একের পর এক সিরিজ জিতলেও হেড কোচ চন্দিকা হাথুরুসিংহের মন জয় করতে পারছিলেন না অধিনায়ক তামিম ইকবাল। ওয়ানডেতে তার নেতৃত্বে বাংলাদেশ ৮টি সিরিজের ৬টি জিতলেও গুরু-শিষ্যের সম্পর্কে তা শান্তির সাদা পতাকা ওড়াতে পারেনি।
বরং তার প্রতি শ্রীলঙ্কান কোচের বৈরী মনোভাবই এই ওপেনারকে অবসরের সিদ্ধান্তের দিকে ঠেলে দিয়েছিল। এমনই মনে হয়েছে ২০২৩ ওয়ানডে বিশ্বকাপের ব্যর্থতা পর্যালোচনায় বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) গঠন করা কমিটির সদস্যদের।
তিন সদস্যের সেই কমিটিই আবার দলের ভেতরের খবর বাইরে ফাঁস করার জন্য অভিযুক্ত করেছে তামিমকে। সেটিও নাকি তিনি করেছিলেন হাথুরুসিংকে বরখাস্তের পথ প্রশস্ত করতে!
তামিম অবশ্য ভারতে অনুষ্ঠিত সেই বিশ্ব আসরের দলে ছিলেন না। দল দেশ ছাড়ার আগে নানা নাটকীয় ঘটনাপ্রবাহে তিনি নিজেই সরে দাঁড়ান।
সাকিব আল হাসানের নেতৃত্বে বিশ্বকাপে যাওয়া বাংলাদেশ চেন্নাইতে নিজেদের তৃতীয় ম্যাচ খেলতে নামে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে।
সেই ম্যাচেরই একটি ঘটনা তামিম মিডিয়ায় ফাঁস করেছেন বলে লেখা হয়েছে তদন্ত প্রতিবেদনে। নাজমুল হাসানের নেতৃত্বাধীন বোর্ডের পরিচালক এনায়েত হোসেন সিরাজকে প্রধান করে গঠিত কমিটির অন্য দুই সদস্য ছিলেন মাহবুব আনাম এবং আকরাম খান।
তারা কোচ, খেলোয়াড় এবং সংশ্লিষ্ট অনেকের সঙ্গে কথা বলে তৈরি করেন নিজেদের প্রতিবেদন। দলের ব্যর্থতার পাশাপাশি তারা খতিয়ে দেখেন চেন্নাইতে হাথুরুসিংহের বিরুদ্ধে নাসুম আহমেদের গায়ে হাত তোলার অভিযোগও।
তবে নিজের চোখে ঘটনাটি দেখা তখনকার স্ট্রেন্থ অ্যান্ড কন্ডিশনিং কোচ নিকোলাস লি এবং ভুক্তভোগী নাসুমের বক্তব্য শোনার পরও তদন্ত কমিটি একরকম দায়মুক্তি দেয় সাবেক হেড কোচকে।
ফারুক আহমেদ বিসিবির সভাপতি হয়ে আসার পর সেই তদন্ত প্রতিবেদনের সূত্র ধরে আবার তদন্তে নামেন। যা শেষ পর্যন্ত হাথুরুসিংহের চাকরিচ্যুতির দিকে মোড় নেয়। কিন্তু ফারুককে সরিয়ে দেওয়ার পর মাহবুব দাবি করেন, তাদের তদন্তে নাসুমের গায়ে হাত তোলার অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি। তবে সম্প্রতি সেই তদন্ত প্রতিবেদন গণমাধ্যমের হাতে আসে।
তাতে সাক্ষী ও ভুক্তভোগীর বক্তব্যকে তেমন গুরুত্ব না দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়। তদন্ত প্রতিবেদনে এই ঘটনাই সংবাদমাধ্যমে ফাঁস করে দেওয়ার অভিযোগ আনা হয়েছে তামিমের বিরুদ্ধে।
অবশ্য তিনি একা অভিযুক্ত নন। তার সঙ্গে মিডিয়ায় নাসুমকে হাথুরুসিংহের মারার ঘটনা ফেরি করার অভিযোগ আনা হয়েছে বিসিবির ক্রিকেট অপারেশন্স কমিটির তখনকার প্রধান জালাল ইউনুসের বিরুদ্ধেও।
তারা দুজনই হাথুরুসিংহেকে বরখাস্তের পথ তৈরি করতে তথ্য ফাঁস করেছেন বলে লেখা হয়েছে তদন্ত প্রতিবেদনে, ‘তাকে ‘থাপ্পড়’ মারার অভিযোগের বিষয়ে নাসুমকে ফোন করেছিলেন ক্রিকেট অপারেশন্সের চেয়ারম্যান এবং তামিম ইকবাল। মিডিয়াতে খবরটি তারাই ফাঁস করেছেন।
তারা এমন একটি প্রেক্ষাপট তৈরি করতে চেয়েছেন, যাতে হেড কোচের চাকরি যায়"
একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে তামিমের অবসরের সিদ্ধান্তে হাতুরাসিংহের প্রভাবের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে তদন্ত প্রতিবেদনে, ‘তামিমের নেতৃত্বে ৮ সিরিজের ৬টিতেই জেতে বাংলাদেশ। এত সাফল্যের পরও তার প্রতি হেড কোচের আচরণের কারণে মানসিক অবসাদে ছিল সে। গত ৭-৮ মাসে হেড কোচের কাছ থেকে কোনো রকম সহযোগিতাই সে পায়নি। তবু নেতিবাচকতা এক পাশে সরিয়ে রাখার চেষ্টা করেছিল সে।
কিন্তু নিজেকে বিচ্ছিন্ন মনে হচ্ছিল তার। নেতৃত্বের মেয়াদে বোর্ডের কাছ থেকেও সে সমর্থন পায়নি। চরম মানসিক চাপই ওকে (আন্তর্জাতিক) ক্রিকেট থেকে অবসরে যেতে বাধ্য করেছে।’ একই তদন্ত কমিটি তাকে নাসুমের ঘটনা ফাঁসের জন্য যে ভাষায় অভিযুক্ত করেছে, তাতে মনে হওয়া স্বাভাবিক হাথুরুসিংহের সঙ্গে পূর্বশত্রুতার জেরও টানতে চেয়েছেন বাংলাদেশ দলের সাবেক অধিনায়ক।
তবে নাসুমের ঘটনাই শুধু নয়, দলের আরো তথ্য ফাঁস করার জন্য নামোল্লেখ না করেও সন্দেহভাজন চিহ্নিত করা হয়েছে তদন্ত প্রতিবেদনে। এই যেমন সেখানে লেখা হয়েছে, ‘দলের গোপনীয় তথ্য ফাঁস হয়েছে। দলসংশ্লিষ্ট যেকোনো খবরই মিডিয়ায় চলে যাওয়াটা ক্ষতিকর। টিম ডিরেক্টরের টিম মিটিংয়ে থাকার কোনো দরকারই নেই।’ ২০২৩ সালের ওয়ানডে বিশ্বকাপে বাংলাদেশের টিম ডিরেক্টর কে ছিলেন, সেটি তো সবারই জানা।
তিনি বাংলাদেশ দলের আরেক সাবেক অধিনায়ক ও বিসিবি পরিচালক খালেদ মাহমুদ। তথ্য ফাঁস রোধে কিছু কিছু নিয়োগের বিষয়েও সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে প্রতিবেদনে, ‘দলের সহকারী বা টিম বয় নিয়োগের আগে সাবধানতার প্রয়োজন। গোপনীয় তথ্য তারাও ফাঁস করে থাকতে পারেন।’
আরএম/এসএন