ব্যাংকে ব্যাংকে পুলিশ পাঠিয়ে ডলার বাজার নিয়ন্ত্রণ আর নয় : গভর্নর

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক সকাল-বিকাল প্রতিটা ব্যাংক থেকে ডলারের দামের আপডেট নেবে এবং সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এখন আর ব্যাংকে ব্যাংকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তা বা পুলিশ পাঠিয়ে এই দাম নিয়ন্ত্রণ করব না।’

আজ বৃহস্পতিবার (২২ মে) রাজধানীর একটি হোটেলে আয়োজিত এক গোলটেবিল আলোচনায় এসব কথা বলেন তিনি।

গভর্নর বলেন, ‘ডলারের দাম এখন থেকে বাংলাদেশে নির্ধারিত হবে।

দুবাই বা পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে নয়। আমরা বলব আপনারা অস্থির হবেন না। বাজার অস্থিতিশীলতার দিকে কান দেবেন না। চাহিদা ও সরবরাহের ভিত্তিতে বাজারে ডলারের দাম নির্ধারণ হবে।

তিনি বলেন, ‘আইএমএফসহ নানা আন্তর্জাতিক সংস্থা বলছিল আমাদের বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করার জন্য, এটি নিয়ে অনেক দিন ধরেই আলোচনা হচ্ছে। কিন্তু কখন এটা করব? এটা নিয়ে দীর্ঘদিন যাবৎ আলোচনা হচ্ছিল। অনেকেই বলেছেন আইএমএফের প্রগ্রামগুলো আমরা মিট করতে পারব না। আগের সরকার একটাও মিট করতে পারেনি, এটা সত্য।

কিন্তু আমরা সবগুলো মিট করেছি। সেপ্টেম্বর-জানুয়ারি এবং মার্চ প্রান্তিকে সব জায়গাতে আমরা সফল হয়েছি।’

আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বাজারে কমোডিটির দাম কম থাকায় আমাদের অনেক সুবিধা হচ্ছে। লাক্সারি পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে রেস্ট্রিকশন দেওয়ার পক্ষে আমি না। আমি ট্যাক্স বাড়িয়ে দেব।

যার সামর্থ্য আছে সে কিনবে, যার নেই সে কিনবে না। যার সামর্থ্য আছে তাকে রেস্ট্রিকশন দিক, সে বিদেশে গিয়ে ওই পণ্য কিনবে। তখন তো আমার লাভ নাই। আমাদের এখানে ফরোয়ার্ড মার্কেট ডেভেলপ করেনি। এটা করলে ভালো হতো। এখন বাংলাদেশের মার্কেটে ডলার আনলে সেটার দাম পড়ে যাবে না। বিনিয়োগ করলে বিনিময় হারের কারণে ক্ষতির মুখে পড়তে হবে না। এটা নিশ্চিত করতে পারলে এখানে আর বাজার নিয়ে ঝুঁকি থাকবে না।’

গভর্নর বলেন, ‘আমাদের এখন গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে মূল্যস্ফীতি ৩-৪ শতাংশে নিয়ে আসা। আমার যেটা মনে হচ্ছে, আগস্টের মধ্যে আমাদের মূল্যস্ফীতি ৭ এর মধ্যে চলে আসবে। বছর শেষে এটা ৫ শতাংশের মধ্যে চলে আসবে বলে আমি মনে করি।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের মানুষের শত শত কোটি ডলার বিদেশে আছে। কেন তারা টাকা এখানে না এনে সেখানে রাখে? কারণ তারা ভাবে বাংলাদেশে আমার টাকাটা নিরাপদ কিনা? কারণ বিদেশে তো তার টাকা নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে হয় না। এটি ঠিক করতে হলে আমাদের রাজনৈতিক ইকোনমি নিয়ে ভাবতে হবে।’

