বেআইনিভাবে শত শত জাতিগত বাঙালি মুসলিমকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠাচ্ছে ভারত: হিউম্যান রাইটস ওয়াচ

ভারত সরকার সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে বেআইনিভাবে শত শত জাতিগত বাঙালি মুসলিমকে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিয়েছে বলে অভিযোগ করেছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)।

সংস্থাটির দাবি, এসব মানুষকে ‘অবৈধ অনুপ্রবেশকারী’ বলে চিহ্নিত করে যথাযথ আইনগত প্রক্রিয়া অনুসরণ না করেই বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছে।

নিউইয়র্কভিত্তিক এই সংস্থার বুধবার প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ফেরত পাঠানো বাঙালী মুসলিমদের অনেকেই ভারতের বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলোর নাগরিক। ২০২৫ সালের মে মাস থেকে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) পরিচালিত কেন্দ্রীয় সরকার এই বিতাড়ন প্রক্রিয়া আরও জোরদার করেছে।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলছে, “ভারতের শাসক দল বিজেপি নির্বিচারে বাঙালি মুসলিমদের দেশ থেকে বের করে দিয়ে বৈষম্যের আগুনে ঘি ঢালছে, এমনকি যারা প্রকৃত ভারতীয় নাগরিক, তারাও বাদ পড়ছেন না।”

সংস্থাটির এশিয়া পরিচালক এলেইন পিয়ারসন বলেন, “যেভাবে সরকার ‘অবৈধ অনুপ্রবেশ’ ঠেকানোর কথা বলছে, তা বিশ্বাসযোগ্য নয়, কারণ এতে তারা ন্যূনতম আইনগত অধিকার বা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানদণ্ডও মানছে না।”

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের তথ্যমতে, গত জুন মাসে তারা ৯টি ঘটনার ভুক্তভোগী ও তাদের পরিবারের ১৮ জনের সাক্ষাৎকার নিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছেন এমন ভারতীয় নাগরিকরাও, যাদের বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল এবং পরে তারা আবার ভারতে ফিরে আসেন। গত ৮ জুলাই এই বিষয়ে ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিলেও কোনো সাড়া মেলেনি।

ভারতের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে কোনো সরকারি তথ্য না দিলেও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) জানিয়েছে, গত ৭ মে থেকে ১৫ জুনের মধ্যে অন্তত ১৫০০ মুসলিম পুরুষ, নারী ও শিশুকে ভারত বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ১০০ রোহিঙ্গা শরণার্থী রয়েছেন। ফেরত পাঠানোর এই প্রক্রিয়া এখনও অব্যাহত রয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলো যেমন আসাম, উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, গুজরাট, ওড়িশা ও রাজস্থান থেকে অধিকাংশ দরিদ্র মুসলিম অভিবাসী শ্রমিকদের আটক করে ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে।

অনেক ক্ষেত্রে ভারতীয় সীমান্তরক্ষা বাহিনী বিএসএফ আটক ব্যক্তিদের বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিতে ধমক, মারধর ও অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে বাধ্য করেছে, এমন অভিযোগও করা হয়েছে। কিছু মানুষ পরে প্রমাণ দিতে পেরেছেন যে তারা ভারতীয় নাগরিক এবং ভারত সরকার তাদের আবার ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছে।

গত এপ্রিল মাসে জম্মু ও কাশ্মিরে হিন্দু পর্যটকদের ওপর হামলার পর পুলিশ মুসলিমদের বিরুদ্ধে হয়রানি শুরু করে।

এছাড়া মে মাসে প্রায় ১০০ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আসাম থেকে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এমনকি জাতিসংঘ জানিয়েছে, ভারত আরও ৪০ রোহিঙ্গাকে সমুদ্রে পাঠিয়ে দেয় এবং তাদের লাইফজ্যাকেট দিয়ে মিয়ানমারের উপকূলে সাঁতরে যেতে বলে। জাতিসংঘের মিয়ানমার বিষয়ক বিশেষ দূত টম অ্যান্ড্রুজ এটিকে “মানবতার চরম লঙ্ঘন” বলে অভিহিত করেছেন।

অ্যান্ড্রুজ এটিকে নন-রিফাউলমেন্ট নীতির সরাসরি লঙ্ঘন বলেছেন। এই আন্তর্জাতিক নীতি অনুযায়ী, কাউকে এমন কোনো স্থানে পাঠানো যাবে না, যেখানে তার জীবন বা স্বাধীনতা হুমকির মুখে পড়বে।

