বিজ্ঞানীদের হত্যা করে কর্মসূচি থামানো যাবে না: বিশ্লেষক

ইসরায়েলের সাম্প্রতিক হামলায় ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির অন্তত ১৪ জন শীর্ষ বিজ্ঞানী নিহত হয়েছেন। এটি শুধু নজিরবিহীন হামলাই নয়, বরং ইরানের পারমাণবিক সক্ষমতার পেছনের মস্তিষ্কগুলোকে একসঙ্গে সরিয়ে দেওয়ার এক বিস্ময়কর উদ্যোগ। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, এতে কিছুটা বিলম্ব ঘটলেও ইরানের পারমাণবিক জ্ঞান বা কর্মসূচি সম্পূর্ণ থেমে যাবে না।

ইসরায়েলের ফ্রান্সে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত যোশুয়া জারকা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, এই বিজ্ঞানীদের হত্যার ফলে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি “একাধিক বছর পেছনে” চলে গেছে। তার ভাষায়, “এই পুরো দলটি এখন আর নেই, এটি কার্যত কয়েক বছরের পিছিয়ে দেওয়া।”

তবে ইউরোপীয় রাষ্ট্রদূত ও পারমাণবিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, কেবলমাত্র সামরিক হামলার মাধ্যমে ইরানের পারমাণবিক জ্ঞান ধ্বংস করা সম্ভব নয়। যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড ল্যামি পার্লামেন্টে বলেন, “হামলা কখনোই ইরানের কয়েক দশকের অর্জিত পারমাণবিক জ্ঞান বা সেই জ্ঞানকে অস্ত্র তৈরিতে ব্যবহারের আকাঙ্ক্ষা নির্মূল করতে পারবে না।”

ইরান বরাবরই দাবি করে আসছে, তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মতে, ইরান বর্তমানে পারমাণবিক বোমা তৈরির পথে সক্রিয় নয়। তবে ইসরায়েলের দাবি, ইরান চাইলে দ্রুতই বোমা তৈরি করতে সক্ষম।

কে ছিলেন নিহত বিজ্ঞানীরা
রাষ্ট্রদূত জারকা জানান, নিহতদের মধ্যে ছিলেন পদার্থবিজ্ঞানী, কেমিস্ট ও পরমাণু প্রকৌশলীরা। ১৩ জুন ইসরায়েলের প্রথম দফা হামলায় নয়জন বিজ্ঞানী নিহত হন বলে জানায় সেনাবাহিনী। এরা কেউ কেউ বিস্ফোরক, উপকরণ ও পারমাণবিক অস্ত্র তৈরিতে বিশেষজ্ঞ ছিলেন।

মঙ্গলবার ইরানি রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন জানায়, মোহাম্মদ রেজা সেদিঘি সাবের নামের আরেক বিজ্ঞানী নিহত হয়েছেন, যিনি আগের এক হামলায় প্রাণে বেঁচে গেলেও তার ১৭ বছর বয়সী ছেলে নিহত হন।

কেন এই হত্যাকাণ্ড
বিশেষজ্ঞদের মতে, ইরানের মতো দেশে যেখানে বহু বছর ধরে পরমাণু গবেষণা চলে আসছে, সেখানে বিকল্প বিজ্ঞানীর অভাব নেই। ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের বিশ্লেষক মার্ক ফিটজপ্যাট্রিক বলেন, “ব্লুপ্রিন্ট থাকবেই, এবং পরবর্তী প্রজন্মের পিএইচডি শিক্ষার্থীরা ঠিকই কাজ বুঝে যাবে।”

তবে এই হত্যাকাণ্ড নতুনদের মধ্যে ভয় তৈরির কৌশল হিসেবেও কাজ করতে পারে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। “সম্ভবত এটাই লক্ষ্য ছিল—যাতে ভবিষ্যতের কেউ এই কর্মসূচিতে যোগ দিতে ভয় পায়,” বলেন জেনেভাভিত্তিক বিশ্লেষক পাভেল পোদভিগ।

নতুন এক আইনি বিতর্ক

আন্তর্জাতিক মানবিক আইন অনুসারে, বেসামরিক নাগরিক ও অসামরিক ব্যক্তিদের হত্যায় নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তবে কেউ যদি সরাসরি সামরিক কার্যক্রমে যুক্ত থাকে, তাহলে সে নিয়ম প্রযোজ্য নাও হতে পারে।
জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক স্টিভেন আর. ডেভিড মনে করেন, “এই বিজ্ঞানীরা এমন একটি রাষ্ট্রের হয়ে কাজ করছিলেন যারা নিয়মিত ইসরায়েল ধ্বংসের হুমকি দেয়। সেক্ষেত্রে তারা আইনগতভাবেই বৈধ
লক্ষ্যবস্তু।”

