জিমি কার্টারঃ মানবকল্যাণের অনন্য ভাবমূর্তি


জিমি কার্টার, একজন মার্কিন রাজনীতিবিদ ও আমেরিকার ৩৯তম প্রেসিডেন্ট। এর আগে ডেমোক্রেট দল থেকে জর্জিয়ার স্টেট সিনেটর ও জর্জিয়ার গভর্নরের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। বর্তমানে তিনি জীবিতদের মধ্যে সবচেয়ে প্রবীণ মার্কিন প্রেসিডেন্ট। গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখায় ২০০২ সালে তিনি নোবেল শান্তি পুরস্কার পান।

তিনি তার নোবেল বক্তৃতায় বলেছিলেন, “স্রষ্টা আমাদের সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা দিয়েছেন। আমরা মানুষের দুঃখ-দুর্দশা দূর করার সিদ্ধান্ত নিতে পারি, আমরা শান্তির জন্য একসঙ্গে কাজ করার সিদ্ধান্ত নিতে পারি, আমরা পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নিতে পারি- আর আমাদের এটাই করতে হবে”। 

কার্টার ১৯২৪ সালের ১ অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়া অঙ্গরাজ্যের প্লেইন শহরের একটি ধনাঢ্য কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার মা জর্জিয়ার ওয়াইস স্যানিটেরিয়াম হাসপাতালের একজন নার্স ছিলেন। তিনিই প্রথম মার্কিন প্রেসিডেন্ট যার জন্ম হাসপাতালে।

শৈশবে তিনি একটি স্কুলে পড়েছেন, যেখানে সবাই শেতাঙ্গ। কারণ ওই সময় এ অঞ্চলের কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকানদের হয় নিজ গৃহে নতুবা চার্চে পড়ার সুযোগ ছিল।তারপরও কার্টারের খুব ঘনিষ্ঠ দুজন কৃষ্ণাঙ্গ বন্ধু ছিল যারা তার জীবনে ব্যাপক প্রভাব রেখেছিল। ১৯৪৬ সালে তিনি ইউনাইটেড স্টেট নেভাল একাডেমি থেকে স্নাতক শেষ করে মার্কিন নৌবাহিনীতে যোগ দেন। ১৯৫৩ সালে তার বাবার মৃত্যুর পর পারিবারিক ব্যবসা দেখাশোনার উদ্দেশ্যে তিনি নৌবাহিনী ছেড়ে জর্জিয়া চলে আসেন।

এসময় তিনি আমেরিকার বর্ণবৈষম্য নীতির বিরোধিতা করেন এবং নাগরিক অধিকার আন্দোলনে সমর্থন দেন। ধীরে ধীরে তিনি ডেমোক্রেটিক পার্টির একজন সক্রিয় সদস্য হয়ে যান। সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীর পক্ষে কাজ করার সুবাদে ১৯৬৩ সালে তিনি জর্জিয়ার স্টেট সিনেটর নির্বাচিত হন। ১৯৭০ সালে তিনি গভর্নর কার্ল স্যান্ডার্সকে পরাজিত করে জর্জিয়ার গভর্নর নির্বাচিত হন এবং ১৯৭৫ পর্যন্ত তিনি এ দায়িত্বে ছিলেন।

জর্জিয়ার বাইরে জিমি কার্টার খুব একটা পরিচিত ছিলেন না। এরপরও ১৯৭৬ সালের জাতীয় নির্বাচনে তিনি ডেমোক্রেট দল থেকে প্রেসিডেন্ট পদে মনোনয়ন পান এবং শক্তিশালী রিপাবলিকান প্রতিদ্বন্দ্বী গেরাল্ড ফোর্ডকে পরাজিত করে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ওয়াটার গেট কেলেঙ্কারীর সমালোচনা করে নির্বাচনী প্রচারণার সময় তিনি বলেছিলেন, “আমি কখনো মিথ্যা বলব না, আমি কোন বিতর্কিত বিষয় এড়িয়ে যাব না”। তার ‌‘অ্যা লিডার ফর অ্যা চেঞ্জ’ শ্লোগান মার্কিন জনগণকে অনুপ্রাণিত করেছিল।

তিনি তার প্রেসিডেন্সির দ্বিতীয় দিনেই ভিয়েতনাম যুদ্ধ থেকে পলায়নকারী সৈন্যদের ক্ষমা করে দেন। তিনি ‘এনার্জি বিভাগ’ ও ‘শিক্ষা বিভাগ’ নামে দুটি পৃথক বিভাগ গঠন করেন এবং ন্যাশনাল এনার্জি পলিসি গ্রহণ করেন। তার প্রচেষ্টার ফলে ১৯৭৮ সালে মিশর ও ইসরাইলের মধ্যে ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যা মধ্যপ্রাচ্য সংকট নিরসনে এক মাইলফলক। এ চুক্তির মাধ্যমে মিশর ও ইসরাইল পরস্পরকে স্বীকৃতি দিলে মধ্যপ্রাচ্যে চলমান উত্তেজনা হ্রাস পায়।

এছাড়া ঐতিহাসিক পানামা খাল চুক্তি ও রাশিয়ার সঙ্গে কৌশলগত অস্ত্র সীমিতকরণ আলোচনা ‘সল্ট ২’ প্রণয়নে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ১৯৭৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তান আক্রমণ করে বসে। প্রতিক্রিয়ায় সোভিয়েত ইউনিয়নের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন তিনি। এরপর ১৯৮০ সালে মস্কোতে অনুষ্ঠিত গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক বর্জনের মাধ্যমে স্নায়ুযুদ্ধকে তীব্র করে তুলেন কার্টার।