এর আগে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গত ৮ মে ভারত সরকারকে চিঠি দিয়ে জানায়, এই ধরনের ‘পুশ-ইন’ গ্রহণযোগ্য নয় এবং শুধুমাত্র সুনির্দিষ্টভাবে বাংলাদেশি হিসেবে শনাক্ত হওয়া ব্যক্তিদেরই আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়ায় ফেরত নেওয়া হবে।

ভারতের সুপ্রিম কোর্ট গত মে মাসের শুরুতে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো ঠেকাতে অস্বীকৃতি জানায়। আদালতের বক্তব্য ছিল, যদি তারা ভারতের নাগরিক না হন, তবে তাদের ফেরত পাঠানো যাবে। এরপর ১৬ মে আদালত রোহিঙ্গাদের সমুদ্রে ঠেলে দেওয়ার বিষয়টি “সুন্দরভাবে সাজানো গল্প” বলে উড়িয়ে দেয়, যদিও সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে ঘটনাটি অস্বীকার করেনি।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলছে, ভারতের এসব কর্মকাণ্ড আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন, জাতিগত বৈষম্য বিলোপ কনভেনশন ও নাগরিক অধিকার সুরক্ষাকারী চুক্তির পরিপন্থি। যে কাউকে দেশ থেকে বের করে দেওয়ার আগে তাকে কারণ জানানোর অধিকার, আইনজীবীর সহায়তা ও সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল করার সুযোগ দেওয়া বাধ্যতামূলক।

এছাড়াও যারা আটক আছে, তাদের খাদ্য, চিকিৎসা, আশ্রয় এবং নারীদের, শিশুদের, প্রবীণদের ও প্রতিবন্ধীদের মতো ঝুঁকিপূর্ণ গোষ্ঠীর জন্য বিশেষ ব্যবস্থা থাকা উচিত।

এমআর/এসএন 

Share this news on:

সর্বশেষ

img
কোনো নাগরিক অবৈধ উপায়ে ভারত থাকলে গ্রহণে প্রস্তুত বাংলাদেশ: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা Jul 26, 2025
img
যারা পরিবেশকে ধ্বংস করবে, পাবে না বিএনপির মনোনয়ন: আমীর খসরু Jul 26, 2025
img
কঠিন সিদ্ধান্তে ‘চরম হতাশ ও ক্ষুব্ধ’ মেসি Jul 26, 2025
img
রাজনৈতিক বন্দোবস্ত ছাড়া অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব নয়: অর্থ উপদেষ্টা Jul 26, 2025
img
কোথাও কোনো সুশাসন-নিয়ন্ত্রণ নেই : মির্জা ফখরুল Jul 26, 2025
যে কারনে মুন্নাভাই ছবিতে শাহরুখের জায়গায় সঞ্জয় দত্তকে বেছে নিতে বাধ্য হন নির্মাতারা? Jul 26, 2025
থ্রি ইডিয়টসের ‘রাজু’র সাথে পর্দা ভাগ করতে যাচ্ছেন তানজিন তিশা, খায়রুল বাসার Jul 26, 2025
আসলে কি আপনি মুমিন? Jul 26, 2025
img
নেপালের আদালতের রায় নিয়ে বিভ্রান্তি, জানাল ইউএস-বাংলা Jul 26, 2025
img
পিচ নিয়ে কড়া সমালোচনার পাল্টা জবাব দিলেন রমিজ রাজা Jul 26, 2025
img
খাগড়াছড়িতে ইউপিডিএফ ও জেএসএসের সংঘর্ষে প্রাণ গেল ৪ জনের Jul 26, 2025
img
নিম্নচাপের প্রভাবে স্থবির ভোলা, ১০ নৌপথে লঞ্চ চলাচল বন্ধ Jul 26, 2025
img
ইতালির সড়কে ভেঙে পড়ল বিমান, পাইলটসহ নিহত ২ Jul 26, 2025
img
খুলনায় বোরকা পরে অভিনব কায়দায় ছিনতাই Jul 26, 2025
img
স্ত্রীর সুস্থতা কামনায় দোয়া প্রার্থনা কর্নেল অলির Jul 26, 2025
img
ইরানের আইআরজিসির ঘাঁটিতে সন্ত্রাসী হামলা Jul 26, 2025
img
জাতি এগিয়ে যাচ্ছে , ফেল করলে আমাদের নর্দমায় ফেলে দেবে: প্রেস সচিব Jul 26, 2025
img
এক ফ্রেমে জিৎ-ঋতুপর্ণা, বাড়ছে দর্শক মনে কৌতূহল! Jul 26, 2025
img
মাইলস্টোন ট্র্যাজেডি : হাসপাতাল থেকে হস্তান্তর করা হয়েছে জারিফের মরদেহ Jul 26, 2025
img
চলতি সপ্তাহেও বন্ধ থাকবে মাইলস্টোন Jul 26, 2025