রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সাংবাদিক জিল্লুর রহমান বলেছেন, এদেশে ক্ষমতা বদলায় কিন্তু অপরাধের চরিত্রটা বদলায় না। বরং অপরাধীরা ক্ষমতার পরিবর্তনে নিজেদের রাজনৈতিক পরিচয় বদলায়। প্রয়োজন হলে দলের নাম বদলায়, মতবাদ বদলায়। কিন্তু যা বদলায় না তা হলো চাঁদাবাজির সংস্কৃতি, সহিংসতা এবং শাস্তিহীনতার আত্মবিশ্বাস।
সম্প্রতি ইউটিউবের এক ভিডিও বার্তায় এসব কথা বলেন তিনি।
জিল্লুর রহমান বলেন, এই দেশে ব্যবসা করতে গেলে রাজনৈতিক ছত্রছায়া লাগে। চাঁদা দিতে হয়। এলাকা ভাগাভাগি করতে হয়।
আমরা সবাই সেটা জানি। সোহাগ তার ব্যবসা বাড়াচ্ছিল কিন্তু সোজা পথে সিন্ডিকেটকে পাত্তা না দিয়ে। তাই প্রতিপক্ষ ক্ষিপ্ত হয়। হুমকি দেয়।
গোদাম তালাবদ্ধ করে টাকা দাবি করে। টাকা না দিলে প্রাণ যাবে। এটাই ছিল হিসাব। সোহাগ টাকা দেয়নি। এবং সেই হিসাবই তার প্রাণ নিয়ে নিল।
তিনি বলেন, আমরা লক্ষ্য করছি, যেখানে আলো সেখানে যেন এখন ভয়। ঢাকা শহরের ঠিক বুকের ভেতরে পুরনো ঢাকা। আমার একটা বিশেষ আবেগ রয়েছে যে পুরনো ঢাকা আমার নিজের জন্ম। যেটা ইতিহাস সংস্কৃতি আর বর্ণীল জীবনের অতিছবি হবার কথা ছিল। সেই পুরনো ঢাকাই এখন এক নৃশংস বাস্তবতার নাম হয়ে উঠেছে সোহাগ নামের একজন ভাঙ্গারী ব্যবসায়ী যিনি লাল চাঁদ নামে পরিচিত ছিলেন। তাকে মিডফোর্ড হাসপাতালের গেটের সামনে প্রকাশ্যে দিনের আলোয় অসংখ্য মানুষের সামনে কংক্রিটের পাথর দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। ওই যে পুরনো ঢাকায় আমার জন্মের কথা বললাম, আরো বিশেষ করে বললে, ওই মিটফোর্ড হসপিটালেই আমার নিজের জন্ম। ভাবতেও কষ্ট হয়। সেই আমাদের শৈশবের কৈশরের ছিমছাম পুরনো শহর পুরনো ঢাকায় এই ধরনের ঘটনা ঘটছে। এই বরবরতা শুধু তার মৃত্যুই নয়, সোহাগের মৃত্যুই নয়, আমাদের সামষ্টিক বিবেকের মৃত্যুও কিনা এই প্রশ্ন আজ উঠেছে। সোহাগের স্ত্রী লাথি আক্তারের প্রশ্ন ছিল, একজন মানুষকে এত নৃশংসভাবে কিভাবে হত্যা করতে পারে? গলায় কাপন, চোখে আতঙ্ক আর ঠোটের কোণে অসহায় খোপ। তিনি শুধু ফাঁসি চান না। লাকি চান, এই বর্বরতা আর কোনো সন্তানের বাবার জীবনে না আসুক।
তিনি আরো বলেন, ঘটনার বিবরণ শোনাই যেন অসহনীয়। সোহাগকে টেনে হিঁচড়ে বের করে আনা হয় দোকান থেকে। তারপর ধারালো অস্ত্র এবং লোহার রড দিয়ে এলোপাতাড়ি পেটানো হয়। আশপাশের মানুষ চেয়ে চেয়ে দেখে। কেউ কেউ ভিডিও করে এবং সেই ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়াতে আমরা ভাইরাল হতে দেখি। কতটা অমানবিক একটা সমাজ রাষ্ট্র একটা দেশের মানুষ হলে এই ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে! এটা নতুন নয়, প্রথম নয়। এর আগেও এটা ঘটেছে। সোহাব মারা যাচ্ছে। কিন্তু কেউ উঠে এগিয়ে যাচ্ছে না। পরে তাকে মিডফোর্ড হাসপাতালের গেটের সামনে নিয়ে যাওয়া হয়। যেখানে তার শরীরের উপর একের পর এক কংক্রিটের ব্লক ফেলা হয় আর মাথা থেতলে মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়। তার গায়ে থাকা জামা কাপড় খুলে ফেলা হয়। আর তারপর সেই বিবস্ত্র নিথর দেহের উপর দাঁড়িয়ে আনন্দ উল্লাস করে খুনিরা। এই উল্লাসের চিত্র আমরা কিন্তু এর আগেও দেখেছি।