তিনি আরো বলেন, ‘আমরা আমাদের বিনিময় হার আরো লিবারেলাইজ করব। যার যত পাওনা আছে সেগুলা পরিশোধ করা হয়েছে। বিদেশিরা বিনিয়োগ করে তাদের প্রফিট যখন নিয়ে যেতে চায় নিয়ে যাবে। আমরা আটকাবো না। আমরা শুধু কর নীতি নিয়ে কথা বলব। এর বাইরে না।’

এ সময় মাস্টার কার্ডের কান্ট্রি ম্যানেজার সৈয়দ মোহাম্মদ কামাল বলেন, ‘প্রবাসী ভাই-বোনদের একটু জানানো দরকার যে ডলারের দাম বেড়ে যাবে না। এটা স্থির থাকবে। কারণ অনেকেই ভাবছেন ডলারের দাম বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ায় দাম হয়তো বাড়বে। আসলে সেটি হবে না। কারণ বর্তমানে সময়টা খুব ভালো অর্থনীতির জন্য। প্রবাসীরা সামনে ঈদ উপলক্ষে টাকা পাঠানো শুরু করবেন। তখন অর্থনীতি আরো সুবিধাজনক স্থানে চলে আসবে।’

জিপিএইচ ইস্পাত লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘আর্থিক খাতে বড় একটা সংস্কার প্রয়োজন ছিল। যেটা বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার মাধ্যমে হয়েছে। আমরা যে বিগত সময়ে হাজার হাজার কোটি টাকা ক্ষতির মুখে পড়েছি, সেটা বিনিময় হার ফিক্সড থাকার কারণে হয়েছে। বর্তমান সময়টা এই কাজের জন্য ঠিক আছে।

প্রতিটা জিনিস আমরা যদি আজকে খেয়াল করি জ্বালানি তেল থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিটা আইটেমের দাম কম। এর মাঝে আইএমএফ, এডিবি, ওয়ার্ল্ড ব্যাংক ফান্ড দিচ্ছে। ফলে আমি মনে করি, আগামী কয়েক দিন বিনিময় হার নিয়ে কোনো সমস্যা হবে না।’

তিনি বলেন, ‘কিন্তু আশঙ্কার কথা হচ্ছে, ২০২০-২১ সালেও যখন ৪৭ বিনিয়ন ডলার রিজার্ভ ছিল সেটা হঠাৎ করেই ২২ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসলো। কারণ জ্বালানি এবং কমোডিটির দাম ডাবল বা তারও বেশি হয়ে গিয়েছিল। তখন আমাদের রিজার্ভের ওপর প্রভাব পড়েছিল। এখন যদি আগামী দিনে যদি কোনো বড় দুর্যোগ আসে, তাহলে আমাদের ৫০০ মিলিয়ন ডলার দিয়ে আমরা উতরাতে পারব না। এটা খুবই ছোট অঙ্ক।

এটাকে ৫-৬ বিলিয়নে নিয়ে যেতে হবে। বাজারের ওপর দর ছাড়ার পর সঠিক সময়ে যেন দাম পরিবর্তন করা হয়। না হলে নেতিবাচক প্রভাব দেখা দেবে। যুক্তরাষ্ট্র রেমিট্যান্সের ওপর ৫ শতাংশ কর বসিয়েছে। এটা হুন্ডি বাড়িয়ে দেবে। যেটা আমাদের জন্য বিপদ ডেকে আনবে। ফলে এখানে কাজ করতে হবে, যেন ব্যাংকিং চ্যানেলে টাকা আসে।’

পলেসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ড. এম মাসরুর রিয়াজ বলেন, ‘আমাদের বিনিময় হারকে ২০১৮-১৯ সাল থেকে চেপে ধরা হয়েছিল।

সেখান থেকে একটা ফিক্সড জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়। এভাবে বিনিময় হারকে চাপিয়ে রাখা যায় না। এটা বেশি দিন রাখার কারণে দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এভাবে বেশি দিন চলা যায় না। বর্তমানে বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত। বড় পরিবর্তনের কোনো সময় নেই। যত দ্রুত এ ধরনের সংস্কার করা যায় ততই ভালো।’

