জোসেফ স্ট্যালিন : খলনায়ক থেকে মহানায়ক

১৯২৪ থেকে ১৯৫৩ পর্যন্ত সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সর্বোচ্চ শাসক ছিলেন জোসেফ স্ট্যালিন। তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের শিল্প বিপ্লবের নেতৃত্ব দিয়েছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী সর্বোচ্চ নেতাদের একজন তিনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ উত্তর পূর্ব ইউরোপের রাষ্ট্রগুলোকে ঐক্যবদ্ধকরণ ও স্নায়ুযুদ্ধ সূচনার অন্যতম কারক ছিলেন স্ট্যালিন।

১৮৭৮ সালের ১৮ ডিসেম্বর রাশিয়ার গোরিতে জন্মগ্রহণ করেন স্ট্যালিন। শৈশবে কেবল প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করেছিলেন। অতঃপর ধীরে ধীরে কমিউনিস্ট আদর্শে প্রভাবিত হয়ে রাশিয়ার জার বিরোধী সহিংস আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। একবার তাকে গ্রেফতার করে সাইবেরিয়ায় নির্বাসনে দেয়া হয়। তিনি সেখান থেকে পালিয়ে যান।

১৯১৭ সালে লেনিনের নেতৃত্বে সংগঠিত রুশ বিপ্লবে (বলশেভিক বিপ্লব) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন স্ট্যালিন। তিনি লেনিনের বলশেভিক দলের পত্রিকা ‘প্রাভদা’ নিয়ন্ত্রণ করতেন। লেনিনকে ফিনল্যান্ডে পালিয়ে যেতে তিনিই সহযোগিতা করেছিলেন।

রুশ বিপ্লবের পর বলশেভিকবিরোধী ও লেনিনের অনুসারীদের মধ্যে গৃহযুদ্ধ লেগে যায়। এসময় লেনিন যে পাঁচজন পলিটব্যুরো নেতা নিয়োগ দিয়েছিলেন তাদের একজন ছিলেন স্ট্যালিন।

১৯২২ সালে লেনিন অসুস্থ হয়ে পড়লে রাশিয়ায় স্ট্যালিনের প্রভাব বাড়তে থাকে। তার এ তৎপরতায় লেনিন আশঙ্কা করেছিলেন যে, স্ট্যালিন তাকে ক্ষমতা থেকে সরানোর চেষ্টা করছেন। এ নিয়ে লেনিনের সঙ্গে তার বিরোধ দেখা দিয়েছিল।

১৯২৪ সালে লেনিন মারা গেলে সোভিয়েত ইউনিয়নের ক্ষমতা চলে যায় স্ট্যালিনের হাতে। তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে অন্যান্য কমিউনিষ্ট রাষ্ট্র ও নেতাদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলেন।

রাশিয়ার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি নিয়ে আসতে তিনি প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রনয়ণ করেছিলেন। তবে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে তিনি যাকেই কাটা মনে করেছিলেন তাদের শেষ করে দিয়েছিলেন। তিনি বলশেভিক দলের আরেক নেতা লিও ট্রতস্কিকে পরাস্থ করে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বের করে দেন।

ত্রিশের দশকে তার বিরুদ্ধে ব্যাপক বিদ্রোহ দেখা দিলে তিনি সেনাসদস্য, সামাজিক ও নিজ দলের নেতাকর্মীসহ হাজার হাজার বিদ্রোহীকে গ্রেফতার করে মৃত্যুদণ্ড দেন।

ঐতিহাসিকরা বলছেন, ওই সময় ১৯৩৭ সালে প্রায় সাড়ে তিন লাখ ও ১৯৩৮ সালে তিন লাখ ত্রিশ হাজারসহ প্রায় সাত লাখ বিদ্রোহী নিহত হয়েছিল।

১৯৩৯ সালের সেপ্টেম্বরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়। এসময় স্ট্যালিন জার্মান নাৎসি বাহিনীর সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি করেন এবং পোল্যান্ড ভাগাভাগির সিদ্ধান্ত নেন। তার এ সিদ্ধান্তে বিশ্ববাসী অত্যন্ত মর্মাহত হয়। কিন্তু ১৯৪১ সালে হিটলারের নাৎসি বাহিনী রাশিয়া আক্রমণ করে বসে যা স্ট্যালিন বিশ্বাস করতে পারেন নি।

১৯৪২ সালে মস্কোর আশপাশ দখল করে নেয় নাৎসি বাহিনী। তবে স্ট্যালিন পালিয়ে না গিয়ে রাশিয়ানদের সংগঠিত করেন। তার এই অনড় অবস্থানে রাশিয়ান যোদ্ধারা অনুপ্রাণিত হয় এবং জার্মানদের বিরূদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলে। এক পর্যায়ে নাৎসি বাহিনী রাশিয়া ছাড়তে বাধ্য। তবে লাখ লাখ লোকের প্রাণহানির মধ্য দিয়ে পূর্ব ইউরোপের অনেক অঞ্চল দখল করে নিয়েছিল জার্মানরা। এরপর, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা দেখে বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে আসেন স্ট্যালিন।