তিনি বলেন, মনে আছে, সেই বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সময় যখন আওয়ামী লীগ আন্দোলন করছে সে আন্দোলনের সময় এরকম মানুষ মেরে লাশের উপরে দাঁড়িয়ে উল্লাস দেখেছে। পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি। সোহাগের মৃত্যুর এই ঘটনা আমাদেরকে সেটাই মনে করিয়ে দেয়, মানবিকতার লেশ মাত্র আমাদের মধ্যে নেই। আমরা শুধু খবর করিনি, সেই ফুটেজও দেখেছি। যেটা আমি বলছিলাম যে, মানুষ ভিডিও করছে কিন্তু মানুষটাকে বাঁচাবার চেষ্টা করছে না।
জিল্লুর রহমান বলেন, এটা কি সেই শহর যেখানে একসময় ছাত্ররা রাস্তায় নেমে বলেছিল, অন্যায়, অন্যায়? এটা কি সেই শহর যেখানে এক বছর আগে গুলির মুখে দাঁড়িয়ে মানুষ বলেছিল, স্বৈরাচার পতন চাই। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সেই মানুষেরা আজ কোথায়? কেন তারা তখন প্রতিবাদ করতে পারে? কিন্তু এখন একজনের উপর পাথরের ঘায়ে মৃত্যুর দৃশ্য দেখে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। তারা কি ক্লান্ত নাকি এই সমাজ এখন এতটাই এতটাই সহিংসতার সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে বা মব ভায়োলেন্স মফ জাস্টিস দেখতে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে যে এই দৃশ্য তাদের আর নাড়া দেয় না।
তিনি বলেন, এই দেশে ব্যবসা করতে গেলে রাজনৈতিক ছত্রছায়া লাগে। চাঁদা দিতে হয়। এলাকা ভাগাভাগি করতে হয়। আমরা সবাই সেটা জানি। সোহাগ তার ব্যবসা বাড়াচ্ছিল কিন্তু সোজা পথে সিন্ডিকেটকে পাত্তা না দিয়ে। তাই প্রতিপক্ষ ক্ষিপ্ত হয়। হুমকি দেয়। গোদাম তালাবদ্ধ করে টাকা দাবি করে। টাকা না দিলে প্রাণ যাবে। এটাই ছিল হিসেব। সোহাগ টাকা দেননি। এবং সেই হিসাবই তার প্রাণ নিয়ে নিল। জানা যাচ্ছে, সোহাগ এবং তার খুনিরা সবাই কোন না কোন সময় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। আওয়ামী লীগ সরকারের সময় সোহাগ এক স্থানীয় প্রভাবশালী নেতার আশীর্বাদে ব্যবসা করতেন বলে অভিযোগ আছে। সরকার পতনের পর তিনি যুবদলের সঙ্গে যুক্ত হন। আবার যিনি খুনের মূল হোতা হিসেবে অভিযুক্ত সেই মাহমুদুল হাসান মহিম নিজেকে যুবদলের নেতাই দাবি করেন। তিনি চকবাজার যুবদলের সাধারণ সম্পাদক হওয়ার দৌড়ে যুক্ত ছিলেন বা দৌড়ে আছেন। স্থানীয় দোকানীদের কাছ থেকে চাঁদা আদায়, হাসপাতালের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারি নিয়োগে ঘুষ নেওয়া এসব অভিযোগও তার বিরুদ্ধে রয়েছে।
খুলনার দৌলতপুরে একই দিনে আরো একটি হত্যাকাণ্ড ঘটে। সাবেক যুবদল নেতা মাহবুবুর রহমানকে গুলি করে এবং রগ কেটে হত্যা করা হয় নিজ বাসার সামনে। রক কাটার গল্প আমরা জানি। তারা রগ আগে কাটতো, সেটাও আমরা জানি।
এই মাহবুবুর কিছুদিন আগেই কুয়েটের সংঘর্ষে রামদা হাতে দাঁড়িয়েছিলেন। সেই ছবি ভাইরাল হওয়ার পর তাকে দল থেকে বহিষ্কার করে যুবদল। অথচ সেটি হয়তো তার মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কেউ বলছেন যে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের কাজ। কেউ বলছেন এলাকাভিত্তিক আধিপত্য। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এই সমাজে রাজনৈতিক ব্যবহার যোগ্যতা শেষ হলেই মানুষ হয়ে যায় অসহায় শিকার। চাঁদপুরের জুমার নামাজ শেষে এক ইমামকে মসজিদের ভেতরে কুপিয়ে আহত করা হয়। আপনারা অনেকেই জানেন, অভিযোগ খুতবা পছন্দ হয়নি। তাকে শাতিম বলে অভিযুক্ত করা হয়। যেন রাষ্ট্র সমাজ বা বিচার ব্যবস্থা সবই বাতিল হয়ে গেছে। ব্যক্তিগত বিশ্বাসই এখন আইন। এইসব ঘটনায় রাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া কেমন?
টিকে/