লড়াই এখনো শেষ হয়নি, আমাদের লড়াই-সংগ্রাম চলবে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান।
তিনি বলেন, যদি জুলাই যোদ্ধারা জীবন বাজি রেখে, তাদের জীবন দিয়ে আমাদেরকে পরিবর্তন এনে না দিতেন, আমরা এখানে বসতাম নাকি কেরানিগঞ্জে থাকতাম নাকি কাশিমপুরে থাকতাম। আমরা এত তাড়াতাড়ি ভুলে যাই কীভাবে? আমরা তো মাসের পর মাস সেখানে ছিলাম।
বাংলাদেশের জনগণের অধিকার পুরো মাত্রায় প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত, দুর্নীতি-দুঃশাসন মুক্ত বাংলাদেশ গড়ে না ওঠা পর্যন্ত লড়াই অব্যাহত থাকবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আগের মতোই একতাবদ্ধ হয়ে রাজপথে লড়াই করব, যুদ্ধ করব, সংগ্রাম করব। জনতার এই লড়াই-সংগ্রামে বিজয় অর্জিত হবেই, ইনশাআল্লাহ।
শনিবার (২৬ জুলাই) বিকেলে বাংলাদেশ চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে জুলাই’২৪ শহীদ পরিবার সোসাইটি কর্তৃক ‘৩৬ জুলাই বিপ্লবের বীর শহীদদের সম্মানে আয়োজিত এক স্মরণ সভায় এসব কথা বলেন তিনি।
ডা. শফিকুর রহমান বলেন, আসলে আজকের দিনটি আমাদের নিজেদের কাছে লজ্জিত হওয়ার দিন, অনুতপ্ত হওয়ার দিন এবং অনেকগুলো না পারার কৈফিয়ত দেওয়ার দিন। ব্যক্তিগত কিছু অসুবিধার কারণে আমি মন ভরে সবার কথাগুলো শুনতে পারিনি। শুনতে পারলে আমার বিবেক আরও শান্ত হতো। আমার কর্তব্য নির্ধারণের সহায়ক হতো। যে কয়েকজনের বক্তব্য শুনলাম তারা কোনো অন্যায় আবদার করেননি, অসংগত বক্তব্য রাখেননি। তাদের কথাগুলো, দাবিগুলো অন্তর অন্তস্থল থেকে বের হয়ে এসেছে। আপনজন প্রিয়জনকে তারা দেশ এবং সমাজের জন্য উপহার দিয়েছেন। কিন্তু রাষ্ট্র এবং জাতির যে দায়িত্ব ছিল, কর্তব্য ছিল, আমি অকপটে স্বীকার করে নিচ্ছি রাষ্ট্রের দায় রাষ্ট্র বলবে।
তিনি বলেন, আমি একটি রাজনৈতিক দলের কর্মী হিসেবে স্বীকার করে নিচ্ছি যে, আমাদেরও দায় আছে, সে দায়িত্ব আমরা সঠিকভাবে পালন করতে পারিনি। আমরা চেষ্টা করেছি শুধু শহীদ পরিবার না, যারা এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন সব যোদ্ধাকে সম্মান দেখাতে। কিন্তু এটাও স্বীকার করে নিচ্ছি যেভাবে দরকার ছিল, উচিত ছিল আমরা সেটা পারিনি। এ বিষয়টি আমরা আমাদের কর্মসূচি হিসেবে নিয়েছিলাম, আমরা প্রত্যেকটি শহীদ পরিবারের কাছে পৌঁছাব, তাদের জন্য দোয়া চাইব, সান্ত্বনা দেব, তাদের পাশে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেব এবং তাদের কাছে আমরা দোয়া চাইব। আমাদের চেষ্টার ত্রুটি থাকতে পারে, আমাদের আন্তরিকতার কোনো ঘাটতি ছিল না।
তিনি বলেন, সরকার কিংবা কোনো দল এমন কিছু শহীদ পরিবারকে দিতে পারবে না, যেটা একজন শহীদের বিনিময় হতে পারে। যেটা দিতে পারবে সেটি হচ্ছে রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতা এবং তাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন। বলতে গেলে তার অল্প কিছু হয়েছে, অনেক কিছু হয়নি। তারা জুলাই সনদের কথা বলেছেন, এটি তো বাংলাদেশের ১৮ কোটি মানুষের মুক্তির সনদ। এটি তো শুধু শহীদ পরিবারের জন্য প্রয়োজন নয়। এটা ইনডিভিজ্যুয়ালি বাংলাদেশের প্রত্যেকটি নাগরিকের প্রয়োজন। তাহলে এ সনদ কে করবে?
