আদালতের নির্দেশ অমান্য করে বাংলাদেশে পুশব্যাক! হাইকোর্টে নুরুল ইসলামের মুক্তির আবেদন

গত ২৭ মে বিএসএফ ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত দিয়ে ১৪ জনকে বাংলাদেশে পুশব্যাক করেছিল বলে অভিযোগ। ওই দলের মধ্যে মরিগাঁও জেলার নুরুল ইসলামও ছিলেন। তার স্ত্রী নূরজাহান বেগম বৃহস্পতিবার গুয়াহাটি হাইকোর্টে মামলা করেছেন।

মামলায় নুরুল ইসলামের মুক্তির আবেদন জানানো হয়েছে। অভিযোগপত্রে বাদি নূরজাহান বেগম বলেছেন, ‘‘নুরুল ইসলাম ২০১৮ সালে একবার গ্রেপ্তার হয়েছেন এবং তারপর জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। তাকে আবার আটক করা হয়েছে এবং হাইকোর্টের আগের জামিনের ভিত্তিতে তাকে মুক্তি দেওয়া হোক।''

নুরুলের আইনজীবী সামিনুল হক জানিয়েছেন, আবেদনে বলা হয়েছে. আদালতের নির্দেশ অমান্য করে তাকে বাংলাদেশ পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। আদালত তাকে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করুক, সেই আবেদনও করা হয়েছে।

২০০৯ সালের এক মামলার ওপর ভিত্তি করে ২০১৩ সালে নুরুলকে ‘বিদেশি' ঘোষণা করেছিল ট্রাইব্যুনাল। তারপর নুরজাহান এবং তাদের তিন সন্তানকে একইভাবে ‘বিদেশি' ঘোষণা করা হয়। তবে তারা প্রত্যেকেই ভারতীয়। ভোটার তালিকায় তাদের নাম রয়েছে এবং নিয়মিত ভোট দেন। এছাড়া বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পে তাদের নাম রয়েছে, আধার কার্ডসহ ভারত সরকারের দেওয়া বিভিন্ন নথি রয়েছে। আদালতের নির্দেশ মেনে নুরুল প্রতি সপ্তাহে থানায় হাজিরাও দিতেন।
বাংলাদেশে পাঠানো নুরুলের ভাই যা বললেন

নুরুল ইসলামের ছোট ভাই রমজান আলী ডিডাব্লিউকে বলেন, ২৩ মে সীমান্ত বিভাগের পুলিশ তাদের ফোন করে থানায় ডেকে পাঠায়। পুলিশের এক ব্যক্তি তাদের বলেছিলেন, একজন উচ্চপদস্থ আধিকারিক তাদের রিপোর্ট চেয়েছেন, তাই তাড়াতাড়ি থানায় যেতে হবে।

রমজানের দাবি, “গভীর রাতে আমাদের ফোন করে ডাকা হয়। আমরা পুলিশকে বলেছিলাম পরের দিন গেলে কেমন হয়, তারা আমাদের রাতেই যেতে বলেন। সেখানে আমার ভাইয়ের নথি যাচাই করা হয় এবং ফটো তোলা হয়। হঠাৎ একজন আধিকারিক বলেন নুরুলকে রাতে থানায় থাকতে হবে, কিছু কাজ আছে। যদিও সীমান্ত বিভাগের আরেক আধিকারিক বলেছিলেন পরের দিন সকালে এলেও অসুবিধে নেই। তবে ওই আধিকারিক জোর করেই নুরুলকে থানায় রাখেন এবং আমি রাত দুটোয় আমি বাড়ি ফিরি। পরের দিন সকালে আবার থানায় যাই এবং জানতে পারি নুরুলকে গোয়ালপাড়ার ট্রানজিট ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আমরা বহুবার চেষ্টা করেও তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারিনি বা করতে দেওয়া হয়নি।”