তার শাসনামলে বেকারত্ব, উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি ও নিম্ন প্রবৃদ্ধিসহ যুক্তরাষ্ট্রে চরম অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দেয়। পরবর্তী নির্বাচনে যার ব্যাপক প্রভাব পড়ে। ১৯৮০ সালে প্রেসিডেন্ট পদে দ্বিতীয় দফা নির্বাচন করলেও রিপাবলিকান প্রার্থী রোনাল্ড রিগ্যানের কাছে তিনি পরাজিত হন। প্রেসিডেন্ট পদ থেকে অবসরের পর কার্টার মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করার লক্ষ্যে ১৯৮২ সালে ‘কার্টার সেন্টার’ প্রতিষ্ঠা করেন।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মধ্যে শান্তিচুক্তি, সমঝোতা, নির্বাচন পর্যবেক্ষণ ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর বিভিন্ন সমস্যা নিরসনে পরামর্শক ও মধ্যস্ততাকারী হিসেবে ভূমিকা পালন করেছেন তিনি। এছাড়া, আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকায় কমিউনিটি ভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠায় তার ভুমিকা অতুলনীয়। তিনি তার রাজনৈতিক ও পেশাগত জীবনের অভিজ্ঞতার আলোকে ৩০টি বই লিখেছেন। তার দুটি বিখ্যাত বই হল- ‘আওয়ার এনডেঞ্জার্ড ভ্যালুসঃ আমেরিকা’স মর্যাল ক্রাইসিস’ (২০০৬) ও ‘প্যালেস্টাইনঃ পিস নট অ্যাপার্টহিড’ (২০০৭)।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হচ্ছে ইসরাইলের সমালোচনা। পূর্বসূরীদের অনুসরণ না করে তিনি বৃত্তের বাইরে এসেছেন। ফিলিস্তিন-ইসরাইল ইস্যুতে তিনি ইসরাইলের বিভিন্ন নীতি ও সিদ্বান্তের সমালোচনা করেছেন। মধ্যপ্রাচ্য সংকট নিরসণে তিনি ‘দুইরাষ্ট্র নীতি’ এর পক্ষে কথা বলেছেন।

এভাবে বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠা ও মানবসেবায় এক অনন্য ভাবমূর্তি স্থাপন করেছেন জিমি কার্টার। 

 

টাইমস/এএইচ/জিএস

Share this news on:

সর্বশেষ

img
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নবনির্বাচিত কমিটির আত্মপ্রকাশ Jul 01, 2025
img
'ফুটবলের প্রতি যে ভালোবাসা এখনও আমার ভিতরে আছে তা আমাকে চালিয়ে নিচ্ছে' Jul 01, 2025
img
‘জুলাই বললে লাল হয়ে যায় স্মৃতি’- প্রেস সচিব শেয়ার করলেন কবিতা Jul 01, 2025
img
এবার ‘ক্যাপ্টেন কুল’ নামটিও নিজের করে নিতে চান ধোনি Jul 01, 2025
img
জুলাই কেবল আবেগ নয়, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের ডাক: প্রধান উপদেষ্টা Jul 01, 2025
img
শেখ হাসিনাসহ আসামিদের পক্ষে অভিযোগ গঠনের বিপক্ষে শুনানি আগামী সোমবার Jul 01, 2025
img
পাকিস্তানে ২ সপ্তাহের ব্যবধানে আবারও বাড়ল পেট্রোল ও ডিজেলের দাম Jul 01, 2025
img
আগামী বছরের শুরুতেই নির্বাচন, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে প্রধান উপদেষ্টা Jul 01, 2025
img
আরেক মেয়াদে টিটুর সঙ্গে চুক্তি নবায়ন করল বাফুফে Jul 01, 2025
img
জাতীয় দলের নতুন নির্বাচক হিসেবে শিপনকে চায় বিসিবি Jul 01, 2025
ফেসবুক পোস্টে এই দিনটি স্মরণ করলেন উমামা ফাতেমা Jul 01, 2025
img
শহীদ আবু সাঈদের মায়ের দোয়া নিয়ে এনসিপির ‘দেশ গড়তে জুলাই পদযাত্রা’ শুরু Jul 01, 2025
img
‘রামায়ণ’ এর শেষের দিনে চোখের জল আটকালেন না রণবীর! Jul 01, 2025
img
আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনাসহ ৩ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের শুনানি শুরু Jul 01, 2025
img
স্বৈরাচার পতনে যাতে ১৬ বছর অপেক্ষা করতে না হয় সেই কাজ করছি : প্রধান উপদেষ্টা Jul 01, 2025
img
আগামী ৫ দিন টানা বৃষ্টির আভাস Jul 01, 2025
img
জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করল পাকিস্তান Jul 01, 2025
img
সরকারের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় মব হয়েছে : মোশাররফ আহমেদ Jul 01, 2025
img
বরগুনায় ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ছাড়াল ৩ হাজার, হাসপাতালে ২১৭ জন ভর্তি Jul 01, 2025
img
শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করে মুক্তির স্বাদ দিয়েছে, জুলাই ক্যালেন্ডার উদ্বোধনে প্রধান উপদেষ্টা Jul 01, 2025