তিনি আরও বলেন, ১৮ কোটি মানুষ মিলে করবে? কিন্তু তার কোনো সুযোগ নেই। দেশে যদি পার্লামেন্ট থাকত, এটা পার্লামেন্টের কাছে দাবি হতো।
পার্লামেন্টের অবর্তমানে এই দায় হচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলোর। সরকার ঐকমত্য কমিশন গঠন করেছে, সেখানে দিনের পর দিন, ঘণ্টার পর ঘণ্টা আলোচনা হচ্ছে কিন্তু এই অগ্রাধিকার পড়ে আছে পেছনে। সেটা হচ্ছে না। এ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর চিন্তা করা উচিত।
জামায়াত আমির বলেন, আজকে এখানে জুলাই যোদ্ধাদের পাশাপাশি এই দেশের গর্বিত অনেক নাগরিক যাদেরকে বছরের পর বছর গুম করে রাখা হয়েছিল পৃথিবীর ইতিহাসের কুখ্যাত আয়নাঘরে। তারাও কেউ কেউ এখানে উপস্থিত আছেন। যারা শহীদ হয়েছেন, যাদেরকে খুন করা হয়েছে।
তাদের সবার পরিবার তাদের ঠিকানা এখনও খুঁজে পায়নি। যারা আয়নাঘরে ছিলেন, তাদের পরিবার জানতোই না তারা বেঁচে আছেন নাকি দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন। এমন একটি জল্লাদ সরকারের হাত থেকে যারা মুক্তি এনে আমাদের হাতে তুলে দিলো, আমরা কেন ভুলে যাচ্ছি তাদেরকে।
তিনি আরও বলেন, ইতিহাস আমাদেরকে ক্ষমা করবে না। আগামী প্রজন্ম আমাদের কাছ থেকে কড়ায়গণ্ডায় হিসাব নেবে। এজন্য আমিও শহীদ পরিবারের সঙ্গে কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে বলি, সবকিছু আপাতত দুই দিনের জন্য রাখেন। জুলাই সনদ পাশ করেন সবাই মিলে।
ডা. শফিকুর রহমান বলেন, ঐকমত্য কমিশনে আমাদের যারা প্রতিনিধি, তাদেরকে আমরা স্পষ্ট বার্তা দিয়েছি—এ ব্যাপারে কোনো ধরনের আমাদের পক্ষ থেকে সামান্যতম দুর্বলতা প্রদর্শন যেন না হয়। অন্যান্য দলগুলোকে আমি আহ্বান করব, ক্ষমতায় কে যাবে, কে যাবে না আল্লাহ তায়ালাই ডিসাইড করবেন। নির্বাচন কবে হবে, না হবে এটাও আল্লাহ তায়ালা নির্ধারণ করবেন। আগে নিজের কর্তব্যগুলো আমরা পালন করি।
জামায়াত আমির বলেন, শহীদ পরিবার রাষ্ট্রের কাছে বড় কিছু চায়নি, এইটুকুর স্বীকৃতি চেয়েছেন। একটু সম্মান চেয়েছে। কিন্তু এ সম্মান ও স্বীকৃতি দিতে কোথায় যেন লুকোচুরি চলে। এই হীনমন্যতা কেন? কেন আমরা উপলব্ধি করি না। বর্তমান সরকার থেকে শুরু করে প্রত্যেকটি মুক্ত নাগরিক তাদের কাছে রক্তের জালে বন্দি। তাদের রক্তের ঋণ পরিশোধ করা আমাদের পবিত্র কর্তব্য। তারা আমার সঙ্গে মতবিনিময়ে বসেছেন, আরও হয়তো অনেকের সঙ্গে বসেছেন। আমি তাদেরকে বলেছি এ অভিযাত্রায় সব জায়গায় সবসময় আমরা লাব্বাইক, ডাকলেই আমাদেরকে হাজির পাবেন ইনশাআল্লাহ।