১৯৪৩ সালে ইরানের তেহরানে ও ১৯৪৫ সালে ইউক্রেনের ইয়াল্টায় অনুষ্ঠিত ঐতিহাসিক সম্মেলনে উইন্সটন চার্চিল ও ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্টের সঙ্গে বৈঠক করে জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখেন তিনি।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে স্ট্যালিন মরিয়া হয়ে ওঠেন। তিনি পূর্ব ইউরোপের কমিউনিস্ট দেশগুলো নিয়ে ‘ওয়ারশো প্যাক্ট’ চুক্তির মাধ্যমে সোভিয়েত ব্লক প্রতিষ্ঠা করেন। অন্যদিকে ইউরোপে কমিউনিস্টের বিস্তার প্রতিরোধে ‘ন্যাটো’ প্রতিষ্ঠা করে আমেরিকা। ফলে সোভিয়েত রাশিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে স্নায়ুযুদ্ধ শুরু হয়েছিল, যা ১৯৯১ সালে গিয়ে শেষ হয়।

এ সময় পূর্ব ইউরোপে কমিউনিস্ট ব্লক স্ট্যালিনিজম ও টিটোইজম নামে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। যেখানে যুগোস্লাভিয়ার নেতা মার্শাল টিটোর নেতৃত্বে কমিউনিস্টদের একটি অংশ স্ট্যালিনের কর্তৃত্বের বিরোধিতা করে। তখন স্ট্যালিন কমিউনিস্ট দেশগুলো নিয়ে ‘কমেকন’ নামে অর্থনৈতিক জোট গঠন করেন। কিন্তু শাস্তিস্বরূপ এ জোটে যুগোস্লাভিয়াকে রাখেন নি তিনি।

অবশেষে ১৯৫৩ সালে স্ট্যালিনের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে সোভিয়েত রাশিয়ায় স্ট্যালিনিজমের অবসান ঘটে। স্ট্যালিন সম্পর্কে বলতে গেলে এক কথায় বলতে হয়, তিনি ছিলেন চরম ক্ষমতা পিপাসু এক নিষ্ঠুর নেতা। যার ক্ষমতার ক্ষুধা মিটাতে গিয়ে স্বজাতির লাখ লাখ লোকের প্রাণ দিতে হয়েছিল।

তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসি বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ও জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখায় খলনায়ক স্ট্যালিন হয়ে যান ইতিহাসের এক মহানায়ক।

 

টাইমস/এএইচ/জিএস

Share this news on:

সর্বশেষ

img
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নবনির্বাচিত কমিটির আত্মপ্রকাশ Jul 01, 2025
img
'ফুটবলের প্রতি যে ভালোবাসা এখনও আমার ভিতরে আছে তা আমাকে চালিয়ে নিচ্ছে' Jul 01, 2025
img
‘জুলাই বললে লাল হয়ে যায় স্মৃতি’- প্রেস সচিব শেয়ার করলেন কবিতা Jul 01, 2025
img
এবার ‘ক্যাপ্টেন কুল’ নামটিও নিজের করে নিতে চান ধোনি Jul 01, 2025
img
জুলাই কেবল আবেগ নয়, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের ডাক: প্রধান উপদেষ্টা Jul 01, 2025
img
শেখ হাসিনাসহ আসামিদের পক্ষে অভিযোগ গঠনের বিপক্ষে শুনানি আগামী সোমবার Jul 01, 2025
img
পাকিস্তানে ২ সপ্তাহের ব্যবধানে আবারও বাড়ল পেট্রোল ও ডিজেলের দাম Jul 01, 2025
img
আগামী বছরের শুরুতেই নির্বাচন, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে প্রধান উপদেষ্টা Jul 01, 2025
img
আরেক মেয়াদে টিটুর সঙ্গে চুক্তি নবায়ন করল বাফুফে Jul 01, 2025
img
জাতীয় দলের নতুন নির্বাচক হিসেবে শিপনকে চায় বিসিবি Jul 01, 2025
ফেসবুক পোস্টে এই দিনটি স্মরণ করলেন উমামা ফাতেমা Jul 01, 2025
img
শহীদ আবু সাঈদের মায়ের দোয়া নিয়ে এনসিপির ‘দেশ গড়তে জুলাই পদযাত্রা’ শুরু Jul 01, 2025
img
‘রামায়ণ’ এর শেষের দিনে চোখের জল আটকালেন না রণবীর! Jul 01, 2025
img
আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনাসহ ৩ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের শুনানি শুরু Jul 01, 2025
img
স্বৈরাচার পতনে যাতে ১৬ বছর অপেক্ষা করতে না হয় সেই কাজ করছি : প্রধান উপদেষ্টা Jul 01, 2025
img
আগামী ৫ দিন টানা বৃষ্টির আভাস Jul 01, 2025
img
জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করল পাকিস্তান Jul 01, 2025
img
সরকারের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় মব হয়েছে : মোশাররফ আহমেদ Jul 01, 2025
img
বরগুনায় ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ছাড়াল ৩ হাজার, হাসপাতালে ২১৭ জন ভর্তি Jul 01, 2025
img
শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করে মুক্তির স্বাদ দিয়েছে, জুলাই ক্যালেন্ডার উদ্বোধনে প্রধান উপদেষ্টা Jul 01, 2025