এমোরি ল স্কুলের অধ্যাপক লরি ব্ল্যাঙ্ক বলেন, “আমরা বাইরে থেকে এখনই নিশ্চিত করে বলতে পারি না যে এই হত্যাকাণ্ড আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় পড়ে কি না।”

ইতিহাসেও আছে এমন নজির
এর আগেও ইরানের বিজ্ঞানীদের হত্যার জন্য ইসরায়েলকে সন্দেহ করা হয়েছে। ২০২০ সালে ইরানের শীর্ষ বিজ্ঞানী মোহসেন ফখরিজাদেকে রিমোট-কন্ট্রোল মেশিনগান দিয়ে হত্যার জন্য ইসরায়েলকে দায়ী করে তেহরান। তবে এবারই প্রথম ইসরায়েল সরাসরি এমন হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করল।

রাষ্ট্রদূত জারকা বলেন, “যদি এসব ঘটনা না ঘটত, তাহলে ইরান অনেক আগেই পারমাণবিক বোমা তৈরি করে ফেলত।”

ইসরায়েলের সাম্প্রতিক এই হত্যাকাণ্ড কেবল পারমাণবিক কর্মসূচিকে সাময়িক পেছনে ঠেলে দিতে পারে, থামাতে নয়। বরং এতে নতুন এক আইনি, কূটনৈতিক ও মানবিক বিতর্কের সূচনা হয়েছে। ইরান যেমন এখনও প্রকাশ্যে যুদ্ধঘোষণা করেনি, তেমনি ইসরায়েলেরও এই পদক্ষেপ বিশ্বরাজনীতিতে বড় একটি বার্তা দিয়ে রাখল পারমাণবিক ক্ষমতা নিয়ে হুমকির মুখে কেউই এখন নিরাপদ নয়।

এফপি/ টিকে

Share this news on:

সর্বশেষ

img
রাষ্ট্রপতির সুনাম অর্জন করল আমিরের নতুন সিনেমা ‘সিতারে জমিন পার’ Jun 25, 2025
img
মামিথা বাজুর মন্তব্যে নতুন বিতর্কে বিজয়ের রাজনৈতিক যাত্রা Jun 25, 2025
img
জেনে নিন গুগল ওয়ালেট ও গুগল পে-এর মধ্যে পার্থক্য Jun 25, 2025
img
সিনেমার সেটে অশালীন আচরণের অভিযোগ এষা গুপ্তের! Jun 25, 2025
img
এক ব্যক্তি ১০ বছরের বেশি প্রধানমন্ত্রী না থাকার প্রস্তাবে একমত বিএনপি! Jun 25, 2025
বাস্তবেও ‘অঞ্জলি’র মতো মায়ের ভূমিকায় কাজল Jun 25, 2025
img
এনবিআরে চলমান অযৌক্তিক আন্দোলনে কিছু ব্যবসায়ীদের ইন্ধন থাকতে পারে: সালেহ উদ্দিন আহমেদ Jun 25, 2025
img
সাকিবকে ছাড়িয়ে রেকর্ডের শীর্ষে মুমিনুল Jun 25, 2025
img
আওয়ামী ফ্যাসিবাদে সব ধরনের নাগরিক স্বাধীনতাকে হরণ করা হয়েছিল: তারেক রহমান Jun 25, 2025
img
প্রেমের পর্দায় নতুন অধ্যায়, ধনুশের সঙ্গে জুটি বাঁধলেন কৃতী Jun 25, 2025
নিউইয়র্কে মেয়র হতে যাচ্ছেন জোহরান মামদানি Jun 25, 2025
সাধারণ মানুষের মাঝে দেখা গেল ইরানি জেনারেল Jun 25, 2025
img
তামান্নার পর ফাতিমা? বিজয় ভার্মার নতুন প্রেম না কি শুধুই প্রচার! Jun 25, 2025
img
উপদেষ্টা আসিফকে ক্ষমা চাইতে হবে: ইশরাক হোসেন Jun 25, 2025
img
আমি নির্দোষ, কোনো অপরাধ করিনি: পলক Jun 25, 2025
img
'বর্তমান নির্বাচন কমিশনেই জামায়াত আস্থা রাখতে চায়' Jun 25, 2025
img
‘রুসলান’ ছবির লড়াই দৃশ্যে চোট, অবহেলায় বড় অস্ত্রোপচার আয়ুষ শর্মার Jun 25, 2025
img
গ্রেফতার আদেশের পরও আদালত প্রাঙ্গণে হাস্যোজ্জ্বল ইনু Jun 25, 2025
img
আইএইএ’র সঙ্গে সহযোগিতা বাতিলে ইরানি পার্লামেন্টের সম্মতি Jun 25, 2025
img
কূটনীতি শুধু পুরুষের জন্য নয়: ব্রিটিশ হাইকমিশনার Jun 25, 2025