তিনি বলেন, আপনারা জানেন, ১৯ জুলাই একটা সমাবেশে অ্যাটেন্ড করতে গিয়ে আমি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। তার রেশ এখনও কাটেনি। ইতোমধ্যে কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে। হয়তোবা দুই/চার দিনের মধ্যে আমাকে কিছু মেডিকেল প্রসিডিউর-এর ভেতর দিয়ে যেতে হবে। হায়াত-মউত আল্লাহর হাতে। আপনাদেরকে কথা দিচ্ছি। আমরা আপনাদেরই একজন।
আমাদেরকে আপনাদের পরিবার থেকে আলাদা ভাববেন না মেহেরবানি করে। আমরা আপনাদেরকে ঘরে ঘরে গিয়ে অনুরোধ জানিয়েছি, আপনাদের সুখের দিনে আমাদেরকে স্মরণ না করলেও চলবে। কিন্তু দুঃখের দিনে আমরা যেন পাশে দাঁড়াতে পারি, এই খবরটুকু দিয়ে, ইনফরমেশন দিয়ে আমাদেরকে কৃতজ্ঞ করবেন। আমরা ওয়াদাবদ্ধ। আমরা আছি, আমরা থাকব ইনশাআল্লাহ।
তিনি বলেন, জুলাই আন্দোলনে যারা শহীদ হয়েছেন তাদের ৭০% মানুষ অত্যন্ত সীমিত আয়ের ছিলেন। তাদের নুন আনতে পান্তা ফুরাতো। কিন্তু জাতির জন্য জীবন দিতে এক মুহূর্তও বিলম্ব করেননি। এই শহীদ পরিবারের দায়িত্ব দেশবাসীকে বিশেষ করে সরকারকে নিতে হবে। এই পরিবারগুলো কারো কাছে ভিক্ষা চায় না, তারা সম্মানের সাথে বাঁচতে চায়। তাদেরকে মর্যাদা দিতে হবে। যোগ্যতানুযায়ী শহীদ পরিবারের সদস্যদের পুনর্বাসিত করতে হবে, চাকরি দিতে হবে। এটার নাম কোটা নয়। কোটা হচ্ছে যুগ যুগ ধরে চৌদ্দ গোষ্ঠীর কপালে যা ঝুলিয়ে দেওয়া হয়, ঐটার নাম কোটা। এটা তারা আমাদের কাছে চায়নি। এটা আমাদের কর্তব্য।
তিনি আফসোস করে বলেন, এক বছর হতে চলল, আজ পর্যন্ত শহীদদের প্রোফাইল তৈরি করা সম্ভব হলো না। আমি বিস্মিত! তবে আমরা ঘরে ঘরে গিয়ে খোঁজ-খবর নিয়ে শহীদদের ইতিহাস লিপিবদ্ধ করার চেষ্টা করেছি। ইতোমধ্যেই আমরা প্রথমে ১০ খণ্ড প্রকাশ করেছি এবং পরে আরও দুই খণ্ড প্রস্তুত করা হয়েছে। এগুলোর ইংরেজি ভার্সনও প্রস্তুত করা হয়েছে। এ প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। পাঁচ বছর পরও যদি কোনো শহীদের খবর পাই, আমরা তার প্রোফাইল তুলে আনব ইনশাআল্লাহ। আমরা চাই আমাদের শহীদরা অম্লান হয়ে থাকুক।