রমজানের দাবি, গত ২৭ মে সকালে বাংলাদেশের এক অজানা নম্বর থেকে তার কাছে ফোন আসে এবং ওপারে নুরুলের গলা শুনে তিনি চমকে ওঠেন। ওপ্রান্ত থেকে নুরুল বলেন, আগের রাতে তাকে সীমান্তের ওপারে পাঠিয়ে দিয়েছে বিএসএফ এবং তার সঙ্গে আছেন আরো ১৩ জন। স্থানীয় কিছু মানুষ তাকে সাহায্য করেছেন এবং তাদের ফোন ব্যবহার করতে দিয়েছেন। তবে এর বেশি কথা হয়নি। পরের দিন ওই নম্বরে আবার ফোন করেন রমজান। রমজানের ভাষ্য অনুযায়ী, তখন অন্য এক ব্যক্তি দাবি করেন, বাংলাদেশের সীমান্ত সুরক্ষা বাহিনী তাদের (নুরুল) নিয়ে গেছে, তবে কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে, কেউ জানে না।

নুরুলের আইনজীবীর বক্তব্য
নুরুলের আইনজীবী সামিনুল হকের দাবি, এদের পরিবারের প্রত্যেককেই একতরফা বিচারে বিদেশি ঘোষণা করা হয়েছিল। সেই রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চতর আদালতে আবেদন করা হয়েছে এবং সেখানে শুনানির প্রক্রিয়া এখনো শেষ হয়নি। তিনি ডিডাব্লিউকে বলেন, “এসব ট্রাইব্যুনাল যাকে যখন ইচ্ছে বিদেশি ঘোষণা করে দেয়। নুরুল এবং তার পরিবারের লোকেরা নিজেদের নথি দেখানোর সুযোগই পাননি। মামলাটি হাইকোর্টে চলছে এবং আমরা আমাদের নথি সেখানে তুলে ধরেছি। তবে এই প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার আগেই নুরুলকে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।” নুরুলের আইনজীবী সামিনুল হকের প্রশ্ন, “আদালতের বিচার প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার আগে এমন সিদ্ধান্ত কী করে নিলো সরকার?”
আদালত যা জানতে চায়

গুয়াহাটি হাইকোর্ট বৃহস্পতিবার ভারত সরকার এবং আসাম সরকারের কাছে জানতে চেয়েছে, যাদের সন্দেহজনক বাংলাদেশি হিসেবে ধরা হয়েছে, তারা কোথায়? মরিগাঁও জেলার দুই ভাই আবু বক্কর সিদ্দিকী এবং আকবর আলীর পরিবারের দাবি, ২৫ মে তাদের আটক করেছিল পুলিশ, তারপর থেকে কোনো তাদের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না। তারা এ নিয়ে হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিলেন এবং তাদের আবেদনের ভিত্তিতেই সরকারকে এই প্রশ্ন করেছে আদালত। ৪ জুনের মধ্যে ভারত সরকার এবং আসাম সরকারকে উত্তর দিতে বলা হয়েছে।

আসাম সরকার এ নিয়ে এখনো কোনো মন্তব্য করেনি। পুলিশ এবং বিএসএফের কাছে এ বিষয়ে তথ্য চেয়েছিল ডিডাব্লিউ। তবে তারা উত্তর দেয়নি। ২৭ মে বিএসএফের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, একদল বাংলাদেশি ভারতে ঢোকার চেষ্টা করছিল এবং তাদের আটকে দেয়া হয়েছে। তবে এই ১৪ জন লোকের পরিবারের সদস্যরা ভারতের নির্বাচন কমিশনের তালিকায় ভোটদাতা হিসেবে তাদের নামসহ বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরে বিএসএফের দাবিকে ভিত্তিহীন বলেছেন।
অন্য যাদের পুশব্যাক করা হয়েছে

