‘অপারেশন মিডনাইট হ্যামার’ নামে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় চালানো যুক্তরাষ্ট্রের অভিযানের বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরেছেন দেশটির জয়েন্ট চিফস অব স্টাফের চেয়ারম্যান জেনারেল ড্যান কেইন।
রোববার (২২ জুন) মার্কিন প্রতিরক্ষা সদরদপ্তর পেন্টাগনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছেন, ইরানে মার্কিন হামলা ছিল পরিকল্পিত এবং সেনাবাহিনীর বিভিন্ন পক্ষ এই হামলা পরিকল্পনা নিখুঁতভাবে বাস্তবায়ন করেছে।
জেনারেল কেইন বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় সময় শুক্রবার রাত থেকে শনিবার সকালের মধ্যে এই অভিযান বাস্তবায়ন করা হয়। শত্রুপক্ষকে বিভ্রান্ত করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র থেকে যাত্রা শুরু করা বি-২ স্টিলথ বোমারু বিমানের একটি বহর পশ্চিম দিকে গিয়েছিল। আর বাকি বিমান নীরবে পূর্ব দিকে এগিয়ে যায়। ১৮ ঘণ্টার ফ্লাইট চালিয়ে ইরানে ঢুকে পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে কোনও ধরনের প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই হামলা চালায় এসব বিমান।
তিনি বলেন, যুদ্ধবিমান আঘাত হানার আগে একটি মার্কিন সাবমেরিন থেকে ইরানের ইসফাহান পারমাণবিক স্থাপনার ভূপৃষ্ঠে অবস্থিত অবকাঠামো লক্ষ্য করে দুই ডজনেরও বেশি টমাহক ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করা হয়।
জেনারেল কেইন বলেন, বি-২ স্টিলথ বিমানগুলো ইরানের আকাশসীমায় প্রবেশের সময় মার্কিন বাহিনী বিভিন্ন ধরনের বিভ্রান্তিকর পদক্ষেপ নেয়।
এর মধ্যে ছিল ভুয়া বিমানের ব্যবহার। চতুর্থ ও পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধবিমানগুলো প্রথমে আকাশপথে সামনে এগিয়ে ইরানের যুদ্ধবিমান ও ভূমি থেকে উৎক্ষেপণযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার মুখোমুখি হয়।
তিনি বলেন, নাতাঞ্জ ও ফোরদো পারমাণবিক স্থাপনায় পৌঁছানোর আগে মার্কিন বাহিনী উচ্চগতির প্রতিরোধ বিমান ও যুদ্ধবিমান ব্যবহার করে ইরানের আকাশে বি-২ বোমারু বিমানের নিরাপদ প্রবেশ নিশ্চিত করে।
এরপর এই অভিযানে নেতৃত্বে থাকা প্রধান বি-২ বোমারু বিমান থেকে ইরানের ফোরদো পারমাণবিক স্থাপনায় দুটি বিশাল আকারের ‘বাঙ্কার-বাস্টার’ বোমা নিক্ষেপ করা হয়। এরপর অন্যান্য বি-২ বিমান তাদের নির্ধারিত লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানে।
ইরানের অতিরিক্ত লক্ষ্যবস্তুগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর এই হামলা চালানো হয় আমেরিকার পূর্বাঞ্চলীয় স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৬টা ৪০ থেকে ৭টা ৫ মিনিটের মধ্যে। ইরানের স্থানীয় সময় অনুযায়ী এসব হামলা হয় রোববার রাত ২টা ১০ মিনিটের দিকে।
কেইন বলেন, অভিযানে বাঙ্কার বিধ্বংসী মোট ১৬টি জেবিইউ-৫৭ ম্যাসিভ অর্ডন্যান্স পেনিট্রেটর বোমা ব্যবহার করা হয়। তিনি বলেন, মিশন শেষে যুক্তরাষ্ট্রের বিমানগুলো দেশে ফিরে আসে এবং আসা-যাওয়ার পথে ইরানের পক্ষ থেকে কোনো গুলি বা প্রতিরোধের মুখে পড়েনি।
>> হামলায় ধ্বংস ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি
মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথ বলেছেন, শনিবার রাতের হামলা পরিকল্পিতভাবে ইরানের পারমাণবিক সক্ষমতা ‘দুর্বল’ এবং ‘ধ্বংস’ করার জন্য চালানো হয়েছিল। তিনি বলেন, এই হামলায় ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ‘ধ্বংস’ হয়েছে। তবে সামরিক বা বেসামরিক লোক হতাহত হয়নি।
হেগসেথ বলেন, বহু প্রেসিডেন্টই ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিতে চূড়ান্ত আঘাত হানার স্বপ্ন দেখেছেন। কিন্তু ট্রাম্প ছাড়া কেউই তা বাস্তবায়ন করতে পারেননি।
যে কারণে এই অভিযানকে সাহসী ও দুর্দান্ত বলেও আখ্যা দেন মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী। তিনি বলেন, যখন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কথা বলেন, তখন বিশ্বের তা শোনা উচিত। যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া আর কোনও দেশই এই ধরনের অভিযান চালাতে পারতো না।
>> হামলার সিদ্ধান্ত কখন নেন ট্রাম্প?
পেন্টাগনে সংবাদ সম্মেলনে মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী হেগসেথের কাছে সাংবাদিকরা জানতে চান, ডোনাল্ড ট্রাম্প ঠিক কবে বা কখন ইরানে হামলার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন? জবাবে হেগসেথ বলেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সম্পূর্ণভাবে শান্তিপূর্ণ সমাধানের পক্ষে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলেন এবং তিনি আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের কথা বলেছিলেন।
তিনি বলেন, যে কারণে তিনি ইরানকে সব ধরনের সুযোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু জবাবে ইরান কেবলমাত্র ঠুনকো অজুহাতই দিয়েছিল। ট্রাম্পের কোনও নির্দিষ্ট মুহূর্ত ছিল না। কিন্তু এমন একটা সময় সামনে আসলো, যখন তিনি অনুভব করলেন হুমকি বন্ধে এখনই ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।
এর আগে গত বৃহস্পতিবার হোয়াইট হাউস জানিয়েছিল, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইরান-ইসরায়েল সংঘাতে যুক্তরাষ্ট্র জড়াবে কি-না, সেই সিদ্ধান্ত নেবেন দুই সপ্তাহের মধ্যে।
>> ইরানের সরকার পরিবর্তন মিশনের লক্ষ্য নয়
ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলার লক্ষ্য দেশটির সরকারের পরিবর্তন নয় বলে জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিটার হেগসেথ। তিনি বলেছেন, ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের হুমকি নির্মূল করাই ছিল এই মিশনের লক্ষ্য।
ইরানের বর্তমান সরকার পরিবর্তন যুক্তরাষ্ট্রের নীতিগত লক্ষ্য কি না—সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে হেগসেথ বলেন, এই মিশন সে জন্য ছিল না। ইরানের সরকার পরিবর্তনের জন্য নয়। তিনি বলেন, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি থেকে আমাদের জাতীয় স্বার্থের ওপর আসা হুমকি ঠেকানোই ছিল হামলার লক্ষ্য।
সূত্র: সিএনএন, আল জাজিরা।
আরএম/টিকে