তিনি আরও বলেন, ত্রিশ হাজারের বেশি ইনজুর্ড হয়েছে। তাদের অনেকেই হাত-পা-চোখ হারিয়ে হাসপাতালে বা নিজ বাড়িতে ঘরের বিছানায় প্যারালাইজড হয়ে পড়ে আছে। তাদের প্রোফাইলও প্রকাশের কাজে হাত দিয়েছি। তাদেরও দুটি ভলিউম ইতোমধ্যেই সম্পন্ন হয়েছে। আমাদের ধারণা এই ভলিউম ১০০ খণ্ডে চলে যেতে পারে। সরকার করুক বা না করুক একটি দায়িত্বশীল সংগঠন হিসেবে আমরা এটা চালিয়ে যাব, ইনশাআল্লাহ। এই শহীদ ও আহত পরিবারগুলোকে বুকে নিয়ে আমরা গর্বের সাথে বাঁচতে চাই।
তিনি শহীদ পরিবারগুলোর উদ্দেশে বলেন, জামায়াতে ইসলামীর অঙ্গীকার; আমরা আপনাদের পাশে আছি এবং ভবিষ্যতেও থাকব ইনশাআল্লাহ।
আমাদের ঈদ হলে আপনাদেরও ঈদ হবে, আমাদের বাচ্চাদের লেখাপড়া হলে, আপনাদের বাচ্চাদেরও লেখাপড়া হবে ইনশাআল্লাহ। এক্ষেত্রে যদি আমাদের সবকিছু উজাড় হয়ে যায়, প্রয়োজনে জাতির এই ঋণ পরিশোধের জন্য আমরা ভিক্ষা করব, তারপরও আপনাদের পাশে থাকব ইনশাআল্লাহ। আমাদের জন্য দোয়া করবেন, আমরা যে ওয়াদা করি তা যেন মিথ্যায় পর্যবসিত না হয়। তা যেন সত্যে পরিণত হয়।
তিনি আরও বলেন, এখানে চিফ প্রসিকিউটর আছেন; তারা মামলাগুলো হ্যান্ডেল করার চেষ্টা করছেন। আমরা জানি তারা দিনরাত পরিশ্রম করছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত জাতি দৃশ্যমান কিছু দেখতে পায়নি। আপনাদের জন্য দোয়া করার পাশাপাশি আমরা সবাই মিলে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেব। তবুও জাতির সামনে বিচার প্রক্রিয়া দৃশ্যমান করুন, যাতে আমাদের মধ্যে আস্থা তৈরি হয়। ফ্যাসিবাদের মূল হোতা দুর্ধর্ষ গডমাদার, গডফাদারদের বিচার যদি জাতি দৃশ্যমান দেখতে পায়, তাহলে চেলা-চামুণ্ডাদের বিচারের ব্যাপারেও জাতি আশ্বস্ত হবে।
আমাদের দাবি আপনারা বিচার প্রক্রিয়ার গতি দ্রুত বাড়িয়ে দিন। যদি আরও বিচারক নিয়োগ করতে হয়, প্রসিকিউশন মেম্বার বাড়াতে হয়, তবে সরকারের উচিত সহযোগিতা করা। যদি তদন্তকারী সংস্থা বাড়াতে হয়, সেটাও বাড়াতে হবে। তবে আমরা কোনোভাবেই অন্যায় বিচার চাই না, ন্যায্য বিচার চাই। আমরা জানি, ন্যায্য বিচার নিশ্চিত হলেই খুনিদের, জালিমদের লজ্জার সঙ্গে দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে হবে ইনশাআল্লাহ। দেশের ১৮ কোটি মানুষ এই বিচার দেখার অপেক্ষায় রয়েছে। আমি সোজাসাপটা কথা বলার চেষ্টা করি; আমার কথায় কেউ আহত হলে ক্ষমা করবেন।
এমআর