকলেও ৪টি নমুনাতে এর পরিমাণ ছিল প্রায় দ্বিগুণ। আর রিলেটিভ ডেনসিটির পরিমাণও স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ছিল ৪টিতে। এছাড়া জলীয় উপাদানও বেশি পাওয়া গেছে ৮টি নমুনার সবগুলোতেই।

সয়াবিন তেল

সয়াবিন তেলের ৮টি নমুনার ওপর পরীক্ষা চালানো হয়। সেগুলো হলো- রূপচাঁদা, ফ্রেশ, পুষ্টি, তীর, এসিআই পিওর, ভিওলা, মুসকান এবং মিজান।

বিএসটিআই স্টান্ডার্ড অনুযায়ী তেলের এসিড ভ্যালু যতটুকু থাকার কথা দুটি নমুনায় তার থেকে বেশি পাওয়া গেছে। স্যাপনিফিকেশন ভ্যালুর বিবেচনায় ৮টির মধ্যে ৭টি নমুনা মানোত্তীর্ণ হতে ব্যর্থ হয়েছে।

৫টি নমুনাতে পারক্সাইড ভ্যালু স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি পাওয়া গেছে। আয়োডিন ভ্যালু ৮টি নমুনায় প্রয়োজনের তুলনায় ৪টিতে কম এবং ১টিতে বেশি পাওয়া গেছে। আর রিলেটিভ ডেনসিটি বেশি পাওয়া গেছে ৩টি নমুনাতে। জলীয় উপাদান ৮টি নমুনাতেই স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ছিল। এছাড়া মেটাল কনটেন্ট কপারের ক্ষেত্রে সবগুলোতে নির্ধারিত সীমার চেয়ে বেশি এবং আয়রনের ক্ষেত্রে ৬টিতে বেশি ছিল।

ভেজাল খাদ্যগুলো তিনটি গ্রুপকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করছে উল্লেখ করে আবম ফারুক বলেন, বাচ্চাদের ক্ষেত্রে যাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো এখনো পূর্ণাঙ্গভাবে তৈরি হয়নি এবং গর্ভবতী মায়েদের যদি এসব ভেজাল খাদ্য খাওয়ানো হয় তাহলে মা এবং গর্ভের বাচ্চা দুই জনেরই ক্ষতি হয়। আর বৃদ্ধ যারা তাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো ম্যাচিউরড কিন্তু এগুলো এখন ধীরে ধীরে ক্ষয়ের দিকে যাচ্ছে। এগুলো আগের মতো এখন আর সেভাবে কাজ করে না এজন্য তাদেরও বেশি ক্ষতি হয়।

টাইমস/জেডটি

 

Share this news on:

সর্বশেষ

img
আমি ভয় পাওয়ার মানুষ নই : পরেশ রাওয়াল Sep 16, 2025
img
যুবদলের এক নেতাকে সব পদ থেকে বহিষ্কার Sep 16, 2025
img
আত্মসমর্পণ করে জামিন পেলেন মডেল সানাইয়ের স্বামী Sep 16, 2025
img
সরকারের সমালোচনার পাশাপাশি নিজেকেও পরিবর্তন করতে হবে : রিজওয়ানা Sep 16, 2025
img
শেখ হাসিনার মামলায় আমিই হয়তো শেষ সাক্ষী : নাহিদ ইসলাম Sep 16, 2025
img
ছেলের বন্ধুরা আমাকে ‘দিদি’ বলে ডাকে : শ্রাবন্তী Sep 16, 2025
img
৩০ মামলার আসামি নৌ ডাকাত আবুল কালামকে গ্রেপ্তার করেছে র‍্যাব-১১ Sep 16, 2025
img
বেটিং অ্যাপ কাণ্ডে ইডি দপ্তরে অঙ্কুশ Sep 16, 2025
img
ভাঙ্গায় বিএনপির শান্তি মিছিল, আন্দোলন স্থগিত শনিবার পর্যন্ত Sep 16, 2025
img
বাংলাদেশের শুরুতে রান দরকার, লিটনের সাহায্য প্রয়োজন: সাইমন ডুল Sep 16, 2025
বাংলাদেশে আসছেন পাকিস্তানি অভিনেত্রী হানিয়া আমির Sep 16, 2025
img
স্বাস্থ্য উপদেষ্টার বিদেশে চিকিৎসা নিয়ে প্রশ্ন তুললেন মাসুদ কামাল Sep 16, 2025
img
এবার এনসিপি নেত্রীর পদত্যাগ Sep 16, 2025
img
ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন, ঢাকায় একদিনেই ২১৫২ মামলা Sep 16, 2025
img
এনআইডি আইন বাতিলসহ ৫ দফা সুপারিশ ইসি কর্মকর্তাদের Sep 16, 2025
img
ম্যাচ পরিত্যক্ত হলে বাংলাদেশের ভাগ্যে কী ঘটবে? Sep 16, 2025
img
রাশিয়া ও কানাডা থেকে ৩৩২ কোটি টাকার সার কিনবে সরকার Sep 16, 2025
img
রংপুরে ট্রেনের ৬ বগি লাইনচ্যুত Sep 16, 2025
img
সংগীতশিল্পী দীপ আর নেই Sep 16, 2025
img
নির্বাচন পেছাতে যুগপৎ আন্দোলনের ডাক দিয়েছে জামায়াত : নিলোফার মনি Sep 16, 2025