মরিগাঁও জেলার প্রাক্তন শিক্ষক মোহাম্মদ খাইরুল ইসলাম, দরং জেলার মানিকজান বেগম, ধুবড়ির গৌরীপুর এলাকার মরম আলী, বরপেটার সাবিনা বেগম ও সোনাবানু বেগমের পরিবারের সদস্যরা তাদের বিষয়ে কিছু তথ্য সামাজিক মাধ্যম এবং সংবাদ মাধ্যমে তুলে ধরেছেন। তারা আদালতেও বিষয়টি জানিয়েছেন। পরিবারের সদস্যদের দাবি, পুশব্যাক হওয়ার পর ২৭ মে তারা বাংলাদেশ থেকে যোগাযোগ করেছিলেন, তবে এরপর থেকে আর কোনো খবর পাওয়া যায়নি।
‘এখন তারা যুক্তরাষ্ট্রের পথে হাঁটছেন'

বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন সরকারের সমালোচনা করেছে। সমাজসেবী আমান ওয়াদুদ বলেন, ২০২০ সালে ভারতের সর্বোচ্চ আদালত একটি নির্দেশে বলেছিল, ট্রাইবুনাল যাদের ‘বিদেশি' বলে শনাক্ত করেছে তাদের দু'বছরের বেশি ডিটেনশন ক্যাম্পে রাখা যাবে না এবং একবার জামিনে মুক্তি পাওয়ার পর আবার আটক করা যাবে না।

আমান বলেন, “যুক্তরাষ্ট্র থেকে যখন ভারতীয়দের জোর করে পুশব্যাক করা হচ্ছিল, আমাদের বিদেশ(পররাষ্ট্র) মন্ত্রী এস জয়শঙ্কর বলেছিলেন, এভাবে নথি যাচাই না করে সন্দেহের ভিত্তিতে কাউকে বের করে দেওয়া অমানবিক। তবে এখন তারা যুক্তরাষ্ট্রের পথেই হাঁটছেন। যাদের সীমান্তের ওপারে ঠেলে দেওয়া হয়েছে, এরা প্রত্যেকেই ভারতের বাসিন্দা। তাদের বিরুদ্ধে একতরফা রায়ে বিচার হয়েছে কারণ অনেকেরই আইনজীবীর সাহায্য নেওয়ার মতো আর্থিক ক্ষমতা ছিল না। কেউ কেউ জানতেই পারেননি তাদের বিরুদ্ধে মামলা চলছে।”

শ্বেতপত্র প্রকাশের দাবি
আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য এবং মানবাধিকার কর্মী, তপোধীর ভট্টাচার্য এই বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে শ্বেতপত্র প্রকাশের দাবি জানিয়েছেন। তিনি শুক্রবার ডিডাব্লিউকে বলেন, “একটা রাষ্ট্র নৈরাজ্য দিয়ে চলতে পারে না। যাদের বিরুদ্ধে এই ধরপাকড় চলছে, প্রত্যেকেই এক বিশেষ সম্প্রদায়ের লোক। এদের বিরুদ্ধে আগেই এদেশে বিশ্ববাষ্প ছড়ানোর কাজ শুরু হয়েছে। এই ধরপাকড় এবং সীমান্তের ওপরে ঠেলে দেওয়া সেই বিদ্বেষের অংশ নয় তো? তাই আমরা সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি, গোটা প্রক্রিয়া নিয়ে শ্বেতপত্র প্রকাশ করুন। গণতান্ত্রিক দেশে জনগণের জানার অধিকার রয়েছে সরকার কি করছে এমন কেন করছে।”