তিনি বলেন, ‘এটার কারণে আইএমএফের চাপ দূর হয়েছে। ওয়ার্ল্ড ব্যাংকসহ আন্তর্জাতিক যেসব চাপ বা আপত্তির জায়গা ছিল সেগুলাও দূর হয়ে গেছে। এই সংস্কারের সময়টা খুবই ভালো হয়েছে। কারণ সামনে কোরবানি। এই সময়ে রেমিট্যান্স আসবে অনেক বেশি। যেটা রিজার্ভ বাড়াবে।

অন্যদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে কমোডিটির দাম কমেছে। ফলে আমদানি বাবদ ডলার খরচ বেশি হবে না আগের তুলনায়। আভ্যন্তরীণ বাজারেও এখন চাইহদা কম। তবে, জ্বালানির জন্য বড় একটা অঙ্কের ডলার খরচ হয়। তবে, কাতারে বড় একটি গ্যাস ফিল্ড আবিষ্কার হয়েছে। তারা বাজারে সাপ্লাই বাড়ালে গ্যাসের দাম কমবে বলে আশা করা যায়। ফলে জ্বালানি আমদানির জন্য ডলারের চাহিদাও কমবে।’

আরএম/এসএন 

Share this news on:

সর্বশেষ

img
টানা তৃতীয়বার ফাইনালে উঠতে পাকিস্তানকে ১২২ রানের লক্ষ্য বাংলাদেশের Dec 19, 2025
img
ওসমান হাদিকে বহনকারী বিমান অবতরণ করল হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে Dec 19, 2025
img
প্রথম আলোর ক্ষতিগ্রস্ত কার্যালয় পরিদর্শনে ডিএমপি কমিশনার Dec 19, 2025
img
ষড়যন্ত্র করে নির্বাচন প্রতিহত করা যাবে না: আমান Dec 19, 2025
img
বিমানবন্দর থেকে কোন রুটে ঢাবিতে নেওয়া হবে ওসমান হাদিকে? Dec 19, 2025
img
প্রথম আলোর কার্যালয়ে হামলার প্রতিবাদে কর্মীদের মানববন্ধন Dec 19, 2025
img
নির্বাচন বানচালের উদ্দেশেই এই হামলা : উপদেষ্টা ফারুকী Dec 19, 2025
img
ভেনেজুয়েলার সঙ্গে যু/দ্ধে/র সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না : ট্রাম্প Dec 19, 2025
img
মব সন্ত্রাস পুরো জাতিকে বিভক্ত করেছে: মির্জা ফখরুল Dec 19, 2025
img
তারেক রহমানের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের ভেন্যু পরিদর্শনে বিএনপি নেতারা Dec 19, 2025
img
পেশাদার গণমাধ্যমকর্মী‌দের নিরাপত্তা নিশ্চিতের আহ্বান এমএফসি-এর Dec 19, 2025
img
আগরতলায় বাংলাদেশ সহকারী দূতাবাসের সামনে বিক্ষোভ Dec 19, 2025
img
হাদিকে বহনকারী বিমান বাংলাদেশের আকাশ-সীমায় Dec 19, 2025
img
আমরা কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি: শামীমা নাসরীন Dec 19, 2025
img
হাদি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে আওয়ামী লীগ ও ‘র’ জড়িত : খেলাফত ছাত্র মজলিস Dec 19, 2025
img
ইনকিলাব মঞ্চ ছাড়া কারও প্ররোচনায় পা দিবেন না: জুমা Dec 19, 2025
img
বিমানযোগে যেভাবে আনা-নেয়া হয় মরদেহ Dec 19, 2025
img
আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের দুই বিচারকের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা Dec 19, 2025
img
শাহবাগের নাম ‘শহীদ ওসমান হাদি চত্বর’ ঘোষণা Dec 19, 2025
img
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থে‌কে পদত্যাগের ঘোষণা দিলেন যুথি Dec 19, 2025