তবে তাদের পরিবারের সদস্যদের দাবি, তারা কেউ বাংলাদেশি নন, বরং আসামের বাসিন্দা, যাদের বিভিন্ন সময়ে একতরফা বিচারে ‘বিদেশি' ঘোষণা করেছিল ট্রাইবুনাল আদালত। তাদের নামে ভারতের ভোটার-কার্ড সহ অন্যান্য নথি রয়েছে।
তবে বিজেপি-র নেতারা বলছেন, ভোটার কার্ড থেকে শুরু করে সব কার্ডই পয়সা দিয়ে করা যায়- এ কথা তারা দীর্ঘদিন ধরে বলছেন, পশ্চিমবঙ্গে পয়সা দিয়ে এই কার্ড সহজেই পাওয়া যায়। ফলে ভোটার বা আধার কার্ডের ভিত্তিতে ভারতীয় কিনা তা ঠিক করা যায় না।

এই পরিস্থিতিতিতে আদালত কী বলে তার দিকেই তাকিয়ে আছে এই পরিবারগুলো।

সূত্র- ডয়চে ভেলে 

Share this news on:

সর্বশেষ

img
‘কৌন বনেগা ক্রোড়পতি’ শো এর মাধ্যমে সবচেয়ে দামি সঞ্চালক হতে যাচ্ছেন অমিতাভ বচ্চন! Jul 19, 2025
img
কুমিল্লার মুরাদনগরে জনসভা করার ঘোষণা দিলেন ইশরাক Jul 19, 2025
img
অবসর ভেঙে আবারও ফিরেছেন ব্রাজিলের কিংবদন্তি ফুটবলার! Jul 19, 2025
img
সৈকতে কারিনার ‘লুঙ্গি ড্যান্স’, নেটদুনিয়ায় ঝড়! Jul 19, 2025
img
জামায়াতের সমাবেশ ঘিরে নিরাপত্তায় ১২ হাজার পুলিশ, রয়েছে র‍্যাব-ডিবিও Jul 19, 2025
img
বাসা থেকে অভিনেত্রীর মরদেহ উদ্ধার Jul 19, 2025
img
গায়ানার কাছে হেরে টানা দ্বিতীয়বার চ্যাম্পিয়ন হওয়ার স্বপ্ন ভঙ্গ হলো রংপুর রাইডার্সের Jul 19, 2025
img
ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের বিরুদ্ধে ১০ বিলিয়ন ডলারের মানহানির মামলা ট্রাম্পের Jul 19, 2025
img
নির্বাচনের জন্য আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ : আব্দুন নূর তুষার Jul 19, 2025
img
মুক্তির এক বছর আগেই শুরু নোলানের 'দ্য ওডিসি'র টিকিট বিক্রি! Jul 19, 2025
img
ঢাকায় সমাবেশে আসার পথে সড়কে প্রাণ গেল জামায়াত নেতার Jul 19, 2025
img
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দিয়ে জাতীয় সমাবেশের প্রথম পর্ব শুরু করল জামায়াত Jul 19, 2025
img
১৭ বছরের পুরোনো বাটন ফোনই সঙ্গী অভিনেতা ফাহাদের, পেছনে রয়েছে চমকপ্রদ কারণ! Jul 19, 2025
img
সপ্তাহ শেষে রাজকুমারের ‘মালিক’ সিনেমার আয় কত? Jul 19, 2025
img
১৩ বছর বয়সে মিনা পাল থেকে অভিনেত্রী ‘কবরী’ হয়ে উঠার গল্প! Jul 19, 2025
img
যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশ প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে বিস্ফোরণ, প্রাণ গেল ৩ পুলিশ কর্মকর্তার Jul 19, 2025
img
সোহরাওয়ার্দীতে নেত্রকোণার ১০ হাজার নেতাকর্মীর মিছিল Jul 19, 2025
img
পটুয়াখালীতে যুবলীগের ৬ নেতা গ্রেফতার Jul 19, 2025
img
গোপালগঞ্জে ১৫০০-র বেশি আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা Jul 19, 2025
img
হাসপাতাল থেকে বাড়ি নয়, সন্তান-স্ত্রীকে নিয়ে কোথায় গেলেন সিদ্ধার্থ? Jul 19, 2025